যানজট নিরসন: পরিকল্পনা বনাম বাস্তবতা
৮ জানুয়ারি ২০২৩ ১৬:২২
বিশ্বের অন্যতম জনবহুল এবং বসবাসের অনুপোযোগী শহর ঢাকা। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের চারণভূমি হওয়া সত্ত্বেও পরিবেশ দূষণ, অপর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা, যানজট, জলাবদ্ধতা, মশার উপদ্রব, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ইত্যাদির মত সংকটগুলো যেন জনদুর্ভোগ বাড়িয়েই চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর যানজট ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। লাগামহীন যানজটের ক্রমাগত পিছুটান অবরুদ্ধ করে দিচ্ছে আমাদের গতিপ্রবাহকে। বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশ্বের সর্বাধিক যানজটের শহর হিসেবে একাধিকবার উঠে এসেছে ঢাকার নাম। এমন কোনো দিন এদেশের দিনপঞ্জিতে আসে না, যেদিন শহরের মূল সড়কগুলো থাকে যানজট মুক্ত। বিভীষিকাময় যানজটের ভয়াল গ্রাসে স্থবির হয়ে পড়ছে নগরী। অপমৃত্যু ঘটছে নগরজীবনের।
যেকোনো পরিকল্পিত নগরীর পূর্বশর্ত মোট আয়তনের ২০ থেকে ২৫ ভাগ থাকা চাই সড়কব্যবস্থা। ১৪৬৩ দশমিক ৬০ বর্গ কিলোমিটারের ঢাকা শহরে সেখানে সড়ক রয়েছে ২,২০০ কিলোমিটার, যার ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। মোট আয়তনের কমপক্ষে ৩০ ভাগ খালি জায়গা থাকার কথা থাকলেও ঢাকা শহরে ৫-৭ ভাগের বেশি খালি জায়গা নেই৷ নগর-ব্যবস্থাপনায় এমন বড় ধরনের গলদের খেসারত তাই দিতে হচ্ছে যানজট ভোগান্তির মধ্যদিয়ে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত শহর বলতে রাজধানী ঢাকার নামই উচ্চারিত হয় বারংবার। এই শহর তাই রয়েছে সারাদেশের মানুষের আগ্রহ, প্রয়োজন এবং চাহিদার কেন্দ্রবিন্দুতে। দেশের পরিকল্পনা খাতের অন্যতম সীমাবদ্ধতা হলো বেশিরভাগ সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সিংহভাগ কার্যক্রমই রাজধানী কেন্দ্রিক। অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলির তুলনায় তাই কাজের চাপ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও এখানে বেশি। ঢাকায় টাকা ওড়ার জনশ্রুতিটি মফস্বলগুলোতে বহুল প্রচলিত। উড়ন্ত এই টাকার সম্মোহনে সারাদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ পাড়ি জমায় রাজধানীতে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। বৃহৎসৎখ্যক জনগোষ্ঠীর চাপ যানজট সৃষ্টি করে রাজধানীর প্রবেশ সড়ক গুলোতে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট)-এর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকা শহরের জনসংখ্যা বাড়ছে ১ হাজার ৭০০ জন করে ৷ বছরে পাঁচ লাখ সাড়ে ১৭ হাজার নতুন অধিবাসী যুক্ত হচ্ছে এই শহরে ৷ জনসংখ্যার বিস্ফোরণে প্রয়োজনীয় সড়কের আয়তন না বাড়লেও চাহিদা বাড়ছে গণপরিবহনের। ফলে বিদ্যমান সড়কব্যবস্থায় স্বাভাবিক গতির যানবাহন চলাচলের ক্ষমতা বিবেচনা না করেই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে নিবন্ধন দেওয়া হচ্ছে বছরের পর বছর। বেশিভারক্ষেত্রেই এসব যানবাহন সড়ক পরিবহন আইনের তোয়াক্কা করেনা। নিয়মবহির্ভুতভাবেই যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করানো এবং চালকের স্বেচ্ছাচারিতা সড়কের যানজট পরিস্থিতির অনবতি ঘটায়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে গাড়ির গতি প্রতি ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। যেখানে হাঁটার স্বাভাবিক গতি ঘণ্টা প্রতি ৫ কিলোমিটার। তবে হেটে চলার জন্য ফুটপাত ব্যবহারেও রয়েছে হরেক রকম বিড়ম্বনা। শহরের বেশিরভাগ ফুটপাতগুলোতে চলে হকার, ব্যবসায়ী, ভবন মালিকসহ অবৈধ দখলদারদের দৌরাত্ম্য, ফলে পায়ে হেটে পথ পাড়ি দেওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে নগরবাসী। ট্র্রাফিক বিভাগের হিসাবে, সড়কের কম করে হলেও ৩০ ভাগ বা তারও বেশি দখল হয়ে আছে অবৈধ পার্কিং এবং দখলদারদের হাতে। ব্যক্তিগত যানের আধিক্য রাজধানীর যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শহরের মোট যাত্রীর ৫ থেকে ৬ ভাগ পরিবহন হয় ব্যক্তিগত গাড়িতে; কিন্তু তা সড়কের ৭০ ভাগ অংশ দখল করে রাখে। অর্থাৎ বাকী ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ যাত্রী সড়কের মাত্র ৩০ শতাংশ অংশ ব্যবহারের সুযোগ পান। এই ছোট এবং মাঝারী আকারের ব্যক্তিগত যানের সারি শহরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে যানজট সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ঢাকা শহরের একটি বহুল প্রচলিত দৃশ্য রাস্তা মেরামত কিংবা ড্রেনেজ লাইনিংয়ের কাজ। বছরের বেশিরভাগ সময়েই চলমান এসব সংস্কার কাজের কারণে অনেক সড়কেই যানচলাচল বন্ধ থাকে। বিকল্প সড়কে স্বাভাবিকভাবেই দ্বিগুণ যানবাহনের চাপে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে যত্রতত্র সড়কে জমা করা বর্জ্য কমাচ্ছে পথের আয়তন। