দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে?
১৫ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:৩৮
দেশের অনক্ষর-অনাহারী মানুষদের মুখনিঃসৃত মেঠো বাণী নয়, বরং মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের মুখেও দ্রব্যমূল্যের কথা লাগামহীনভাবে শোনা যায়। দেশের অবস্থার ব্যাপারে আমার সবাই জানি। দ্রব্যমূল্যের নৈরাজ্য ব্যবসায়ীদের দখলে। দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ প্রতিটা ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ওঠা জীবনে তাই বাণী আসা স্বাভাবিক বটে। তবে অতীতে যে রকম বাণী শুনে মানুষ অভ্যস্ত, এবার তাতে কিছুটা নতুনত্ব দেখা মিলছে। দাম আগের তুলনায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ঢাকা, চট্টাগ্রাম, হাতিরঝিল, বড় বড় সব শহরকে লস অ্যাঞ্জেলেস মনে হয় এখন। মনে হয় প্যারিস শহরের অংশ দেখছি। ফ্লাইওভার, ফুটপাত দেখলে মনে হয় এটি কোনো সিনেমার অংশ। সেখানেও আকাশ ছোয়া দাম। ইউক্রেনের যুদ্ধ কবলিত বিষয়কে সামনে রেখে
দ্রব্যমূল্য ইউরোপ, আমেরিকার চেয়ে কম বেড়েছে তবে এশিয়ার একটি মাত্র দেশ বাংলাদেশে আগের চেয়ে দ্বিগুন দাম বাড়ানো হয়েছে।বাংলাদেশে আগে দাবি করা হতো শ্রমিকের মজুরি হতে হবে সাড়ে তিন কেজি চালের মূল্যের সমান। এখন একজন শ্রমিক কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ কেজি চালের মূল্যের সমান মজুরি পায়। তাই বলা যায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। একথা অনস্বীকার্য যে, বিশ্বব্যাপী পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষণীয়। তবে সারা বিশ্বে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটলেও স্থিতিশীল পরিবেশে আবার তা কমেও যায়। কিন্তু আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য একবার বাড়লে তা আর কোনো বিবেচনায়ই কমে না। সাধারণ মানুষ আন্দোলন সংগ্রাম করলে যুক্তি দিয়ে তাকে তা সমর্থন করানোর চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে এটা কেউ অস্বীকার করবে না। কারণ সবার আয় বেড়েছে। তবে একজন শ্রমিক সারা দিনে যে মজুরি পায় তা দিয়ে সে তার প্রয়োজনীয় মৌলিক চাহিদার কত অংশ পূরণ করতে সক্ষম হয় সেটা ভাবনার বিষয়। পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরণ করার পর তার কাছে বাকি কী থাকে? চাহিদার বিপরীতে যে পরিবারের সদস্যরা পায় সেই খাদ্য সুষম কিনা তাও বিচার্য।
এক সময় বলা হতো শ্রমিকের মজুরির ৬০ থেকে ৬৬ শতাংশই খাদ্য সংগ্রহে ব্যয় হয়ে যায়। বিশ্বাস করি এখন নতুন কোনো সমীক্ষা পরিচালিত হলে এই শতাংশের হার আরো বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করছি। তারপরও যদি ধরে নেওয়া হয় এখনো ৬৬ শতাংশই খাদ্যের পেছনে খরচ হয় তবে প্রশ্ন করা যায় বাকি ৩৪ কিংবা ৪০ শতাংশ অর্থ দিয়ে মৌলিক চাহিদার কত শতাংশ পূরণ করা সম্ভব? তাই মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে বলে আস্ফালন করার কোনো পরিবেশ এখনো দেশে সৃষ্টি হয়নি। অথচ দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ কার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তা এখনো সাধারণ মানুষ জানে না।
দায়িত্বসংশ্লিষ্টরা সকলেই শুধু নিজেদের মতো করে বাণী দিয়ে যায়। দেশে পণ্যের কোনো সংকট নেই, প্রয়োজনীয় মজুদ আছে। বাজারে মূল্যের চাইতে ১০-২০ টাকা বেশি মূল্য নির্ধারণ করে ব্যবসায়ীদের ধমক দেওয়া হয়ে থাকে এর চেয়ে বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রি করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরের দিন সকালেই ওই পণ্য আরো ১০-২০ টাকা বৃদ্ধি করে বিক্রি হতে দেখা যায়। কয়েক দিন পর আবার নতুন করে ধমক শোনা যায় এবং নতুন করে মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। তাই সাধারণ মানুষ ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্যমূল্যের সংগতি খুঁজে পায় না। কী হবে এই ১০ টাকার চাউল দেয়ার বাণী দিয়ে? গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বাররা তাদের দলের লোকদের বেছে বেছে চাল দেয়, আসল দরিদ্ররা সেখান থেকেও বঞ্চিত। তাহলে কোথায় গেলে তারা ১০ টাকার চাল নিতে পারবে? এরকম বিষয় তদারকিতে নজর কাড়লে কয়কেজনকে ফেইসবুকে ছবি বন্ধি করে পোস্ট দেয়, এটাই কি শেষ? এর শেষ কোথায় তবে?
কিছুদিন আগের বাণী শুনছি দেশের অর্থনীতি এখন কানাডার সমান। এই বাণীর ভিত্তি কী তা সাধারণ জনগণ জানে না। তবে আমাদের অর্থনীতি বলতে যদি ক্ষমতার বলয়ের মানুষদের কথা বোঝানো হয়ে থাকে তাহলে তা বাণীর যথার্থতাকেই প্রমাণ করে। যেমন ধরেন, আমাদের একজন শিক্ষক গড় আয় বোঝাতে মনজুর সাহেব দিনে এক লক্ষ টাকা আয় করেন আর আমি দিনে এক টাকা আয় করি তাহলে আমাদের গড় আয় ৫০ হাজার ৫০ পয়সা প্রতিদিন। এতে মনজুর সাহেবের কোনো ক্ষতি নেই কিন্তু আমি প্রচণ্ড খুশি যে আমার একদিনের আয় ৫০ হাজার টাকার বেশি। এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। দেশের মানুষের গড় আয়ের হিসাব দেখে এই শিক্ষককে সর্বদাই স্মরণ হয়।মার্কিন এক ডলার সমান বাংলাদেশের ১০৭ টাকা হলেও মার্কিনিদের কাছে তাদের দেশের এক ডলার মানে এক টাকা। অনুরূপভাবে অন্য সব দেশেও তাই। এক্ষেত্রে একজন বাংলাদেশি যদি অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করেন এবং বাজারে পণ্য কিনতে গিয়ে যদি ডলারের সঙ্গে বাংলাদেশি মুদ্রার বিনিময় হার হিসাব করেন তবে মাথা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের দেশের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের এক মাসের অর্থে অস্ট্রেলিয়ায় এক কেজি বেগুন ক্রয় সম্ভব। সেই দেশে যদি ইউরোপ আমেরিকার মতো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চিন্তাকে উদ্ভট বলা হয় তাহলে তাকে কি অন্যায় চিন্তার ধারক বলা যাবে না?
কয়েক দিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ব্যক্তি পোস্ট দিয়েছেন ‘২০ টাকার চাল খাচ্ছি ৮৫ টাকায়, ৭০ টাকার সয়াবিন ২১০ টাকায়, ২০০ টাকার গরুর মাংস খাচ্ছি ৭৫০ টাকায়, ৩ টাকার ইউরিয়া সার কিনছি ৪০-৫০ টাকায়।’ এসবের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগণ একটা না একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সংক্রান্ত নাটক দেখে থাকে। যেমন গত বছর পেঁয়াজের নাটক হলো। জোটবদ্ধভাবে সবাই বাণী প্রচারে নিবেদিত হয়ে পড়ল, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে আছে। দ্রব্যের কোনো সংকট নেই, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’ আর এবার তো ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে দাম কম বেড়েছে বলেই মহামানবেরা ক্ষান্ত হননি, নতুন ভাবনায় বাণী দিয়েছেন ‘দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে উসকানি দিচ্ছে বিরোধীদল।’ প্রত্যেকটা রসিকতারই একটা সীমা পরিসীমা আছে। আমাদের জনপ্রতিনিধিরা ক্ষমতার দম্ভে পরিবেশ পরিস্থিতিতে বিবেচনা ভুলে গিয়েছেন। বর্তমান সময়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় পড়ে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষদের যে জীবন সংগ্রাম চলছে তা বোঝার ন্যূনতম মানসিক অবস্থায় জনপ্রতিনিধিরা আছে বলে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। চারদিকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির জয়জয়কার। দুর্বল লাঞ্ছিত হবে, হতে থাকবে আর আমরা উন্নতি করতেই থাকব। নিতান্ত অল্প কিছু মানুষের উন্নতি বাকি মানুষদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের চরম দুর্দশার প্রেতাত্মারা আজ ভীষণভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আর জীবিতদের জীবনকে নির্জীব করে রাখার উপায় হিসেবে চলছে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতা।
দেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় প্রাণপাত করা সফল ব্যক্তিদের রসিকতা করার প্রতিষ্ঠিত অধিকার থেকেই বাণী আসছে। দেশ ও মানব প্রেম, সাধারণ মানুষের অবস্থা ও অবস্থান, দায়িত্ব ও কর্তব্য, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা, বিষয়ের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা, পরিবেশ ও পরিস্থিতি এখানে একেবারেই বিবেচ্য নয়।এই বিরামহীন অবিবেচ্য বিষয় থেকে আমার জনসাধারণ মুক্তি চাই। দ্রব্যমূল্যের সিন্ডিকেটের বিষয়ে বড় মহলের কর্মকর্তাদের মাঠ পর্যায়ে তীব্র ভূমিকা চাই।
লেখক: শিক্ষার্থী, ওমরগণি এম.ই.এস কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এজেডএস
তারেক আল মুনতাছির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে