Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উন্নত হওয়ার পথের লজ্জা

অলোক আচার্য
৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৫:৩৪

দেশের আর্থিক কাঠামো শক্তিশালী হলেও ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নেওয়া মানুষের সংখ্যা কমছে না। এভাবে ভিক্ষুক যা আদৌ কোনো পেশা নয় বা কোনোদিন ছিল না তাদের রেখে উন্নত দেশের কাতারে আমরা কিভাবে দাড়াবো। সত্যিকার অর্থে ভিক্ষার সাথে বৃত্তি শব্দটির যোগ থাকলেও তা সবচেয়ে নিকৃষ্ট উপায়। যেখানে শ্রম যেখানে শ্রম নেই, সেখানে সম্মানও নেই। আর যেখানে সম্মান নেই সেখানে বৃত্তি বা পেশার উল্লেখ থাকতে পারে না। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের সমাজে ভিক্ষাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন অনেক সামর্থবান ব্যক্তি। বর্তমানে শুধু রাজধানী বা শহরকেন্দ্রীক সমস্যাটি সীমাবদ্ধ নেই বরং গ্রামে গঞ্জে হাটে-বাজারেও ভিক্ষুক চোখে পরে। বিশেষ করে শিশু-কিশোর এবং বৃদ্ধদের দেখা যায়। জানা যায়, বিক্ষাবৃত্তি রোধে সরাসরি কোনো আইন প্রণীত হয়নি। তবে ‘ভবঘুরে নিয়ন্ত্রণ আইনের’ আওতায় এটি নিয়ন্ত্রণ বা পুনর্বাসনের চেষ্টা চলছে। এদের নিয়ে বাণিজ্য হয়। একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে তাদের ব্যবহার করে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করছে। এ নিয়ে রাজধানীতে মোটা অংকের বাণিজ্যও হয়। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ঢাকা শহরের ভিক্ষুকমুক্ত ঘোষিত এলাকাগুলোকে ১৮টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ১৮০ জন পেশাদার ভিক্ষুককে আটক করা হয়। এর মধ্যে ৭২ জনকে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্রে বিভিন্ন মেয়াদে আটক রেখে প্রশিক্ষণ প্রদান ও পুনর্বাসন করা হয়। অবশিষ্ট ১০৮ জনকে পরিবারে পুনর্বাসন করা হয়। ভিক্ষুক পুনর্বাসনের কাজটি পদ্ধতিগতভাবে করার জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। ভিক্ষাবৃত্তি প্রকৃতপক্ষে কোনো বৃত্তি বা পেশার মধ্যে না পরলেও আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের দেশে ভিক্ষাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে অনেকে। ধারণা করা যায়, ভিক্ষাবৃত্তিতে কোনো পরিশ্রম না থাকায় এবং এর পেছনে একটি চক্র কাজ করায় দেশ এগিয়ে চললেও ভিক্ষুক মুক্ত হচ্ছে না দেশ। আমাদের দেশে চারপাশে তাকালেই ভিক্ষুকের ভিক্ষা করার দৃশ্য চোখে পরে। শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই ভিক্ষা করছে! বাস্তব অবস্থা হলো কেউ ভিক্ষা করছে আর কাউকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হচ্ছে। এতে যেন কোনো লজ্জা নেই, ঘৃণা নেই, আত্মসম্মানবোধ নেই, অনুশোচনা নেই। কাজের মর্যাদাকে অস্বীকার করে দুহাত পেতে সাহায্য চেয়ে, মিথ্যা বলে ভিক্ষা করছে। রাস্তায় অসুস্থ নারী পুরুষ যারা ভিক্ষা করছে তাদের কতজন সত্যিকারের অসুস্থ, কতজন সত্যিকারের প্রতিবন্ধী, কতজন সত্যিকারের অসহায় তার খোঁজ করার কোনো উপায় নেই। কারণ সুস্থ মানুষ অসুস্থতার ভান করে, কোলের শিশুকে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দিয়ে অসুস্থ বানিয়ে,শরীরকে প্রতিবন্ধীর মতো করে,অসহায়ত্বের ভান করে ভিক্ষা করছে। প্রতিনিয়তই নিত্য নতুন উপায়ে মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভিক্ষাবৃত্তির পথ অবলম্বন করছে। কারণ মানুষের আবেগই এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে। যত করুণ বা মর্মান্তিকভাবে নিজের দুঃখ কষ্ট বর্ণনা করা যাবে, ভিক্ষার পরিমাণও তত বেশি হবে। ঢাকা শহরে ভিক্ষা করে মোটা টাকা উপার্জনের খবরও প্রকাশিত হয়। ভিক্ষাবৃত্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট বা চক্র নিত্যনতুন উপায়ে ভিক্ষার ক্ষেত্র রচনা করছে। শিশুদের পরিকল্পিতভাবে ভিক্ষাবৃত্তিতে কাজে লাগানো হচ্ছে। অন্যদিকে ভিক্ষুকের টাকায় ভাগ বসিয়ে তারা রীতিমতো আরাম আয়েশে জীবন যাপন করছে। ভিক্ষাবৃত্তি অর্থ উপার্জনের নিকৃষ্ট মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম। হাত পেতে কারো কাছ থেকে কিছু নেয়া বা বা চাওয়া আত্মসম্মান বিসর্জন দেয়া মানুষের অর্থ উপার্জনের কৌশল। অনেকে আছে যারা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী বা কোনো শ্রমমূলক কাজ করতে বাস্তবিকপক্ষেই অক্ষম তারা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিন্তু যারা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করছে তারা সমাজের বোঝা বই অন্য কিছু নয়।