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে। বিশেষ করে অপরিসর ড্রেনেজের কারণে রাজধানীর নীচু এলাকাগুলোর অধিকাংশ সড়ই ডুবে যায় পানিতে। ফলে যানচলাচলের স্বাভাবিক গতি ব্যহত হয়। ধীর গতির যান জন্ম দেয় দীর্ঘ যানজটের। সড়কের উপর দিয়েই রেল ক্রসিং কারনে ক্রসিংয়ের দুপাশের দীর্ঘ যানবাহনের সারী এখানকার প্রাত্যহিক চিত্র। এছাড়া অপরিণত নগর পরিকল্পনা এবং গনপরিবহনগুলোকে এখনও পর্যন্ত জনবান্ধব করে না তুলতে পারার ব্যর্থতাও পরোক্ষভাবে যানজট সৃষ্টির জন্য দায়ী। ঢাকার পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৫৩ সালে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (বর্তমান রাজউক), ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত আরবান প্ল্যান তৈরি, ২০১০ সালে ড্যাপ (ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান) তৈরি করা সহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও হয়নি কোনো পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।
একজন চাকুরিজীবী, ছাত্র কিংবা ব্যবসায়ীর কর্মক্ষেত্রে ব্যয়ীত সময় গড়ে আট ঘন্টা, সেখানে ওই একই ব্যক্তির যানজটের ফলে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত বাবদ প্রতিদিন ব্যয় হচ্ছে প্রায় চার থেকে পাঁচ ঘন্টা। অর্থাৎ যে যুগে মানুষের প্রতিটি সেকেন্ড অত্যন্ত মূল্যবান সেখানে প্রতিদিন অকারণে আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ সময়। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন মতে, দুই কোটি মানুষের প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হচ্ছে যানজটের কারণে। সব মিলিয়ে যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যা যেকোনো দেশের টেকসই উন্নয়নের পথে বিরাট বাধা। যানজট সমস্যা ক্রমেই আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি খাতই যানজটের কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি (ডিটিসিএ) এর মতে, বছরে যানজটে নষ্ট হওয়া কর্মঘণ্টার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রাগ ৮১ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা ৷ আর তার সঙ্গে উৎপাদন খাত, স্বাস্থ্যগত ও দুর্ঘটনার ক্ষতি যোগ করলে এই ক্ষতির পরিমাণ দাড়াবে বছরে দেড় লাখ কোটি টাকা। জনস্বাস্থ্যের উপরেও যানজটের প্রভাব মারাত্বক। সংকটাপন্ন রোগী পরিবহণকারী এ্যাম্বুলেন্স তীব্র যানজটের কবলে পড়ে সঠিক সময়ে হাসপাতালে না পৌছানোর কারণে প্রাণ-সংশয়ের মত ঘটনা ঘটছে প্রায়ই। তাছাড়া জরুরি কাজে নিয়োজিত ফায়ার সার্ভিস এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিবহনও অনেক সময় সঠিক সময়ে অকুস্থলে পৌঁছাতে পারে না। এছাড়া নিয়মিত যানজটের ভুক্তভোগীরা অবসাদ, বিষন্নতা, উচ্চরক্তচাপ, বিরক্তি, খিটখিটে মেজাজের মত শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। যাতায়াতের এহেন দুর্ভোগ এবং নষ্ট হওয়া সময়ের কারণে একদিকে যেমন জাতীয় উন্নয়নের গতি মন্থর হচ্ছে তেমনিভাবে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক সম্পর্কের ওপরেও পড়ছে এর মারাত্বক প্রভাব।
আধুনিক জীবন ব্যবস্থার অন্যতম সংকট রাজধানীর যানজট। অথচ কোনো এক দুর্জ্ঞেয় কারণে যানজট নিরসনে এতো উদ্যোগের পরও ক্রমাগত তা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। সড়কে নতুন নতুন লেন যুক্ত হচ্ছে, মাথার উপর উড়াল সেতু নির্মাণ হচ্ছে, কাজ চলছে সপ্নের মেট্রোরেলের। অথচ উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছে যানজটও। এমনকি দুর্ভাগ্যজনকভাবে যানজট নিরসনে তৈরি ফ্লাইওভারেই সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজটের। রাজধানীতে বসবাসরত প্রতিটি প্রাণ ধুকছে যানজট নামক অভিশাপে। অন্যান্য দেশের মানুষ যখন মহাবিশ্ব জয়ের সপ্নে বিভোর, আমাদের সপ্নগুলো তখনও আটকে থাকছে বিজয়সরণী কিংবা গুলিস্তানের যানজটে। কর্মচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ মানুষগুলোর আত্নবিশ্বাসকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে এই অভিশাপ। হয়তো জীবনের তাগিদে বোকা বিস্ময়ে আমরা প্রতিনিয়ত এই মৃতপ্রায় জীবনব্যবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছি। তবুও দিনশেষে যখন মৃতপ্রায় নগরীর বুকে সামান্য প্রাণের সঞ্চার হয়, ঘরখোঁজা চোখের সামনে হাজার যানবাহনের সারি তখন আনমনেই প্রশ্ন করে বসে, ‘এই বিভীষিকার সত্যিই কি কোনো শেষ আছে ?’
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি