একুশের চেতনা ও বর্তমান বাস্তবতা
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:৪৭
পৃথিবীতে বিদ্যমান ভাষার তালিকা দেখলে হয়তো কারো কারো চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণত্বর হতে পারে কিন্তু নিজ ভাষার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম করে জীবন বলিদান দিয়েছে এমন জাতির তালিকা হয়তো দ্বিতীয়টি আর মিলবে না। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারি মানে বাঙালির মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা, একুশ মানে দুনিয়ানকে জানান দেওয়ার বীরত্বে গাঁথা লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস, একুশ মানে মায়ের গর্ভ থেকে বেড় হয়ে প্রথম চিৎকারের ভাষা, একুশ মানে নিজের ভেতরে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হওয়া মনের ভাব অনর্গল ও নির্দিধায় প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম, একুশ মানে দেশপ্রেমে ব্রত হয়ে প্রয়োজনে জীবন বলিদান দিয়ে মা তথা দেশকে রক্ষা করার ইতিহাস থেকে প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা নিয়ে জীবনকে সর্বক্ষেত্রে সংগ্রামী ও বিপ্লবী ধারায় গড়ে তোলার বাতিঘর।
একুশ যে বাঙালির রক্তে মিশে অস্থিতে রূপ নিয়েছে তা কি হটাৎ করে হয়েছে? না, হটাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। হয়েছে দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম, রক্তদান এবং শেষে জীবনদানের মধ্য দিয়ে। ভারতবর্ষ বিভক্তির পর প্রথম যখন বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ করে পাকিস্তানি অপশক্তি তখন বাংলার দেশপ্রেমিক মানুষ নিরবতা পালন না করে প্রতিবাদ শুরু করে, প্রতিক্রিয়া জানায়।
মাতৃভাষার জন্য যারা এতো আন্দোলন সংগঠিত করলো, সংগ্রাম চালালো, তারুণ্যের রক্তে রঞ্জিত করলো রাজপথ এবং পরিশেষে যারা জীবনদানের মধ্য দিয়ে রক্ষা করলো মাতৃভাষা, তাদের আমরা প্রত্যেক বছর একুশে ফেব্রুয়ারি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করি, শহীদদের সম্মান জানানোর জন্য শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করি। মাতৃভাষা আন্দোলন সফলতার একাত্তর বছরে এসে কি আমরা সর্বোত্ত বাংলা ভাষার ব্যবহার শিখেছি? না, শিখেনি। দেশের অভিজাত হোটেল-রেস্তোরেঁস্টের মতো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিল্প-কারখানা মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর নামের সাইনবোর্ডের দিকে তাকালেই সেটা স্পষ্টভাবে বুঝার অপেক্ষা রাখে না বাংলার অক্ষরের বিপরীতে ইংরেজি অক্ষরে লেখা। আমাদের ব্যবহার করা যানবাহনগুলোর ফলক নম্বর প্লেটের দিকে তাকালেও তাই দেখা যায়। অভিজাত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম ইংরেজিতে না লিখলে মনে হয় তাদের ব্যবসা একেবারে চলবে না কিংবা হিসাব চুকিয়ে ব্যবসা ছেড়ে বাসায় বসে থাকতে হবে। মাতৃভাষা আন্দোলনের একাত্তর বছরে এসেও কেন আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম বাংলায় লিখতে অনিচ্ছুক? তবে কি মাতৃভাষা আন্দোলনে রফিক, শফিক, জোব্বার, বরকতের মতোর ভাষার সৈনিকদের জীবনদানের কোনো মূল্য নেই? আর কত বছর পার করার পর শহীদদের সম্মানাত্বে সর্বস্তরে বাংলা অক্ষরের চর্চা শুরু করবো? অথচ ১৯৮৪ সালে এক নিবার্হী আদেশে বলা হয়েছিলো, দেশের সব সাইনবোর্ড, যানবাহন নম্বর ফলক বাংলায় হতে হবে। এই আদেশের বাস্তবায়ন কি আমরা আজও দেখছি? ফলে দুঃখ হলেও চরম সত্য যে আমরা ভাষা শহীদদের সম্মান মাতৃভাষা সর্বস্তরে চর্চার মধ্য দিয়ে দিতে পারিনি। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখনো অক্ষর জ্ঞানহীন। রেল স্টেশনের দিকে এগুলেই দেখা মিলে অগণিত পথশিশু অক্ষর জ্ঞানহীনভাবেই বেড়ে ওঠে। তারা শুধুমাত্র মায়ের কোলে বসে যে ভাষাগুলো শিখে কিংবা সমাজে চলতে ফিরতে গিয়ে যা শিখে তাই দিয়ে জীবন কাটিয়ে দেন। সংবিধান অনুযায়ী শিক্ষা আমাদের মৌলিক অধিকার। এই মৌলিক অধিকার রাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে কি দিতে সক্ষম হয়েছে? শিক্ষা বর্তমানে পণ্যে পরিনত হয়েছে। মোটা দাগে বলতে গেলে শিক্ষা এখন কাঁচামালের মতো ভালো দামে বিক্রি হয়, কম দামে বিক্রি হয়। বাজারে গেলেই লক্ষ্য করা যায় যার পকেটে টাকার পরিমাণ বেশি ঐ ব্যক্তি ভালো মানের পণ্য কিনতে সক্ষম কিন্তু যার পকেটের টাকার পরিমাণটা সামান্য তার জন্য বরাদ্দ তুলনামূলকভাবে খারাপ মানের পণ্য যা নিয়ে বাড়িতে ফিরেন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার হাল এই দুই ব্যক্তির মতোই। যে অবিভাবকের অর্থের পরিমাণ বেশি তার সন্তান সনামধন্য প্রতিষ্ঠানের পড়ার সুযোগ পান। বিপরীদিকে যারা দিন এনে দিন খান, শ্রমিক, ভ্যান কিংবা অটোরিকশা চালক, গার্মেন্টস শ্রমিক তাদের সন্তান পড়ে গ্রামের অবহেলিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। মাতৃভাষা আন্দোলনের একাত্তর বছর আর দেশ স্বাধীনের বায়ান্ন বছর পার করছি অথচ শিক্ষায় ধনী গরিবের বৈষম্য দূর করতে পারিনি। তবে কি ভাষাসৈনিকরা এই বৈষম্য দূর করার জন্য নিজের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করেননি?
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির বাতিঘর। কারণ দেশভাগের পর পাকিস্তান অপশক্তি প্রথম বাংলা ভাষার উপর আক্রমণ চালায়। রাষ্ট্রভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে করার পায়তারা করলে বাংলার ছাত্র-জনতা প্রতিবাদ শুরু করে, প্রতিরোধ গড়ে তুলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা রাখার দাবিতে দুর্বার আন্দোলন শুরু করে। ফলে অপশক্তির হাত থেকে মাতৃভাষাকে রক্ষা করে। সফল হয় মাতৃভাষা আন্দোলন। এই সফলতা ১৯৬২ সালের শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে দাঁড় হতে সাহস যোগায়, ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে গণজাগরণে জোয়ার ভাসাতে অনুপ্রেরণায় রূপ নেয়, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অপশক্তির হাত থেকে দেশমাতৃকাকে রক্ষার সংগ্রামে বাতিঘর হিসেবে দাঁড়ায় মাতৃভাষা আন্দোলন। দীর্ঘ নয় মাস মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের। দেশ স্বাধীনের পর নব্বই দশকে ‘স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলন’ থেকে শুরু করে ২০১৭ সালে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনসহ সমস্ত যৌক্তিক আন্দোলনে ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা আন্দোলন এক ও অদ্বিতীয় অনুপ্রেরণার নাম।
অসাম্প্রদায়িক চেতনার অপর নাম একুশে ফেব্রুয়ারি। একুশ মানে ইতিহাস তৈরির প্রারম্ভিক স্থান, একুশ মানে জীবন সংগ্রামী ও বিপ্লবী ধারায় গড়ে তোলা ধারা, একুশ মানে ভাষাসৈনিক রফিক-শফিক-জোব্বারের রক্তে রঞ্জিত রাজপথ, একুশ মানে মুক্তি, একুশ মানে মাতৃভাষা আন্দোলনে হাজারো স্মৃতি জড়িত শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের যথোপযুক্ত সম্মান দিলে হলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ করতে হবে, আদিবাসীদের নিজস্ব ভাষা শিক্ষার অধিকার দিতে হবে, বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দেশ স্বাধীনের এতো বছর পরে এসেও যারা শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেন তাদের শক্ত হাতে দমন করতে হবে। সর্বপরি নতুন প্রজম্মের কাছে মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলা ভাষার ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। তবেই সম্মান করা হবে ভাষাসৈনিকদের, শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হবে ভাষা শহীদদের।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই