Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আড়ালে রয়ে যাওয়া ফুলপরীদের কি হবে?

সুকান্ত দাস
১২ মার্চ ২০২৩ ১৩:৫৯

মানুষ যখন সফল হয় তখন সকল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। যদি সফল না হয় তাহলে তার কথা কেউ মনে রাখে না। ফেব্রুয়ারী মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে রাতে তিন থেকে চার ঘন্টা সময় ধরে অত্যাচার ও নির্যাতন চলে নবীন ছাত্রী ফুলপরীর উপর। গণমাধ্যমের কল্যাণে সেই ঘটনা সকলের সামনে আসে এবং একপর্যায়ে হাইকোর্টের নজরে পড়ে। হাইকোর্টের নির্দেশ মতো তদন্ত হয়। এছাড়া হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের তদন্ত কমিটিও তদন্ত করে৷ তদন্ত শেষে হাইকোর্ট সেই রাতে নির্যাতন কারী পাঁচ শিক্ষার্থীকে অস্থায়ী বহিষ্কার করতে নির্দেশ দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রায়ে খুশি নন, তিনি হয়তো মামলা করবেন। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটুকু স্বস্তি এসেছে যে বিচার হয়েছে। হাজারো বিচারহীন ঘটনার মধ্যে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপে তবুও একটা ঘটনার বিচার হলো।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু প্রতিনিয়ত বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ভাবে নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা তাদের উপর হওয়া অন্যায়ের বিচার পাচ্ছে না। অনেক সময় তো উল্টো ভুক্তভোগীকেই দোষ দেয়া হয়।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েই কয়েকমাস আগে বিভিন্ন সময় কয়েকবার সিনিয়র শিক্ষার্থীরা জুনিয়র শিক্ষার্থীদের কাছে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কোনোটারই বিচার তো পরের বিষয় সুষ্ঠু তদন্তই হয়নি।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ২০২১ সালের অক্টোবরে মাসের একটি ঘটনা বেশ আলোচনার সৃষ্টি করেছিলো। তখন এমবিবিএস দ্বিতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। তার মাথায় সাদা ব্যান্ডেজে লেখা “হাড় নেই, চাপ দেবেন না” ছবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, গত ২২ ফেব্রুয়ারি দলীয় কর্মসূচিতে না যাওয়ায় রাজশাহী কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে ৩০ ছাত্রকে পিটায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এদের মধ্যে দুজন সংবাদকর্মী ছিলেন। ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে যোগ না দেওয়ায় সন্ধ্যার পর থেকে ছাত্রাবাসের কক্ষে কক্ষে গিয়ে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেছেন শিক্ষার্থীরা।

২১ ফেব্রুয়ারী ইডেন কলেজে স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষার্থীকে আহত করে এক ছাত্রলীগ নেত্রী।

এর মধ্যেএকটা হাস্যকর বিষয় ঘটে গেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের পর শিবির বলে চালিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। কৃষ্ণ রায় নামের ওই ছাত্রকে হলকক্ষে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ২০২২ সালে ২০টি ঘটনায় মোট ২৭ জন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে এক সমীক্ষার তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ পরিচালিত ‘স্টুডেন্টস এগেন্সট টর্চার-স্যাট’ নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংগঠন। এর মধ্যে ৪ টি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। (সূত্র-দৈনিক প্রথম আলো)

বিজ্ঞাপন

আমি যখন প্রথম বর্ষে ছিলাম তখন প্রথম দিকে আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবী সবসময় কেমন যেনো ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতো৷ কারণ জিজ্ঞেস করলে একদিন বললো কোনো একজন তথাকথিত নেতা তার সাথে প্রেমের সম্পর্ক করতে চায়। না চাইলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীন শিক্ষার্থী ভর্তি হবার পর এই ঘটনা নিয়ম করে ঘটে। এটা শুধু যে ওই একদুই জনের সাথে হয় তা নয়। অধিকাংশ ছাত্রীর সাথেই ঘটে৷ তাদের মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে এইসব ঘটনা। ফুলপরীর সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা হয়তো সামনে এসেছে কিন্তু এমন হাজারো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে যাচ্ছে যার হদিসও কেউ পায় না।

বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতির এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাসের অন্যতম স্তম্ভ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। দেশের সকল আন্দোলন সংগ্রামে যারা মূখ্য নিয়ামকের ভূমিকা পালন করেছে সবসময়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন পর্যন্ত সময়টা এদেশের ছাত্ররাজনীতির স্বর্ণযুগ। ছাত্ররা তখন সকল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে তা আর দেখা যায় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলো সবসময় দেশের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটা যেনো একটা অলিখিত নিয়ম। আর হল গুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে ছাত্র নেতারা প্রতিষ্ঠা করে একনায়কতন্ত্র। যদিওবা বলা হয় হলের সিট কে পাবে তা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঠিক করে দেয় কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।

যখন বিএনপি সরকারের আমলে ছাত্রদল এবং ছাত্রশিবির প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। সাধারণ ছাত্ররা টু শব্দটি করতে পারতো না। ছাত্র শিবিরের নিয়ন্ত্রণাধীন হল গুলোতে ভিন্ন ধর্মের শিক্ষার্থীদের থাকতে আলাদা টাকা দিতে হতো। অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট করে দিয়েছে তারা। সেইসব অপরাধের বিচারও হয়নি।

বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পর মনে হয়েছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরবে। কিন্তু গত কয়েক মাসের বিভিন্ন ঘটনা ওই ধারণা পরিবর্তন করে দিচ্ছে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত পরিবারের। কারণ বর্তমান সময়ে টাকা থাকলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। নিম্নবিত্ত পরিবারের বাবা মায়েরা তাদের সন্তানকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে। বুকে আশা থাকে তাদের ছেলেমেয়েরা ভালোভাবে পড়াশোনা পূর্ণ করে সংসারের হাল ধরবে। পরিবারের দুঃখের দিন শেষ হবে।ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফুলপরীর বাবা ভ্যানচালক। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যাদের বাবা কৃষক, শ্রমিক। তারা অনেক কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সন্তান মানুষ করে। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ চালায় এবং বাড়িতেও টাকা পাঠায়৷ এমন একটা ছেলে বা মেয়েকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যখন মেরে ফেলা হয় বা তার ক্ষতি করা হয় তখন পুরো পরিবারটা শেষ হয়ে যায়।

এমন একটা শিক্ষার্থীর উপর যখন নির্যাতন হয়, কিংবা তাদের থেকে টাকা কেড়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে এটা অপরাধের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়৷ আর এই কাজ করার পর অপরাধীদের যারা প্রশ্রয় দেয় তারা আরও বড় অপরাধী।

বিশ্বের উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে এমন ছাত্র রাজনীতি নাই। সেখানে শিক্ষার্থীরা নিজের মতো করে পড়াশোনা করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে মূল প্রতিবন্ধকতা গুলোর মধ্যে এই গুলো অন্যতম।

আমাদের ফুলপরী অসম্ভব সাহসের পরিচয় দিয়েছে। ওর সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু এমন হাজারো ফুলপরীর সাথে অন্যায় হচ্ছে৷ তারা হয়তো সাহস করে সামনে আসতে পারছে না। শিক্ষার্থীরা জাতির ভবিষ্যত। তাই সরকারের উচিত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে অপরাজনীতি কারীদের এবং তাদের প্রশ্রয় কারী দের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া। আড়ালে থাকা হাজারো ফুলপরীর উপর যেনো নির্যাতন না হয় সেই ব্যবস্থা করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

সারাবাংলা/এসবিডিই

আড়ালে রয়ে যাওয়া ফুলপরীদের কি হবে? মুক্তমত সুকান্ত দাস

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর