আশার প্রদীপ জ্বলে
২১ জুন ২০২৩ ১৫:১৬
প্রতি বছর জুন মাসের ২০ তারিখে পালন করা হয় বিশ্ব শরণার্থী দিবস। শুরু হয়েছিল ২০০১ সাল থেকে। কী এই দিনটির তাৎপর্য বা কেনই বা এই দিন পালিত হয়— তা সবারই জানা আছে বলে ধারনা করি।
এই দিনটির জন্য প্রতি বছর নতুন প্রতিপাদ্য বিষয় থাকে। শরণার্থী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মতা, মানুষ হিসেবে তাদের আত্মসম্মানবোধ বজায় রাখতে, তাদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে নানা ধরনের প্রচেষ্টা। অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয় এই দিন। এই বছরের জন্য ইউএনএইচসিআর ঘোষিত প্রতিপাদ্য হলো ‘হোপ এওয়ে ফ্রম হোম’। রিফিউজি সপ্তাহের প্রতিপাদ্য হলো ‘কম্পেশন’। ইউএনএইচসিআর জাতীয়সংঘের শরণার্থী বিষয়ক প্রধান সংস্থা।
এসব যখন লিখছি তখন সারা পৃথিবীতে শরণার্থীর সংখ্যা ৩ কোটি ৫৩ লাখ (৩৫.৩ মিলিয়ন)। তাদের মধ্যে ৪১ শতাংশ শিশু-কিশোর। আরও আছে ছয় কোটির বেশি (৬২.৫ মিলিয়ন) নিজের দেশের মধ্যে উদ্বাস্তু। উল্লেখ্য, এদের মধ্যে জামালপুর, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ, ভোলা, রৌমারী, চিলমারী অঞ্চলের নদীভাঙ্গা বা যশোর সাতক্ষীরা, পাইকগাছা, কামার খালী সুতারখালী এলাকার মানুষরাও আছেন।
রাজনৈতিক এসাইলাম চাচ্ছেন ৫০ লাখ মানুষ আর আরও ৫০ লাখ কোনো ডেফিনেশনের মধ্যে পড়েন না। কিন্তু অন্য দেশে আশ্রয়প্রার্থী এবং তাদের মধ্যে লাখের উপরে বাংলাদেশি আছেন। ২০২৩ সালের জুনের ১৬ তারিখ পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী সাড়ে চার লাখের মতো মানুষ দেশহীন বা স্টেটলেস, তাদের মাঝে আছেন মূলত ফিলিস্তিনি জনগণ। রোহিঙ্গারা এখনো শরণার্থী হিসাবে গণ্য, যদিও মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করেছে বহু আগেই।
এসব ডেফিনেশনের মানুষদের সংখ্যার একটা বড় অংশ, আনুমানিক ৫০ শতাংশের বেশি ১৮ বছরের নিচে। আর এই ৫০ শতাংশের প্রায় ৫০ শতাংশ বালিকা, কিশোরী।
এই সংখ্যা প্রতি বছর বেড়েই চলে। আমার মতো ক্ষমতাহীন ভাড়াটে সৈনিক বা মার্সেনারির লেখা না লেখায় কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি আসলে হয় না। তাও লিখি, লিখি নিজের অপরাধবোধ, বেদনাবোধ হালকা করার জন্য।
এই যে এবারের প্রতিপাদ্য হোপ এওয়ে ফ্রম হোম, দেশে দেশে শরণার্থী বা অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ করে শিশু কিশোর তরুণদের জন্য আশার বাতি জ্বালিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি একটা দায়িত্ব। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে, স্বল্প আর মধ্য আয়ের দেশগুলোই বিশেষত গ্লোবাল জিডিপির মাত্র ১.৩ শতাংশ সেই সব দেশগুলো মোট রিফিউজির ৪০ শতাংশ বা এর বেশি আশ্রয় দিয়েছে। পৃথিবীর মোট শরণার্থীর এক তৃতীয়াংশের বেশি রিফিউজি তুরস্ক, পাকিস্তান আর কলম্বিয়াতে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েছে। উন্নত আয়ের দেশগুলো, যাদের জায়গা আর ফ্যাসিলিটির অভাব নেই, তারা মাত্র ১৭ শতাংশ রিফিউজিকে আশ্রয় দিয়েছে। ইউরোপের মধ্যে জার্মানি একমাত্র দেশ যারা প্রথম দশটি রিফিউজি হোস্টিং দেশের মধ্যে আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সাবেক ট্রাম্প প্রশাসন রিফিউজি সেটলমেন্ট কর্মসূচি ব্যাপকভাবে কমিয়ে ফেলেছিল। তারা প্রায় ৮০ শতাংশ কর্তন করে। বর্তমান মার্কিন সরকার রিফিউজি সেটলমেন্ট কর্মসূচি বাড়াতে চেষ্টা করছেন কিন্তু আগের সরকারের তৈরি করা মেক্সিকো বর্ডার ইস্যু এসাইলাম প্রার্থীর সংখ্যা বরং বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণে।
২০২০ সালে ব্রিটেন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন যৌথভাবে ৩০,০০০ রিফিউজিকে রিসেটলমেন্টের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও এ পর্যন্ত মাত্র দশ হাজারের মতো শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে শরণার্থী আশ্রয়ের বিষয়টি ক্রমে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলছে। রিফিউজি ক্রাইসিসের ন্যারেটিভ বদলে যাচ্ছে।
টিভি নিউজে আমরা সবাই দেখেছি সীমান্তগুলোতে কি নৃশংসভাবে শরণার্থীদের আটকে দেওয়া হচ্ছে। কেবল ২০২০ সালেই পাঁচ মাসের মধ্যে ইইউ দেশগুলোর বিভিন্ন সীমান্তে দুই হাজার শরণার্থীর মৃত্যুর রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছিল। তাদের মধ্যে রাবারের ডিঙ্গি করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন অনেকজন। এই এক জীবনে কী দুই বছরের শিশু আইলান কুর্দির উপুড় হয়ে ভেসে থাকা মৃতদেহের কথা কেউ ভুলতে পারবে? সিরিয়া থেকে তুরস্ক হয়ে উন্নত জীবনের আশায় আইলানের পরিবার ইউরোপে আসতে চেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৯ সালে আট লাখের মতো ছিল, এখন তা বেড়ে দশ লাখ। আমার নিজের দেশে দরিদ্র সীমার নিচে বাস করা মানুষদের জন্যই তো আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখা কঠিন এক কাজ। বাংলাদেশে তরুণদের একটা বড় অংশ কর্মহীন। অনেকেই তর্ক তুলতে পারেন, রোহিঙ্গা রিফিউজি রেসপন্সে তো বিদেশি সাহায্য আসছে। হ্যাঁ, আসছে বিদেশি অনুদান কিন্তু সরকারের নিজের তহবিল থেকেও একটা বিরাট অংকের অর্থ আর স্কিল্ড হিউম্যান রিসোর্স এই দশ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ক্যাম্প এবং নিরাপত্তা বিধানে খরচ হচ্ছে। সেই হিসাব আমরা তো রাখতে চাই না। সরকারের সমালোচনা করা সব চেয়ে সহজ কাজ, সরকারে প্রশংসা করা বেশ কঠিন।
সরাসরি শরণার্থী বিষয়ক কাজ করছি না বেশ কয়েক মাস হলো। কিন্তু এক যুগের বেশি সময় বিভিন্ন দেশে শরণার্থী সহায়তা কাজই তো করেছি। দেখেছি নিজের চোখে কী অসহায় হতাশায় ভুগে শরণার্থী তরুণরা। একটুখানি সুযোগ পেলে তারা অনেক কিছু করতে পারে। শরণার্থী মানেই তো কেবল খাবার আর আশ্রয় নয়। শরণার্থীরা আমাদের মতো স্বাভাবিক সাধারণ মানুষ। তারাও স্বপ্ন দেখেন আলোকিত জীবনের, সেই স্বপ্নকে সত্যি করার জন্য আমাদের সাহায্য তাদের দরকার। সেই এক স্বপ্ন সত্যি হওয়ার গল্প আজ বলব।
