অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশন বন্ধ হবে কবে?
১০ জুলাই ২০২৩ ১৩:০৬
খ্রিস্টের জন্মেরও বহু আগে প্রাচীন রোমের অধীশ্বর জুলিয়াস সিজারকে মা আউরেলিয়ার পেট কেটে বের করা হয়েছিলো। সে কারণে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যতিক্রম এ পদ্ধতিকে বলা হয় ‘সিজারিয়ান’, আর এ পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া শিশুদের বলা হয় ‘সিজারিয়ান বেবি’।
সাধারণ নিয়ম হল, প্রসূতির শারীরিক জটিলতা দেখা দিলে মা ও সন্তানের জীবনের নিরাপত্তার স্বার্থে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেবেন চিকিৎসকরা। কিন্তু কিছু চিকিৎসক ও হাসপাতালের ‘অতিরিক্ত ব্যবসা করার মানসিকতার’ কারণে বিনা প্রয়োজনে সি-সেকশনের পরামর্শ দেওয়া হয় বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। আবার সি-সেকশনের কারণে গর্ভাশয়ের ক্ষতি, অস্বাভাবিক প্ল্যাসেন্টেশন, এক্টোপিক গর্ভাবস্থা, ভ্রূণের মৃত্যু, সময়ের আগে শিশুর জন্মের মত ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি শিশুর হরমোন, শারীরিক ও অন্যান্য বিকাশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে এ অস্ত্রোপচার।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার বা সিজারিয়ান-সেকশন ডেলিভারির মাধ্যমে জন্মদানের সংখ্যা আশংকাজনক হারে বাড়তে শুরু করেছে। এ বছর জুনের ১০ তারিখ ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সি-সেকশনের সময় একটি নবজাতক ও ভুল চিকিৎসায় আটদিন পরে তার মায়ের মৃত্যুর পর নতুন করে অপ্রয়োজনীয় সি-সেকশন নিয়ে সমালোচনার ঝড় শুরু হয়েছে। যা আমাদের ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সি-সেকশনের মাধ্যমে হতে পারে তবে ২০২১ সালে ‘ডাব্লুউএইচও’ বলছে, দেখা যাচ্ছে যে এই জন্মহার ২১ শতাংশ থেকে বাড়তে শুরু করেছে এবং অনেক দেশে এক-তৃতীয়াংশ সিজারিয়ান নিয়ে আবার নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। এটা কত শতাংশ অপ্রয়োজনীয় তা নিরূপণ করার কোন ব্যবস্থা কার্যত নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ‘ইউএসএইড’-এর অর্থায়নে জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের সর্বশেষ ডেমোগ্রাফিক এন্ড হেলথ সার্ভে ২০২২ বলছে, জরিপে বাংলাদেশে ২০২২ সালের আগে দুই বছরে জন্ম নেওয়া ৩,৬৯৬ শিশুদের ৪৫ শতাংশ সি-সেকশন বা সিজারিয়ান সেকশন-এর মাধ্যমে। এ জরিপে আরো দেখা যায় গড়ে ৪২ শতাংশ ডেলিভারি বেসরকারি হাসপাতালে হয়। গড়ে ৩৮ শতাংশ বাড়িতে, গড়ে ১৭.৬ শতাংশ হাসপাতালে এবং গড়ে ১.৫ শতাংশ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা তত্বাবধানে জন্মলাভ করে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেলিভারি করতে আসা প্রায় ৬০ শতাংশ নারী উচ্চমাধ্যমিক বা তার বেশি শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ৬৭ শতাংশ আর্থিক সামর্থ্যবান।
এই জরিপ বলছে ২০১১ সালে ১৮ শতাংশ সি-সেকশন থেকে তা বেড়ে ২০২২ সালে ৪৫ শতাংশে উন্নিত হয়েছে। যা ২০১৭-১৮ সালের রিপোর্টে কেবল ছিল ৩৪ শতাংশ। যা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক বিষয়।
কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর করা এক জনস্বার্থমূলক রিটের পরে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার (সিজারিয়ান) বন্ধে নীতিমালা তৈরি করতে নির্দেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চ। সে বছরই ডিসেম্বরে একটি জাতীয় কর্মপরিকল্পনা জমা দেয় সরকার। কোভিড ১৯ আসায় সব কিছু পিছিয়ে যায়। যখন প্রাকৃতিক নিয়মে সন্তান প্রসব সম্ভব হয় না, অথবা মা বা শিশুর জীবন ও স্বাস্থ্য ঝুঁকি হতে পারে– সেসব ক্ষেত্রে মা বা শিশুর জীবন বাঁচাতে অথবা ভ্রূণের অস্বাভাবিকতার ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করার কথা। কিন্তু গত কয়েক দশকে দেশে সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের হার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ রয়েছে সচেতন মহলের। সি সেকশন বাড়ার আসলে অনেক গুলো কারন রয়েছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালের ইনকাম উৎস। কোন কোন পরিস্থিতিতে সি-সেকশন করা যাবে, সে বিষয়েও দিক নির্দেশনা রাখা হয়েছে ওই খসড়া নীতিমালায়। বড় বিষয় হচ্ছে আপনি কি ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে গিয়েছেন সব কিছু বিবেচনা করে তারা ট্রিটমেন্টটাও সেভাবেই দেয়, অথচ এটা হওয়ার কথায় না, আবার ব্যাখাও করতে রাজি না রোগের ঔষধ গুলো কিভাবে কি করতে হবে, অথচ উন্নত দেশে সামান্য স্যাভলন দিলেও বলে দেয় কোথায়, কিভাবে ব্যবহার করতে হবে। এটাই তাদের নিয়ম মাফিক পদ্বতি। আমাদের জায়গাটাই জবাবদিহিতার অভাব সৃষ্টি হচ্ছে। আমরা সবাই জানি, মা বা শিশুর জীবন রক্ষার্থে এটা করা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যেহেতু ৪৫%-এ এসে এটা দাঁড়িয়েছে তার মানে অবশ্যই অপ্রয়োজনীয় কারণ রয়েছে। মাতৃমৃত্যুর হার কমানোর জন্য প্রথম কথা হচ্ছে যে, এ্যান্টিনেন্টাল চেকআপ (প্রসবপূর্ব পরীক্ষা) এবং পরবর্তীতে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হাসপাতাল বা ইন্সটিটিউটে ডেলিভারি করা। এটা হচ্ছে প্রথম শর্ত। তবে এটা মানা খুব বেশী সম্ভব হচ্ছে না।
তবে এটা ঠিক, আমাদের কমিউনিটিতে বা আমাদের জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতাটা দরকার। দেশে এ্যান্টিনেন্টাল কেয়ার দেওয়ার জন্য এখন ১৪ হাজার ২০০ কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সেইখানে তো আমাদের লোকদেরকে যেতে হবে। তারা যাচ্ছে কখন? যখন রোগীর ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। ঝামেলা যখন হবে তখন সরকারিতে যাক কিংবা প্রাইভেটে যাক ঝামেলার জন্য সিজারের কথাই বলছে। এখন এর মধ্যে যে কিছু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য নেই সেইটাও আমি বলবো না। নিশ্চই কিছু আছে কিন্তু এটাতো নৈতিকতার ব্যাপার। সেন্সিবল ডাক্তার যারা তারা কিন্তু রিস্ক নিতে চায় না। রোগী খারাপ, বাচ্চা যদি মারা যায় বা পেশেন্ট যদি মারা যায়, তাহলে তাদের উপর হামলা হবে। তখন তারা রেফার করে দেয়। এই রেফারের যে ট্রায়ালটা এটা প্রাইমারি থেকে সেকেন্ডারি, সেকেন্ডারি থেকে টারশিয়ারি যেতে যেতে রোগী আরও খারাপ অবস্থায় চলে যায়। যারা ব্যবসা করছেন দেখা যাচ্ছে যে ডাক্তার দেখলেন বা যিনি অপারেশনটা করবেন তিনিই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এই যে নৈতিক জায়গাটা সেটা তো আইন দিয়ে কন্ট্রোল করা যাবে না। সরকারী ভাবে এবার প্রাইমারী হেলথ কেয়ারের অপারেশন প্ল্যানে এই ম্যাটারনিটির একটা বড় অংশ রাখা হয়েছে।
প্রসূতি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসদের মতে, ‘প্রসূতির ঝুঁকির ক্ষেত্রে কিছু স্বাস্থ্য জটিলতার ইনডিকেশন থাকে, যেমন ফ্লুইড একদম কমে যাওয়া। আবার আগে সিজার করা হলে পরেও সি-সেকশন করানোর মত পরিস্থিতি হয়। এর বাইরে, অর্থাৎ যদি কারণ ছাড়াই সিজার করা হয়, তবে সেটা আননেসেসারি সি-সেকশন হবে।’ এখানে কোন দ্বিমত নেই যে, সিজারিয়ান সেকশন একটি জীবন রক্ষাকারী পদ্ধতি। এই পদ্ধতিটি কোথায়-কখন প্রয়োগ করতে হবে অথবা হবে না, চিকিৎসা বিজ্ঞানে তা পরিষ্কারভাবে বলা আছে। যেখানে প্রয়োজন সেখানে সময়মতো সিজারিয়ান করতেই হবে, নইলে মা-নবজাতকের একজন বা উভয়ের মৃত্যু হতে পারে, অথবা মারাত্মক শারীরীক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
সাধারণভাবে একটি দেশের সিজারিয়ানের হার নির্দেশ করে, সে দেশের প্রসূতিদের জন্য জীবনরক্ষাকারী ‘জরুরী প্রসূতি সেবা’ কতখানি সহজলভ্য। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, একটি দেশের সি-সেকশনের হার ১০-১৫ শতাংশের আশেপাশে থাকা উচিৎ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সি-সেকশন কেন্দ্রিক বাস্তবতা ভালোভাবে বোঝা দরকার। আসলেই আমাদের সি-সেকশনের হার কত হওয়া উচিত এ বিষয়ে আমাদের নিজস্ব গবেষণা নেই বললেই চলে। যার কারণে বৈশ্বিক ও অন্যান্য আঞ্চলিক গড়কেই আমাদের রেফারেন্স হিসাবে ধরতে হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রয়োজনীয় গবেষণা প্রশ্ন সমূহ নির্ধারণ করে, গবেষণার উদ্যোগ নিয়ে আমাদের জানা-বোঝা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে পূর্ণাঙ্গ ও বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই