স্বাধীনতা নিয়ে কটাক্ষ, বাসন্তী ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি
২ এপ্রিল ২০২৩ ১৭:৩২
গণমাধ্যম হলো সমাজের দর্পণ ও রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর সাংবাদিকেরা হলেন জাতির জাগ্রত বিবেক। দলীয় মতাদর্শে কোনো সংবাদপত্রই নিরপেক্ষ নয়। আর সাংবাদিকরা যেহেতু এই সমাজেরই একটি অংশ তাদেরও শতভাগ নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নয়। তবে দল ও মতের উর্ধ্বে উঠে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করা সত্য ও নির্ভীক সাংবাদিকের প্রধান দায়িত্ব। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর সুবিধা তৈরি করে দেওয়া প্রকৃত সাংবাদিকের কাজ নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো প্রতিটি গণমাধ্যমের অবশ্য কর্তব্য।
২৬ মার্চ বাঙালির গৌরব ও অহংকারের দিন। আর সেদিন প্রথম আলো পত্রিকাটি যে কাজটি করেছে তা রীতিমতো অন্যায়। স্মৃতিসৌধের গেটে সাত বছর বয়সী সবুজ নামে ফুল বিক্রেতা একটি ছেলের ছবিসহ উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়ে কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ প্রথম আলো বলেছে ছেলেটি দিনমজুর জাকির। অনুসন্ধানে বের হয়েছে, ছেলেটির নাম সবুজ, স্মৃতিসৌধের গেটে মাঝে মাঝে ফুল বিক্রি করে। অন্য এক সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে সে জানিয়েছে, এক বড় ভাই ১০ টাকা দিয়ে আমার একটা ছবি তুলেছে। আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি, আমিও কিছু বলিনি। এই শিশু সাথে এ ধরণের আচরণ শুধুমাত্র অন্যায়ই নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বৈশ্বিক কারণে দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগামী। জনগণকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে এটা সত্য, অস্বীকার করার উপায় নেই। তারপরও সরকারের সঠিক পদক্ষেপে দেশ একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে। প্রথম আলো আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে গিয়ে মুলত দুইটি অপরাধ করেছে। প্রথমত, দ্রব্যমূল্যের সাথে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে মিলিয়ে স্বাধীনতার অর্জনকে খাটো করেছে। দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে সাত বছরের একটি অবুঝ শিশুকে ভিকটিম করা হয়েছে। পত্রিকাটি আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে যেভাবে স্বাধীনতা দিবসকে বেছে নিয়েছে, সেটা কোনো বিবেকবান মানুষই সমর্থন করতে পারে না। এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা না, সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ১৯৭৪ সালে এইভাবেই দেশকে অস্থিতিশীল তৈরি করতে কুড়িগ্রাম বাসন্তী নামের একটি প্রতিবন্ধী মেয়েকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তার শরীরে জাল পরিয়ে নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছিল।
প্রথম আলোর এইভাবে উস্কানি দিয়ে অস্থিতিশীল করার উদ্যোগ এটাই প্রথম নয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়েছিল প্রথম আলো। যেখানে দেখানো হয়েছিল সারিবদ্ধভাবে হিন্দু নারীরা একটি ভোট কেন্দ্রে ভোট দিচ্ছে। ছবিতে নারীদের কপালে লাল টিপ ও সিঁদুর ফটোশপ করে অনলাইনে ছেড়ে দিয়ে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ভোটকেন্দ্রে বেশিরভাগ ভোটার ছিল হিন্দু। ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। সাম্প্রদায়িক উস্কানির কারণে কয়েক ঘন্টার মধ্যে যশোর, দিনাজপুরসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বিএনপি জামায়াত কর্তৃক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। সেসব হামলার জন্য তো ওই পত্রিকার সম্পাদক দায় এড়াতে পারেন না।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার বদান্যতায় ১৯৯৮ সালে প্রথম আলো ছাড়পত্র পেলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আওয়ামী লীগ বিরোধী পত্রিকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। শুরু থেকে পত্রিকাটি রাজনীতিতে বিভ্রান্ত ছড়ানো, সুপরিকল্পিতভাবে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন করা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হয়ে বিরাজনীতিকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৭ সালে একবার সফলও হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে মাইনাস টু ফর্মুলার প্রবক্তা ছিলেন জনাব মতিউর রহমান। ২০০৭ সালের ১১ জুন নিজের লেখা ‘দুই নেত্রীকে সরে দাঁড়াতে হবে’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি পত্রিকার লিড নিউজ করেছিলেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নামে দুর্নীতির কল্পকাহিনী তৈরি করে গ্রেফতারের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল পত্রিকাটি। জনগণ দেশরত্ন শেখ হাসিনার সাথে ছিল বলে ওয়ান-ইলেভেন সরকার চুড়ান্ত সফলতা অর্জন করতে পারেনি। পরবর্তীতে এটিএন নিউজে এক সাক্ষাৎকারে আরেক কুশীলব ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম তো স্বীকার করে নিয়েছে, সেদিনের রিপোর্টগুলো ভুল ছিল। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা রিপোর্টগুলো করেছিল। যেটি ছিল সাংবাদিকতার নীতি বহির্ভূত। এতদিন পর ভুল স্বীকার করলেই তো সব ঠিক হয়ে যায় না, যা ক্ষতি হওয়ায় তা তো হয়েই গেছে। ওয়ান ইলেভেনের সময় এরাই দুই নেত্রীকে মাইনাস করতে আদাজল খেয়ে নেমেছিল। ড. ইউনুসকে দল গঠনে ইন্ধন যুগিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে রাখতে ডেইলি স্টারের সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ফাহিম মোনায়েমকে বিশেষ এসাইনমেন্ট দিয়ে তখনকার সরকারপ্রধান ফখরুদ্দিন আহমেদের প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে পাঠানো হয়েছিল।
২০১১ সালে পদ্মাসেতু নির্মানে বিশ্বব্যাংকের সাথে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। পদ্মাসেতুর অর্থায়ন বন্ধে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে বেশ সরব হয়ে উঠে পত্রিকা দুটি। তথাকথিত দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক মিথ্যা বানোয়াট রিপোর্ট প্রকাশ করে। ড. ইউনুসের সাথে তো একজন সম্পাদক স্টেটস ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত তদবিরে গিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ২০ জুন ‘১০% ঘুষ চান মন্ত্রী-সচিব’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। পরের দিন ২১ জুন ‘Padma bridge bribe was ready for 6’ শিরোনামে ডেইলি স্টারে রিপোর্ট করে। এবং ১১ অক্টোবর তো প্রথম আলো বলেই দিলো ‘পদ্মা সেতু হচ্ছে না!’ এ বিষয়ে ২০১২ সালের ২৩ জুন প্রেসক্লাবের একটি অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত স্পষ্ট করে বলেছেন, আপনারা অনেক নামটাম শুনছেন- এটা হচ্ছে চরিত্রহনন। আমাদের প্রথিতযশা পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার চরিত্রহননে মত্ত আছে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারংবার বলেছেন তিনি প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার পড়েন না। ২০১৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি এই পত্রিকা দু’টি পত্রিকা সম্পর্কে আরও বলেন, ‘দুইটি পত্রিকায়(প্রথম আলো, ডেইলি স্টার) ২০টি বছর ধরে আমার বিরুদ্ধে লেখা হচ্ছে। কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর থেকে এই দু’টি পত্রিকা আমি পড়ি না। ভালো কিছু লিখলেও শেষ দিকে আমাকে একটা খোঁচা দিবে। এ খোঁচা খেয়ে আমি আত্মবিশ্বাস হারাব। তবে পড়বো কেন? প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে লেখা থাকে নির্ভীক সাংবাদিকতা। কিন্তু তারা আলোর কথা বলে অন্ধকারের কাজ করে। আমাকে দুর্নীতিবাজ বানাতে ওই দুটি পত্রিকা একের পর এক মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীকে অনুসরণ করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা কি এই পত্রিকা দু’টি কি বর্জন করতে পেরেছে?
প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার এদেশের সুশীলদের মুখপাত্র। আগামী নির্বাচনকে টার্গেট করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে আরও অনেক খেলা খেলবে। তাদের টার্গেট রাজনীতিকে বিরাজনীতিকরণের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে মাইনাস করা। সবাইকে এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। বাসন্তী ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি শুরু হয়ে গেছে, ঐক্যবদ্ধভাবে এই অশুভ শক্তিদের পরাজিত করতে হবে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
তাপস হালদার মুক্তমত স্বাধীনতা নিয়ে কটাক্ষ- বাসন্তী ষড়যন্ত্রের পুনরাবৃত্তি