কেনিয়া আর উগান্ডায় দক্ষিণ সুদানি শরণার্থী শিবিরে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের জন্য কী আকুতি। ডেনমার্ক আর সুইডেনের আফগান রিফিউজি কলোনিতে কথা বলেছি তরুণদের সঙ্গে। তারা সবাই যেকোনো ধরনের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চান, অন্যের দয়ায় বসে খেতে বড় লাগে তাদের আত্মসম্মানে। যদিও সাধারণভাবে রিফিউজি শব্দটি শুনলেই একটা সম্মানহীন, কেবল পেটসর্বস্ব জীব মনে হয়, অথবা টেররিস্ট বা ড্রাগসে আসক্ত। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হবেন বলে আশায় বুক বেঁধে শ্রীলঙ্কান তামিল রিফিউজি শিভা আমাকে বলেছিলেন, রিফিউজি তো কেবল মুখ আর পেট নয়, রিফিউজি কোনো পরিচয়ও নয়, এটা একজন মানুষের অবস্থা আর অবস্থানগত স্ট্যাটাস মাত্র। রিফিউজি মানুষের স্বপ্ন আছে, আছে মেধা আর হৃদয়।
ফিরে যাই আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখবার কথায়। আমার তৎকালীন প্রতিষ্ঠান আফ্রিকার অনেক দেশে শিক্ষা বিস্তারের জন্য ব্যাপক কার্যক্রম করে থাকে। দক্ষিণ সুদান বর্ডার ঘেঁষে উগান্ডার আরুয়া জেলা। সেখানে বিভিন্ন জায়গায় রিফিউজি সেটেলমেন্টে প্রায় দশ লাখ সাউথ সুদানিজ শরণার্থীর বসবাস। সাউথ সুদানের গৃহযুদ্ধ জাতিগত বিভেদের কারণে। সব থেকে বড় রিফিউজি সেটলমেন্ট বিডিবিডি আরুয়াতে অবস্থিত।
আরুয়া জেলার রাইনোক্যাম্প শিবিরে শরণার্থী কিশোর কিশোরীদের সঙ্গে আলাপ করছিলাম জীবনে কি করতে চায় তারা তা জানতে। কলকল করে তারা তাদের স্বপ্নের কথা জানাল। বেশিরভাগ দেশে ফিরে গিয়ে আবার স্কুলে যেতে চায়, যুদ্ধ ভালো লাগে না মোটেও। শরণার্থী শিবির আরও পচা লাগে তাদের কাছে। মূলত, পশুপালক আর কৃষিজীবী পরিবার থেকে আসা, বিশাল প্রান্তরে দৌড়াদৌড়ি করেছে তারা। এখানে ভালো না। শান্তি হলেই দেশে ফিরবে তারা।
জিজ্ঞেস করলাম, শান্তি মানে কী? হেসে গড়িয়ে পড়ে কজন। এই মুজুংগু ( বিদেশি) শান্তি অর্থ জানে না! শান্তি মানে গরুর পাল নিয়ে প্রান্তরে দাপিয়ে বেড়ান। শান্তি মানে দিনের শেষে গ্রামে ফেরা, উঠোনে আগুন জ্বেলে গোল হয়ে বসে গান করা, শান্তি মানে মায়ের রান্না করা খাবার, দাদির কাছে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়া। শান্তি মানে বন্দুকের গুলির শব্দ নাই, চোখের সামনে বাবা বা চাচাকে কেউ কুপিয়ে মারছে না, শান্তি মানে আগুন লাগিয়ে গ্রাম জ্বালিয়ে না দেওয়া। শান্তিকে এদের চাইতে বেশি আকুলতায় আর কে চেয়েছে কবে কোথায় আমি জানি না। তাদের এই স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে যায়।
বেশ কজন জানালো তারা পড়তে চায়, পড়ে আমেরিকা যেতে চায় প্রায় সবাই। একজন বাংলাদেশে এসে ব্র্যাকে কাজ করতে চাইল। আলাপ শেষে উঠে আসছি, বিকাল চারটার মধ্যে এনজিও কর্মীদের ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার নিয়ম। চারটা প্রায় বাজে, হুড়াহুড়ি করছি এমন সময় রোগা, লম্বা, ন্যাড়া মাথা, ছেঁড়া প্যান্টের উপরে “ডিওর” লেখা শেওলা সবুজ রঙের মলিন টি শার্ট, বড় বড় চোখের কিশোর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এলো। কিছু বলবে? আরবি আর ভাঙ্গা ইংরেজিতে সে যা বললো, “আমাকে হাইস্কুলে পড়ার সুযোগ করে দিতে পারো ?” গাড়িতে উঠতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালাম, চালক আব্দাল্লাহ তাড়া দিল, “আপা, সময় নাই, চারটা পার হয়ে গেলে ক্যাম্প কমান্ড্যান্টের কাছে গিয়ে মাফ চাইতে হবে, নোটিশও দিতে পারে। তাড়াতাড়ি করো। কথা আরেকদিন বলো না হয়।“ কি যে ছিল ছেলেটার চোখে, আমি চলে যেতে চেয়েও পারলাম না। এইবারের ভিজিট শেষ , আরেকদিন মানে আবার কখন কে জানে।
বলতো বাছা, কী ব্যাপার? তার নাম ‘ডেং’ (এটি ছদ্মনাম তবে ডেং নামটি ডিঙ্কাদের মাঝে জনপ্রিয় নাম), ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা যুদ্ধ শুরু হলে ডেংদের পরিবার উগান্ডায় চলে আসে। তার বাবা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন রুমবেক প্রদেশে। ডেংরা পাঁচ ভাই বোন ছিল। এক লম্বা যাত্রায় প্রায় একমাসের মতো লেগেছিল হেঁটে আসতে, কারণ তারা কেবল রাতের বেলা হাঁটত আর দিনের বেলা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকত। যুদ্ধের প্রথম দিনেই ডেং-এর বাবাকে ম্যাসেটি দিয়ে কুপিয়ে মারা হলো আরও অনেক মানুষের সঙ্গে। ডেং-এর মা প্রতিবেশীদের সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে যাত্রা করলেন নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে। বাবার মৃতদেহ বাড়ির উঠানেই ফেলে এসেছিল তারা। রাস্তায় তার সব ছোট দুই বছরের বোনটি মরে গেল, বোনের নাম ছিল আভিটাল। আভিটালকে জঙ্গলের মধ্যে কবর দিয়েছে। ডেং একটা লাঠি পুঁতে দিয়েছে বোনের কবরের উপরে, যাতে পরে কোনোদিন দেশে ফেরত গেলে খুঁজে পায়।
উগান্ডায় আসবার পরে সে ক্যাম্পের পাশের স্কুলে (উগান্ডায় রিফিউজি দের লেখাপড়া করবার, চাকরি করবার আইনি সুবিধা রয়েছে, তবে তা বাস্তবায়ন করার বেলায় বেজায় অলিখিত আইনি অসুবিধা আছে, সেই কাহিনী আরেকদিন) ক্লাস এইটে পড়তে চেয়েছিল কিন্তু আর্থিক সংকট আর আইনি জটিলতায় পড়া করবার সম্ভাবনা মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি কি তাকে হাইস্কুলে পড়বার সুযোগ করে দিতে পারি? আমার হাতটা তার রোগা হাতে ধরে। সে বার বার বলছিল, “প্লিজ ম্যাম, তুমি চাইলেই পারো। প্লিজ প্লিজ। আমি বাড়ি থেকে ট্রান্সক্রিপ্ট এনে দেখাই? আমি অংকে ১০০ পেয়েছি। প্লিজ!” তার কাতর অনুরোধে আমার হৃদয় ভেঙ্গে টুকরা হয়, সেই ভাঙ্গা হৃদয় আর তার বেদনাভার বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না। কে আমি, কী আমার ক্ষমতা এই কিশোরকে হাইস্কুলে পড়তে সুযোগ করে দেওয়ার?
এদিকে আব্দাল্লাহর তাড়া প্রায় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। হাইওয়েতে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে সে কী কৈফিয়ত দিবে? আমার সুরক্ষার মহান দায়িত্ব তার কাঁধেই বর্তায়, এইসব। সেই সঙ্গে ক্যাম্প কম্যান্ডেন্টের শাস্তির ভয়, যেনতেন শাস্তি নয়, ক্যাম্প থেকে চিরতরে বহিষ্কার করা হতে পারে আমাকে। ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’ ডিক্লেয়ার করা হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই সব হুমকি ধমকির মধ্যে ডেং-এর ঠিকানা, ব্লক নম্বর, প্লট নম্বর সব নিলাম। বললাম, দেখি বাছা, কী করা যায়!
রাইনোক্যাম্প থেকে ফেরার অনেকটা রাস্তা ঘন বনের ভেতর দিয়ে, জায়গায় জায়গায় চেক পোস্ট আছে। অন্যদিন হলে তসবিহ জপতে জপতে আসতাম, সেই সন্ধ্যায় আমার মনে না ছিল কোনো ডাকাতের ভয়, না ছিল বন্য জন্তর ভয় বা এমনকি আর্মি চেক পোস্টে জিজ্ঞাসাবাদের আতঙ্ক। কেবল ডেং-এর ছলছলে চোখে হাইস্কুলে পড়ার আকুলতা আমাকে আছন্ন অবসন্ন করে তুলেছিল।
রাজধানীতে ফিরে এসে কিছুতেই মন লাগাতে পারছিলাম না। কিছুই কি করা যায় না এই ছেলেটার জন্য? নিজের অক্ষমতায় নিজের উপরে চরম রাগ হতাশা তৈরি হচ্ছিল। এর মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রমের মিড টার্ম এসেসমেন্টে জানা গেল, আমাদের বৃত্তি প্রদান স্কিমের টার্গেট পূরণ করার পরেও কিছু বাড়তি ফান্ড রয়েছে। মনে হলো একটা কিছু করা হয়তো যাবে। দাতা সংস্থার মতামত চাইলে তারা বললেন আপত্তি নাই। আমার লাইন ম্যানেজার বললেন, “পারবে কী? আইন মেনে যদি পারো তো আমার গ্রিন সিগন্যাল রইলো। সেই সঙ্গে অল দি বেস্ট!”
শিক্ষা বিভাগের বড় কর্তার শরণাপন্ন হলাম, সব ধরনের হিসাব কিতাব করে তার মন একটু গলাতে পারলাম। এই দয়ালু সরকারি কর্তা কথা দিলেন যে, শরণার্থী শিবিরে বৃত্তি কার্যক্রম সীমিত আকারে শুরু করা যেতে পারে। পরে তিনি বলেছিলেন, আমার কাতরতায় তার মনে হয়েছিল যেন আমার নিজের ছেলের জন্য চেষ্টা করছি।
ফাইল নীচের টেবিলে পৌঁছুতেই শুরু হলো আইনের মারপ্যাঁচ। বাড়তি ফান্ড দিয়ে বেশি সংখ্যক উগান্ডান ছাত্রকে বৃত্তি দেওয়া হোক, শরণার্থীরা চলেই যাবে, তাদের পিছনে এত ইনভেস্ট করে লাভ কী। মাস চারেক এই নোট চালাচালিতে গেল। হাল প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিলাম। প্রকল্পের কাজে রাইনো ক্যাম্পে গেলেও ডেং’দের ব্লক এভয়েড করেছি। দেখা হলে কী বলব তাকে?
এর মাঝে এডভোকেসি আর কমিউনিকেশন কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের অফিসে জয়েন করল সরকারি দলের সেকেন্ড ইন কমান্ডের কন্যা। জানা মাত্রই তাকে বললাম, দেখো বাপু, তোমার প্রবেশন পিরিয়ডের ভেতর এই বৃত্তির আপ্রুভাল করে আনতে হবে, এটাই তোমার কাজ। সে লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে পড়ে আসা স্মার্ট মেয়ে। বিভিন্ন জায়গায় মিটিং সেট করতে লাগল। সরকারি অফিস থেকে শুরু করে রাজনৈতিক হাইকম্যান্ডের সঙ্গে। সেই সব মিটিংয়ে গিয়ে আমি নানা ধরনের পরিসংখ্যান আর গ্রাফ একে তাদের বুঝাবার চেষ্টা করি যে এই বাড়তি টাকা দিয়ে অল্প কিছু শরণার্থী ছাত্রকে সাহায্য করলে সরকারের জন্য তা আরও গৌরবের বিষয়। উগান্ডা এমনিতেই রিফিউজি ফ্রেন্ডলি দেশ বলে সবার কাছে সম্মান পাচ্ছে।
মাস দুইয়ের মাথায় আমাদের বলা হলো ইউএনএইচসিআর থেকে রিকোয়ারমেন্টের এসেসমেন্ট আর ইউনিসেফ থেকে বৃত্তির রিকোয়েস্ট আনতে হবে। সেগুলোও আনা হলো, ইউএনএইচসিআর-এর সাব অফিসের হেড, একজন নারী, কী যে হেল্প করলেন, বলে শেষ করা যাবে না।
তারপরে শুরু হলো আরেক দফা লেখালেখি। ছাত্র সিলেকশন ক্রাইটেরিয়া কী হবে, সিলেকশন কমিটি কে লিড করবে, কোন কোন স্কুলের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে, সিকিউরিটির দায়িত্ব কে নেবে। পরের তিন মাস আমি, আমাদের শিক্ষা কর্মকর্তা আর এডভোকেসি ম্যানেজার বলতে গেলে আরুয়াতেই পড়ে রইলাম। কাম্পালা থেকে প্রায় বারো ঘণ্টার পথের কষ্ট আমাদের থামাতে পারছিল না। আমার সঙ্গে সঙ্গে ওদেরও যেন জেদ চেপে গিয়েছিল, ডেং’কে হাইস্কুলে পাঠাতেই হবে।
২০১৭ সালের জুন মাসে শরণার্থী সপ্তাহেরই এক দিনে বৃষ্টি ভেজা দিনে আরুয়া কাউন্টি হলে এক অনুষ্ঠান আয়োজন করে ২২জন বৃত্তি প্রাপ্ত শরণার্থী ছাত্রের হাতে তুলে দেওয়া হলো কাগজ। ডেং ছিল তাদের মধ্যে। বৃত্তির কাগজ নেওয়ার সময়ে সে আমার হাত ধরে বলছিল, শুকরান হাবিবি।
সরকারী কর্মকর্তারা, রাজনৈতিক নেতারা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা সরকারের কত প্রশংসা করলেন, এক লাইনে আমার আর ইউএনএইচসিআরের সাব অফিস হেডের কথাও উল্লেখ হলো। আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, কে আমাদের প্রশংসা করল বা না করল কিছুই এসে যাচ্ছিল না তাতে। এই যে ২২টা ছেলে-মেয়ে বিশাল পৃথিবীর পথে পা রাখতে পারল আমরা সেই খুশিতেই ডগমগ করছি। এটুকু করতেই কেটে গেছে এক বছর। শরণার্থীর স্বপ্ন দেখা কঠিন, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা প্রায় অসাধ্য।
গত বছর পর্যন্ত নিয়মিত খবর পেতাম, একই সংস্থায় কাজ করতাম তাই ইমেইল আইডি বদল না হওয়াতে রেগুলার আপডেট পেতাম। ইউএনইচসিআর জানিয়েছিল, প্রথম ব্যাচের রিফিউজি ছাত্ররা ভালো ফলাফল করাতে দাতা সংস্থা প্রতি বছর ২৫ জন করে ছাত্রকে বৃত্তি দিচ্ছে। উগান্ডা শিক্ষা বিভাগ এই বরাতে একটা পরিপত্র পাবলিশ করেছে। আমাকে একটা ধন্যবাদ পত্রও তারা পাঠিয়েছিলেন। বলতে কি, অতিক্ষুদ্র আমি এই সাফল্যের একটুখানি অংশীদার হবার জন্য গর্বিত বোধ করেছিলাম। ডেং ভালো ফলাফল করছিল। কলেজে পড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে।
কিছুদিন আগে ইউএনএইচসিআর আরুয়া সাব অফিস থেকে আমার ব্যক্তিগত ইমেইলে খবর পাঠিয়েছেন যে, একজন সাউথ সুদানিজ রিফিউজি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান। এই মুহূর্তে তিনি নাম প্রকাশ করতে চান না, আমি রাজী থাকলে তারা কানেক্ট করিয়ে দেবেন।
সময় মিলিয়ে ভিডিও কল সেটআপ করা হলো। ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধির সঙ্গে প্রাথমিক আলাপ শেষে ল্যাপটপের স্ক্রিনে এক তরুণের চেহারা। ঝকঝকে হাসি, কোথায় দেখেছি তাকে! চোখ দুটো ভারী দ্যুতিময়, চেনা চেনা লাগে! ডেং !
কলেজ পাশ করেছে ডেং, বৃত্তি নিয়ে জার্মানির নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োটেকনোলজি পড়তে যাচ্ছে সে। এক বছর জার্মান ভাষা শিখতে হবে। এই সুখের দিনে তার ‘উখুত’ ( বিদেশি বোন) এর সঙ্গে কথা বলতে চায় সে। মনে মনে বলি, ব্যাটা বোন কিরে, আন্টি লাগি তোর! বলা হয় না। তাকে কনগ্রাচুলেট করি।
জানতাম ডেং ভালো করছে। সুযোগ পেলে বহুদূর যাবে।
খুব সম্ভবত বয়সজনিত কারণে আবেগ লুকাতে পারি না, চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরতে চায়।
শরণার্থী জনগোষ্ঠীর জন্য আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/আইই