পার্বত্য চট্টগ্রামে মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বাধা
২৮ মে ২০২৩ ১৫:১১
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) অঞ্চল স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এবং পানি ও স্যানিটেশন সুবিধাগুলোতে প্রবেশাধিকারের সূচকগুলোতে নিম্ন উন্নয়ন সূচকগুলির জন্য পরিচিত। এই প্রেক্ষাপটে এই জনপদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারী ও কিশোরীরা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের বাধার সম্মুখীন হয়, যা নারী ও মেয়েদের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও উন্নয়নকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এক্ষেত্রে মাসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং শিক্ষার অভাব অন্যতম প্রধান বাধা। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক নারী ও মেয়েকে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষা ও সেবা গ্রহণের সুযোগগুলোও অবারিত নয়। তাদের প্রায়ই সঠিক মাসিক স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন, মাসিকের সময় স্বাস্থ্যসম্মত উপকরণ এবং মাসিককালীন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।কিন্তু তাদের এ সম্পর্কিত সঠিক করণীয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে। আর এ সম্পর্কিত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বাস্থ্যগত সমস্যাগুলোকে আরো বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সর্বোপরি মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সুবিধার অভাব পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে স্বাভাবিক ও নিরাপদভাবে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বাধা। নারী এবং মেয়েরা প্রায়ই এই অঞ্চলে পরিষ্কার টয়লেট, নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশনে প্রবেশাধিকারের অভাববোধ করে। এটি তাদের জীবনে উল্লেখযোগ্য অস্বস্তি তৈরি করে, যা নারী এবং মেয়েদের জন্য সঠিকভাবে তাদের মাসিক ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়াকে আরো কষ্টদায়ক ও জটিল তোলে। পাশাপাশি এটি তাদের প্রজনন অংঙ্গে রোগের নানা সংক্রমণকে আরও সংবেদনশীল করে তোলে, যেমন মূত্রনালীর সংক্রমণ, প্রজননতন্ত্রের সংক্রমণ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলি দুর্বল মাসিক স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলনের কারনেই হয়ে থাকে।এই বাধাগুলি ছাড়াও, স্থানীয় প্রচলিত সাংস্কৃতিক অনুশীলন এবং জেন্ডার সম্পর্কিত চর্চিত বৈষম্যমূলক রীতিনীতিগুলি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে মাসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ অভ্যাসগুলোকে জিইয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপ অনুসারে, এই অঞ্চলের মাত্র ৩৭% নারী মাসিকের সময় স্যানিটারি প্যাড ব্যবহার করেন। মাসিকের সময় স্বাস্থ্যবিধি প্রয়োজনীয় উপকরণগুলিতে প্রবেশাধিকারের এই অভাবের ফলে অনেক নারী কাপড় বা অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে, যা সংক্রমণ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতার ঝুঁকি বাড়াতে পারে। অধিকন্তু, সমীক্ষায় দেখা গেছে যে এই অঞ্চলের মাত্র ৪১% পরিবারের উন্নত স্যানিটেশন সুবিধায় প্রবেশাধিকার রয়েছে, যা সমস্যাটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এই পরিসংখ্যানগুলি পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নত মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকরভাবে মাসিক ব্যবস্থাপনার জরুরি প্রয়োজনকে আরো বেশি গুরুত্বসহকারে তুলে ধরে।
অনেক নারী এবং কিশোরীরা মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি পণ্য বা সুবিধাগুলিতে প্রবেশাধিকার করার ক্ষেত্রে নানা অপবাদ এবং বৈষম্যের সম্মুখীন হয়। মাসিক বা ঋতুস্রাব অনেকক্ষেত্রে একটি নিষিদ্ধ বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়, এবং মাসিকের কারণে নারী এবং মেয়েদের প্রায়ই স্কুল বা কাজের মতো নিয়মিত কার্যকলাপ থেকে বাদ থাকতে হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে অপর্যাপ্ত মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার স্বাস্থ্যগত ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। দুর্বল মাসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার ফলে বিভিন্ন প্রজনন এবং মূত্রনালীর সংক্রমণের দিকে ধাবিত করে, যা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যের প্রভাব ফেলে। এই সংক্রমণগুলি প্রদাহ, বন্ধ্যাত্ব এবং অন্যান্য দীর্ঘস্থায়ী অবস্থার কারণ হতে পারে। উপরন্তু, সংক্রমণ এবং অস্বস্তির কারণে নারী ও মেয়েদের দৈনন্দিন কাজে অংশগ্রহণ করাকে কঠিন করে তুলে, ফলে শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুযোগ হাতছাড়া হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রতিবন্ধকতাগুলো জটিল, সংকটময় এবং বহুমুখী। এই বাধাগুলি মোকাবেলা করার জন্য শিক্ষা, সঠিক সুযোগ-সুবিধায় প্রবেশাধিকার এবং নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর মাসিক স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলনের প্রচারের উপর গুরুত্ব দিয়ে একটি সমন্বিত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। নারীদের এবং মেয়েদের সঠিক মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা তাদের দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেইসাথে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) অঞ্চলে মাসিক বা পিরিয়ড সংক্রান্ত অভাব বা দারিদ্র্যতা একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা, যা নারী ও মেয়েদের স্বাস্থ্য ও শারীরিক সার্বিক মঙ্গলকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। মাসিক বা পিরিয়ডকালীণ বিভিন্ন বিষয়ে অভাব কমাতে, ব্যক্তি, এনজিও, সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনেদের দ্বারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথম সুপারিশ হল মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বাড়ানো। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অনেক নারী ও মেয়ের সঠিক মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব রয়েছে। মাসিক স্বাস্থ্য, স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন এবং প্রয়োজনীয় উপকরণ সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান সচেতনতা বাড়াতে এবং মাসিককে ঘিরে কলঙ্ক বা অপবাদ কমাতে সাহায্য করতে পারে। এনজিও, কমিউনিটি বা সম্প্রদায়ের নেতা এবং স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে পরিচালিত শিক্ষামূলক কর্মসূচি তৈরি এবং তথ্য প্রচার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। দ্বিতীয় সুপারিশ হলো, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং উপযুক্ত মাসিক স্বাস্থ্যবিধি উপকরণগুলিতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে স্যানিটারি প্যাড, ট্যাম্পন এবং মাসিক কাপ (মেন্সট্রুয়াল কাপ)ইত্যাদি বেশ ব্যয়বহুল এবং এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই দুঃষ্প্রাপ্য। সরকার এবং এনজিওগুলি এই অঞ্চলের মেয়েদের এবং মহিলাদের বিনামূল্যে বা ভর্তুকিযুক্ত মাসিক স্বাস্থ্যবিধি পণ্য সরবরাহ করে সাহায্য করতে পারে। পাশাপাশি, কমিউনিটি পর্যায়ে মাসিককের উপকরণগুলো তৈরি করার মতো উদ্যোগগুলি উপকরণগুলিতে প্রবেশাধিকার বাড়াতে সহায়ক এবং স্থানীয় নারীদের জন্য অর্থ উপার্জনের সুযোগও বাড়াতে পারে।
উন্নত অবকাঠামো, যেমন নিরাপদ পানি এবং স্যানিটেশন সুবিধাসহ টয়লেট, নারী এবং মেয়েদের প্রয়োজনীয় সুবিধায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারলেই তাদের মাসিকের সময়কালগুলো স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ হবে। মাসিককে ঘিরে থাকা নানা কুসংস্কার এবং ভুল সংস্কৃতিগুলো পরিবর্তন করতে সরকার এবং এনজিওগুলি এই প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলির উন্নতির লক্ষ্যে এবং বজায় রাখার জন্য কাজ করতে পারে। অবশেষে, মাসিক বা ঋতুস্রাবের প্রতি সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো ইতিবাচক করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমিউনিটি পর্যায়ের নেতা, ধর্মীয় নেতা এবং স্থানীয় রাজনীতিবিদরা মাসিককে ঘিরে থাকা ভুল ধারণা ও অনিরাপদ চর্চাগুলো বদলাতে কাজ করতে পারেন।
সর্বোপরি, দুর্বল মাসিক স্বাস্থ্যের ফলে সংক্রমণ, রক্তাল্পতা এবং বিষণ্নতা সহ বিভিন্ন শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে যেখানে স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষার সুযোগ ও প্রবেশাধিকার সীমিত, সেখানে এই সমস্যাগুলি বিশেষভাবে তীব্র ও নাজুক। তাই মাসিকের স্বাস্থ্যের জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ প্রয়োজন, যাতে শুধু স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীই নয় বরং অভিভাবক, শিক্ষক, নীতিনির্ধারক এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও জড়িত থাকবেন। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে পরিষ্কার এবং নিরাপদ মাসিক উপকরণ সামগ্রী প্রদান, মাসিককে ঘিরে থাকার কলঙ্ক বা কুসংস্কার দূর করার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুব নারী ও মেয়েদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা। পরিশেষে, পার্বত্য চট্টগ্রামের যুবতী ও মেয়েদের মর্যাদা ও শারীরিক এবং সার্বিক সুস্থতার জন্য মাসিক স্বাস্থ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ ও পরিপূর্ণ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সেবাসমূহে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য আমাদের অবশ্যই এটিকে জরুরিভাবে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মাসিক বা ঋতুস্রাবকে ঘিরে নীরবতা ও কলঙ্কদেরার সংস্কৃতি ভেঙ্গে যুবতী নারী ও মেয়েদের নিজেদের মাসিক স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতায়নের সময় এখনই। তাদের কাছে ভুল তথ্যের বদলে সঠিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য পৌঁছে দিতে হবে। আশাবাদের বিষয় হলো, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্থিক সহযোগিতায় ‘আমাদের জীবন, আমাদের স্বাস্থ্য, আমাদের ভবিষ্যৎ’শীর্ষক একটি উন্নয়ন কর্মসূচীর আওতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের মাসিক স্বাস্থ্যের অবস্থার এসকল প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করে প্রায় ১২ হাজার যুব নারী ও কিশোরীকে সম্পৃক্ত করে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড ২০১৯ সাল থেকে পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি এই উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় কর্মসূচিটির সাথে সকল যুব নারী ও কিশোরীদেরকে পুনঃব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড তৈরির উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। যার ফলে তারা বাড়িতে বসেই নিজের প্রয়োজনের সময়, নিজেই স্বল্প খরচে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত পুনঃব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড তৈরিতে সক্ষমতা অর্জন করেছেন।
পরিশেষে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অভাব ও বিদ্যমান সমস্যাগুলো হ্রাস করার জন্য, মাসিক স্বাস্থ্য শিক্ষায় প্রবেশাধিকার বাড়ানো, সাশ্রয়ী মূল্যের এবং উপযুক্ত মাসিক স্বাস্থ্য উপকরণ সরবরাহ করা, মাসিক স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগুলো উন্নত করা এবং মাসিককে ঘিরে থাকা সাংস্কৃতিক নিয়মগুলিকেও স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ করা অপরিহার্য। বিভিন্ন অংশীজন যেমন ব্যক্তি, এনজিও, সরকার, গণমাধ্যম এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি এই সুপারিশগুলি বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সম্মিলিতভাবে কাজ করার মাধ্যমেই কেবল আমরা পার্বত্য অঞ্চলের নারী ও কিশোরীদের জন্য স্বাস্থ্যকরভাবে এবং মর্যাদার সাথে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা করার একটি সহায়ক ও সুন্দর পরিবেশ এবং ব্যবহার্য প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রাপ্তি নিশ্চিতে সহায়তা করতে পারি।
লেখক: জনস্বাস্থ্য কর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই
পার্বত্য চট্টগ্রামে মাসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বাধা মুক্তমত সুমিত বণিক