বিজ্ঞাপন

একজন শ্রমিক সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি করে যে অর্থ উপার্জন করছে, সেই অর্থ কেবল হাত পেতেই একজন ভিক্ষুক উপার্জন করছে। একসময় ভিক্ষাবৃত্তি সম্পর্কে মানুষের ধারণা ছিল যে কেবল উপার্জনে অক্ষম বা অসহায় ব্যক্তিই ভিক্ষাবৃত্তি অলম্বন করে। আজ এই ধারণা অর্থহীন। এটি এখন একটি পেশা হিসেবে নিয়েছে অনেকে! আমাদের সমাজের চারদিকে তাকালেই অনেক ভিক্ষুক চোখে পরে যারা শারীরিকভাবে কাজ করতে সক্ষম। তাদের কাজের কথা বললে তারা অনীহা প্রকাশ করে। কারণ কাজ করতে ইচ্ছা না থাকার কারণেই তারা ভিক্ষার মতো অসম্মানজনক পথ জীবিকা হিসেবে বেছে নিয়েছে। বর্তমান সরকার দেশকে ভিক্ষামুক্ত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের জন্য নানাভাবে তাদের সহায়তা দিয়ে আসছেন। কিন্তু যা থাকে স্বভাবে তা কি আর এত সহজেই পরিবর্তন করা সম্ভব হয়। দুর্নীতি যেমন কেবল দারিদ্রতার জন্যই হয় না তেমনি কেবল অভাবে পরেই সবাই ভিক্ষা করছে না। দেশ ভিক্ষুকমুক্ত করতে হলে মন থেকে ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘৃণা করতে শিখতে হবে। এতে অবশ্য তাদের অসুবিধা হবে যারা অসহায় মানুষদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা ফেদেছে। রাজধানী ঢাকায় এই ভিক্ষার চিত্র বেশ ভয়াবহ। প্রতিবছর গ্রাম থেকে নানা কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ রাজধানীতে আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে এক শ্রেণি জীবন যাপনের জন্য ভিক্ষার পথ বেছে নেয়। এর কারণ দুটি। প্রথমত. সেখানে তাদের পরিচিত কেউ থাকে না। ফলে গ্রামে যে সমস্যা হতো সেখানে তা হয় না। আর দ্বিতীয়ত অন্য যেকোনো রোজগারের পথ খোঁজা বেশ কঠিন। ফলে সহজ পথ হিসেবে মানুষের কাছে হাত পাতা। এক প্রকার বিনা পরিশ্রমেই দিন কেটে যায়।

বিজ্ঞাপন

রাস্তায়,মোড়ে,গাড়ির জ্যামে,ওভার ব্রীজে যেখানেই তাকান ভিক্ষার দৃশ্য চোখে পরবেই। এদের থাকে সর্দার। এই সর্দারের নির্দেশেই ভিক্ষুকরা এলাকাভেদে ভিক্ষা করে। আমরা সামনে যদি কেউ ভিক্ষার জন্য হাত পাতে তখন তাদের আমি কাজ দেওয়ার কথা বললে তারা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। অর্থাৎ ভিক্ষাকেই তারা উৎকৃষ্ট বলে মনে করছে। দেশ যখন উন্নত হওয়ার দৌড়ে রয়েছে তখন এই মানসিকতা পরিহার করা জরুরি। ভয়ংকর ব্যপার হলো ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুদের টানা হচ্ছে। কৌশলে শিশুদের এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। কারণ শিশুদের প্রতি মানুষের সহানূভুতি বেশি। শিশুর মুখের দিকে তাকালে করুণাবশত বেশি টাকা দেয়। ফলে এ কাজে শিশুদের আনা হচ্ছে। একজন প্রত্যেক বছর শিশুর জন্ম দিচ্ছে। কারণ একটাই। যত শিশু তত টাকা। শিশু ভাড়া দিয়ে অর্থ উপার্জন করছে। এসবই বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় এসেছে। এসব ক্ষেত্রে শিশুর মা-বাবা নেশার সাথে জড়িয়ে থাকে। কোনোভাবে অর্থ উপার্জনই মূখ্য বিষয়। ফলে রাস্তা ঘাটে বিপুল সংখ্যক শিশুকে ভিক্ষা করতে দেখা যায়। অথচ এসব শিশুর বইখাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, লেখাপড়া করার কথা। রাস্তায়, ফুটপাতে,পার্কে,খেলার মাঠের আশেপাশে সবস্থানেই এসব শিশুর দেখা পাওয়া যায়। এমন না যে এসব শিশু ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করছে। এসব শিশুকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিশু চুরি করার পেছনেও এসব চক্রের হাত রয়েছে। এই চক্রের মধ্যে নারী-পুরুষ উভয়ই রয়েছে। তারা স্বামী-স্ত্রী সেজে কোলে শিশু নিয়ে ভিক্ষা করে। শিশুকে অসুস্থ করে ভিক্ষা করে। উদ্দেশ্য একটাই, বেশি অর্থ উপার্জন। অসুস্থ শিশু মানুষের মনে খুব সহজেই আবেগের জন্ম দেয়। ফলে তাদের আয় হয় অন্য ভিক্ষুকের চেয়ে বেশি।

দেশে ভিক্ষুকের সংখ্যা কত তার সঠিক হিসাব দেওয়া সম্ভব না। তবে সেই সংখ্যা কয়েক লাখ। ভিক্ষা কেন বৃত্তি বা পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছে তার কয়েকটি কারণ রয়েছে। অভাব এর মধ্যে অন্যতম। তাছাড়াও লাজ লজ্জা বিসর্জন দিয়েও যারা একবার হাত পাতছে তারা নির্লজ্জ্ব সহজ এ উপার্জনকেই জীবনে বেছে নিচ্ছে। দিন শেষে যা উপার্জন হচ্ছে উদ্দেশ্যমন থেকে যতদিন ভিক্ষাবৃত্তিকে ঘৃণা না করবে ততদিন দেশ ভিক্ষুকমুক্ত করা সম্ভব হবে না। অথচ দেশকে উন্নত করতে হলে ভিক্ষুকমুক্ত করতেই হবে। উন্নত দেশের এটাও একটা শর্ত। যারা ভিক্ষা করছে তাদেরও দেশকে দেয়ার মতো অনেক কিছু আছে। শুধু দেয়ার মতো ইচ্ছেটা নেই। যেসব প্রতিবন্ধী অসহায় হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করছে তাদের জন্য প্রশিক্ষণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে মূল ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে প্রতিটি হাতেরই কাজ করার সুযোগ রয়েছে। প্রতিটি হাত থেকেই আমরা কিছু না কিছু পেতে পারি। সত্যিকারের অসহায় মানুষকে চিহ্নিত করতে হবে। যারা প্রকৃতপক্ষেই অসহায় হয়ে ভিক্ষা করছে তাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে। আর যারা এসব অসহায় মানুষদের কাজে লাগিয়ে এবং তাদের ব্যবহার করে নিজেদের ব্যাংক ব্যালান্স তৈরি করছে তাদেরও চিহ্নিত করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অলোক আচার্য উন্নত হওয়ার পথের লজ্জা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

ঢামেকে অভিযানে ২১ দালাল আটক
২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:২০

আরো

সম্পর্কিত খবর