বিএনপির নির্বাচন বর্জন উচিত হবে না
২৪ মে ২০২৩ ১৩:৫৬
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এ নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই মেরুতে অবস্থান দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির)। এক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়কেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। তবে তাদের এ দাবিকে পাত্তাই দিচ্ছেন না ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। সাম্প্রতিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক স্বাক্ষাতকারে বলেছেন, জাতীয় সংসদে যারা সংসদ সদস্য আছেন, তারা কেউ যদি নির্বাচনকালীন সরকারে আসতে চান আমি নিতে রাজি আছি। এর আগে আমরা তাদের নিয়েছি। ২০১৪ সালে তো আমি খালেদা জিয়াকেও আহ্বান করেছি তারা তো আসেনি। তাছাড়া তারা তো এখন সংসদেও নেই। সুতরাং সেটা নিয়ে আর চিন্তাও নেই। কাজেই সংবিধান অমান্য করে সংবিধানের বাহিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সংবিধানের আলোকেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশের গঠনতন্ত্র মেনেই সরকারের এ সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই। তেমনি অযৌক্তিক বলার সুযোগ নেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিএনপির আন্দোলনকেও। কেননা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হয়নি তা সকলের দেখা।দেশি-বিদেশি বিতর্ক রয়েছে নির্বাচন দুটিকে কেন্দ্র করে। এমন বাস্তবতায় বিএনপির এ দাবি অনর্থক নয়। দুই দলের দুই মেরুতে অবস্থান একটি রাজনৈতিক সংকট। আর এই সংকট নিরসনে দরকার দুই দলের রাজনৈতিক সংলাপ। এর পাশাপাশি দুই দলকেই ছাড় দেওয়ার মনোভাব পোষণ করতে হবে। অন্যথায় এই সংকটের সমাধান না হলে দুই দলসহ দেশের অপূরনীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
সরকার যদি তার সিদ্ধান্তেই অটুট থাকে তাহলে সরকারের উপর বিদেশিদের চাপ আরও বাড়তে পারে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গণতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ইস্যু করা হলেও মূলত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র চাইলে সরকার পরিবর্তন করতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে গত ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র ‘গুরুতর’ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও তৎকালীন পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদসহ বাহিনীর সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এই স্যাংশনস কাটতে না কাটতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আরো একটি বড় স্যাংশনস বা নিষেধাজ্ঞা আসছে- সম্প্রতি এমন একটি খবর প্রচারিত হয়েছে দেশে-বিদেশে। এই খবরে সরকার অখুশি। এমনকি দেশপ্রেমিক যে কেউ চাইবেন না যে মাতৃভূমির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নিষেধাজ্ঞা আসুক। আর যদি নিষেধাজ্ঞা দেওয়াই হয় তাহলে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধাঁগ্রস্ত হবে। সেই সাথে সরকারও বেকায়দায় পড়বে।
অন্যদিকে বিএনপি বলছে এ সরকারের অধীনে নির্বাচন করবে না। তবে আমি মনে করি, বিএনপি যদি ২০১৪ সালের মতো নির্বাচন বর্জন করে তাহলে দল হিসেবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেবে। জ্ঞান হবার পর থেকে ২০১৪ সালের নির্বাচনটাই আমার দেখা প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনের আগে অর্থাৎ ২০১৩ সালে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে হরতালের মতো কঠোর আন্দোলন করে দলটি। আমার দেখা সবচেয়ে কঠোর আন্দোলনের বছর সেটি। একই বছরের ৫ মে শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের কঠোর আন্দোলন তো আছেই। এত কিছুর পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করতে পারেনি বিএনপি। পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষনা দেন দলটি। কিন্তু যথাসময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও প্রতিহত করতে পারেনি। কাজেই ক্ষমতার আসনে বসতে কোন প্রকার বেগ পেতে হয়নি আওয়ামী লীগের। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার করা হয় বিএনপির প্রধান নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে না যাওয়ার ভুল অনুশোচনা করতে পেরে তাদের নেত্রীকে কারাগারে রেখেই নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। কিন্তু ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন ২৯ তারিখ রাতে হওয়ায় এই নির্বাচনেও সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে।
জানতে পারলাম, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নাকি বিএনপি অংশ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তে অনড়। যদি এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যই আগায় তাহলে এবারও ভুল করবে। কারণ নির্বাচন বর্জন কোন সমাধান নয়। নির্বাচন ছাড়া তো আর সরকার পরিবর্তন হয় না, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই নির্বাচন। বিরোধী দলকে বর্জনের নীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বর্জন দিয়ে যে কিছু অর্জন করা যায় না, ২০১৪ সালের নির্বাচন তার প্রমাণ। তাদের মনে রাখতে হবে, বাইরের কেউ এসে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না। জনগণের রায় নিয়েই ক্ষমতায় যেতে হবে। জনগণ ভোট দিতে না পারলে আন্দোলন গড়ে উঠবে, মানুষ মাঠে নামবে। কিন্তু ভোট বর্জন করলে সেটি হবে না।
যেমন ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়া বিএনপি’র ভুল হয়নি। এই নির্বাচনের পর কিন্তু বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেক শক্তিশালী হয়েছে, ২০১৪ এর নির্বাচনে যা সম্ভব হয়নি। জনগণ বিএনপি’র কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণেই লাখো মানুষের সমাগমে বিএনপি গণসমাবেশ করতে পেরেছে। সভা-সমাবেশগুলোতে উপস্থিতি দিন দিন বেড়েছে। আবার দলীয় নেতা-কর্মীর বাইরে সমাবেশস্থলে সাধারণ মানুষের উপস্থিতিও দেখা গিয়েছে। বিশেষ করে, শহরকেন্দ্রিক সমাবেশগুলোতে রিকশাচালক থেকে শুরু করে সমাজের নিম্নস্তরের লোকজনের উপস্থিতি ছিল।যা পূর্বে আর দেখিনি। যা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এটি বিএনপি’র এক অন্যতম অর্জন। বিএনপি যদি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন না করে নির্বাচনে অংশ নিতো তাহলে হয়তো জনগণের আন্দোলন অনেক আগেই গড়ে উঠতো এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন আমাদের দেখতে হতো না। তাই বর্জন নয়, বরং আন্দোলনের তীব্রতার উপর নির্ভর করবে বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই