ফুটবলের কালো মানিক; এক রূপকথার যুবরাজ
৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ১৪:১৯
এমন জীবন তুমি করিবে গঠন /মরণে হাসিবে তুমি, কাঁদিবে ভুবন। মৃত্যু চিরন্তন সত্য, সন্দেহ নেই, মৃত্যুই এই রক্তমাংসের জীবনের শেষ। এই বাস্তবতা জেনেও কবি এমন মৃত্যু চান যে মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয়, বরং জীবনের শুরু। এই ধরনের মৃত্যু সবাই চায়। ফুটবল বিশ্বের একজন কিংবদন্তি, কিংবদন্তি পেলে, যিনি ‘কালো মানিক’ নামেও পরিচিত। এটি মৃত্যু নয়, একটি নতুন সূচনা কারণ তিনি এখনও আছেন এবং সর্বদা থাকবেন। আমি যার গল্প বইয়ের পাতায় পডতে বড় হয়েছি সে চলে গেছে। তার মৃত্যুতে শুধু ফুটবল বিশ্বই শোকাহত নয়, বিশ্বের প্রতিটি ক্রীড়াবিদই শোকাহত কারণ তিনি ব্রাজিলের, তবে শুধু ব্রাজিলেরই নয়, এই পৃথিবী নামক গ্রহের। তার মুখে সবসময় মিষ্টি হাসি থাকত। তিনি ফুটবলের জাদুকর। তিনি ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ এবং ১৯৭০ সালে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনবার বিশ্বকাপ জয়ী একমাত্র ফুটবলার। তিনি সারা বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষের কাছেই ‘পেলে’ নামে পরিচিত। ১৯৫৭ সালের ৭ জুলাই মারাকানা স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ খেলতে নামেন সোভিযয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে। তার পরের গল্প শুধুই রূপকথা। ফুটবল বিশ্ব মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। এই দুই দেশের দুই বিখ্যাত তারকা খেলোয়াড় হলেন পেলে ও ম্যারাডোনা। দুজনেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এই দুইয়ের মধ্যে পেলে নামটি একটু আলাদা আবেগের। এর কারণ হলো তার অসাধারণ নৈপুণ্যে তিনবার বিশ্বকাপ এনে দেওয়া। সুপারষ্টার, নক্ষত্র, কিংবদন্তী বা এরকম যত বিশেষণই পেলের সাথে যোগ করা হোক না কেন কোনোটাই যেন যথেষ্ট নয়। ফুটবল মানেই যেন পেলে আর পেলে মানেই ফুটবল। একজন মানুষ কতটা বিখ্যাত হতে পারে তা পেলেকে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর। পেলে ছিলেন অবিশ্বাস্য ফুটবল প্রতিভা সম্পন্ন একজন মানুষ এবং একজন আইকন। তার খেলার সময়ে এবং তার পরবর্তীতেও আরও অনেক ফুটবল মহারথী এসেছেন। কিন্তু পেলের জনপ্রিয়তা ছিল সবার চেয়ে বেশি এবং এখন পর্যন্তও সেই একই অবস্থানে তিনি আছেন। দলকে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে অসাধারণ প্রচেষ্টায় দলকে বিশ্বকাপের স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সব নেতার থাকে না। পেলের তা ছিল।
ব্রাজিলকে একাধিকবার শিরোপা ছোঁয়ার স্বাদ এনে দিয়েছিলেন তিনি। তার ফুটবল থেকে চলে যাওয়া দর্শকদের পুড়িয়েছে। ফুটবল অঙ্গণে শূণ্যতা তৈরি করেছে। তার এভাবে চলে যাওয়ায় ফুটবল বিশ্বে তো বটেই সারা বিশ্বেই শোক নেমে এসেছে। এমন প্রতিভা তো সব শতাব্দিতে জন্ম নেয় না। একজন পেলে, পেলেই। তার তুলনা কেবলই তিনি। তারপরও যদি কোনো ফুটবল খেলোয়াড় ভালো খেলেন তাহলে মুখে পেলের সাথে তুলনা চলেই আসে। তবে অনেক প্রতিভা আসলেও এই ফুটবল জাদুকরের মতো কেউ আসেনি এবং হয়তো আসবে না। তার দেশ ব্রাজিলকে সমর্থন করে অথবা করে না সবাই এই ফুটবল যুবরাজকে ভালোবাসতেন। তার খেলায় মুগ্ধ থেকেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। পেলে একজন অনুসরণীয় খেলোয়াড় ছিলেন। আমাদের দেশে ফুটবল এখন আর আগের মতো অবস্থায় নেই। এখন বাংলাদেশের সাথে পুরো এশিয়াতেই জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। প্রায় সারা বছরই ক্রিকেট নিয়েই মেতে থাকে তরুণ প্রজন্ম। তবে ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই সেই দৃশ্য একেবারে বদলে যায়। এদেশের সিংহভাগ ফুটবল দলের সমর্থক আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের। এই দুই দেশের পতাকায় ছেয়ে যায় সারা দেশ। মুখে, পিঠে এসব দেশের পতাকা এঁকে সমর্থকরা উল্লাস করে।
অনেক সময় এই সমর্থন বাড়াবাড়ি পর্যায়েও পৌছে যায়। ভালোবাসা মানেই তো অনেক সময় বাড়াবাড়ি কিছু। তা মেনে নিতেই হয়। এই বাড়াবাড়ির মধ্যেও থাকে পেলে ও ম্যারাডোনা। আসলে এটা ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা। এবং অবাক করা বিষয় হলো এই আবেগের পুরোটা জুড়েই থাকে এই দু’জন। একজন ভালো খেলোয়াড় কেবল সেই দেশের সম্পদ থাকে না বরং তা সারা বিশ্বের। পেলে নিজ দেশ থেকে সারা বিশ্বেরই একজন হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। দুই পায়ের এই খেলায় যে মুগ্ধতা রয়েছে তা মাঠে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন পেলে। তার মৃত্যুতে রুপকথার এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে। একটা সময় ছিল যখন সারা বিশ্বে ফুটবল মানেই পেলে বা কালো মানিকের কথা মনে হতো। কারণ তখনো ম্যারাডোনার ফুটবলে আবির্ভাব ঘটেনি। তরুণ ফুটবলাররা তার মতো খেলার স্বপ্ন দেখতো। তার মতো করে খেলার চেষ্টা করতো। আজও তাকে অনুসরণ করে খেলার চেষ্টা করে। অন্তত ভালো খেলার চেষ্টা করে। আজ সবাই জানে দর্শকরা একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে ভালো খেলা চায়। আর তাতেই খেলোয়াড়ের সার্থকতা। এইমাত্র শেষ হওয়া বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়েও তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পরে। তবে তা মিথ্যা প্রমাণিত করে তিনি জীবনের সাথে যুদ্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত তাকে মরণ ব্যাধি ক্যানসারের কাছে হার মানতে হয় ৮২ বছর বয়সে। নক্ষত্র কখোনো পৃথিবী থেকে ঝরে পরে না। মৃত্যু মানেই শেষ নয়। কাজ দিয়ে মানুষের মনেও বেঁচে থাকা যায়। তার তিনি তো কালো মানিক। ফুটবলেরই যেন আরেক সমার্থক নাম।
লেখক: কলামিষ্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি