Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রকৃতি ও বৃক্ষপ্রেমী গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ

রশীদ এনাম
১৯ জুলাই ২০২৩ ১৫:৪১

‘ঘর খুলিায়া বাইর হইয়া
জোছনা ধরতে যাই
আমার হাত ভর্তি চাঁদের আলো
ধরতে গেল নাই’।

কথা সাহিত্যিক প্রকৃতি ও বৃক্ষপ্রেমী লেখক হুমায়ূন আহমেদ ১৩ নভেম্বর ১৯৪৮ সালে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। পিতা একাত্তরের শহীদ ফয়জুর রহমান, মাতা আয়েশা ফয়েজ। বগুড়া জিলা ইশকুল থেকে কৃতিত্বের সাথে এস এসসি, ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে, নর্থ ডাকোটা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় হতে পলিমার রসায়নের উপর পিএইচডি অর্জন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। রসায়ন বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করলেও বাংলাদেশের সাহিত্যাকাশে লেখালিখির ভুবনে গল্পের জাদুকর হিসেবে হুমায়ুন আহমেদ জনপ্রিয়তা বেশ ঈর্শনীয়। গত৩১ বছর ধরে বর্তমান প্রজন্মের পাঠকের কাছে লেখক হুমায়ূন আহমেদের বই মানে অনেকটা মজার ভোজন রশদের মতো। চাঁদনী প্রসর রাইতে স্বপ্ন ডানাই চরে ফাউন্টেনপেন ঘুরিয়ে লিখেছন, অসংখ্যা গল্প, উপন্যাস, কল্পকাহিনীসহ নানা মজার মজার বই। তৈরী করেছেন নাটক ও চলচিত্র জলরং দিয়ে বেশ কিছু ছবিও এঁকেছেন ।

বিজ্ঞাপন

লেখক হুমায়ূন জীবনের বেশি সময় কাটিয়েছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়া গাজীপুরের ফিরোজালী ইউনিয়নের হোতা পাড়ার প্রকৃতির নন্দকানন “নুহাশ পল্লীতে”। ইশকুল বেলা থেকে লেখক হুমায়ুন স্যারের ভক্ত ছিলাম । আজও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ি হুমায়ূন স্যারের বই। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে শিখেছিলাম প্রকৃতিকে কিভাবে উপভোগ করতে হয় বৃক্ষকে কিভাবে ভালোবাসতে হয়।

প্রিয় লেখককে দেখেছি বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে_

সাহিত্যর বরপুত্র হুমায়ূন আহমেদ ১৯৯৭ সালে গাজিপুর থকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে নুহাশ পল্লীর প্রায় ৪০ বিঘা জমির উপর বাগানের কাজ শুরু করেন। তার রচিত বৃক্ষকথায় দেখি-পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট নবিজি হযরতম মুহাম্মদ (সাঃ) হাদিস “যদি তুমি জানো পরের দিনই রোজ কেয়ামত, তাপরেও একটি গাছ লাগিও”।

বিজ্ঞাপন

লেখকক কিন্তু নিজ হাতে আটটি ঝাউ গাছ লাগিয়ে বৃক্ষরোপন শুরু করেন নুহাশ পল্লীতে। কল্পনা করেনি যে গাছগুলো আকাশ স্পর্শ করার স্পর্ধা নিয়ে বড় হবে। লেখক যতবার নুহাশ পল্লীতে গিয়েছেন, ঝাউ গাছ গুলির পাশে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করে বলেন, “এই তোদের নিজের হাতে লাগিয়েছি। আজ তোরা এত বড় হয়েছিস, তার মূলে কিন্তু আমি। আমাকে হ্যালো বল। ঝাউগাছ গুলি নাকি তাদের ভাষায় হ্যালো বলে”। লেখক গাছ-পালা এতো ভালোবাসতেন যে গাছপালাদের ভাষাও তিনি কল্পনার রাজ্য গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন।

নুহাশ পল্লীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন হলো লেখকের প্রয়াত পুত্র “রাশেদ হুমায়ূন ঔষধী উদ্যান”, পাথরের ক্ষুদায় করে নাম ফলকে লেখা আছে আমার ছোট্ট বাবাকে মনে করছি।

নুহাশ পল্লীতে ৫০টিরও বেশি ঔষধি গাছ লাগিয়েছেন নিজ হাতে। আবার বৃক্ষকথায় প্রত্যেকটি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম এবং ঔষধি গুনাগুনের কথাও উল্লেখ করেছেন চমৎকারভাবে। বৃক্ষ কথায় বনসাই বৃক্ষ নিয়ে লিখেছেন, “অনেকে দেখি বনসাই নিয়ে উত্তেজিত। বিশাল বটবৃক্ষকে বামুন বানিয়ে উত্তেজিত হবার কী আছে ? একটি বিশাল প্রাণকে সঙ্কুচিত করার অপরাধে তারা অপরাধী। বৃক্ষদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকলে এই অপরাধে তারা যাবজ্জীবন শাস্তির ব্যবস্থা করত। মানবজাতি ভাগ্যবান, বৃক্ষের হাতে শাসনক্ষমতা নেই”।

বকুল ফুল নিয়ে “আমার আছে জল” ছবির গানও লিখেছিলেন, “কত না প্রণয় ভালোবাসাবাসি। অশ্রু সজল কত হাসাহাসি বকুল গন্ধ রাতে”।

গাঁজা গাছ নিয়ে লেখকের একটা রম্য গপ্পোও আছে, পশ্চিমবঙ্গের এক বিখ্যাত ঔপন্যাসিক নুহাশ পল্লীতে বেড়াতে এসেছিলেন। তিনি নাকি নুহাশ পল্লীর ঔষধি বাগান দেখে এক পর্যায়ে জানতে চাইলেন, গাঁজার গাছ আছে কিনা। হুমায়ূন আহমেদের মন খারাপ হয়ে গেল, “এতো গাছ জোগাড় করেছি, গাঁজার গাছ জোগার করতে পারিনি”। এর পর যাকে পাই তাকে বলেছেন একটা গাঁজার গাছ জোগার করে দিতে। বৃক্ষ মেলায় গিয়ে লেখক গাঁজা গাছ খুঁজতে লাগলেন, কোথাও পেলেন না । শেষ মেষ এই খবর হুমায়ূন ভক্তের কানে পৌঁছে গেল। পরদিন নাকি প্রিয় লেখকের জন্য নুহাশ পল্লীতে গাঁজার দুটো গাছ নিয়ে হাজির। লেখক খুশি হয়ে গাঁজা গাছ গুলো নুহাশ পল্লীতে লাগিয়ে দিলেন। লাগানোর পরদিন সকালে লেখক দেখেন, নুহাশ পল্লী থেকে গাঁজার গাছগুলো চুরি হয়ে গেছে। লেখক বললেন, “আমার চাইতেও মনে হয় চোরের বেশি প্রয়োজন ছিল সে জন্য চুরি করে নিয়ে গেছে”। গাঁজা গাছের স্ত্রী পুরুষ আছে । দুই ধরনের গাছেই ফুল হয়। তবে শুধু স্ত্রী গাছই গাঁজা , ভাং এবং চরস দেয়। পুরুষ গাছের মাদক ক্ষমতা নেই । ধিক পুরুষ গাঁজা বৃক্ষ।

নুহাশ পল্লীতে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে, প্রকৃতির বিচিয়ে ঘাসের সবুজ গালিচা। লেখক যে রূমে থাকতেন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে আপেলবৃক্ষ।

ঔষধি উদ্যানে দেখা মিলল, আদা, কদম্ব, বেল, পান, বাসক, অসর, বাদাম, তেঁতুল, বাজনা, কাঁকড়া চোখ, নিসিন্দা, বিলম্বী, নিম , খয়ের কৃষ্ণবট, ঘেটু, পুত্রঞ্জীব, জারুল, লটকন, হিং বরুন, করমচা, পপি, উদয়পদ্ম, নীলমণি লতা, মাধুরী লতা, বাগান বিলাস, জবা, ঘৃতকুমারী, মুত্যফুল, বকফুল, ওলট কম্বল, ওলট চন্ডাল, বনকলা, আম, কাঁঠাল, লজ্জাবতী, আতা, ঢেঁকি শাক, তাল গাছ, ছাতিম, গাম, ধূপগাছ , বকুল, মাকাল, রিঠা,বহেরা, হরিতকী।

এছাড়াও লীলাবতি দিঘির পাড়ে ঝাউ গাছ, বৃষ্টি বিলাসের পেছনে সওদি খেজুর বাগান, ছোট একটা চা বাগানও দেখা মিলবে। পল্লীতে আরও আছে, মহুয়া, সর্বগন্ধ্য, জয়তুন, নিশিন্দা, গিলা, দাদমর্দন শিয়ালমুর্তা দমকলস, ভেরেন্ডা, বিষকাটালি, চিকরাশি, আপাং কন্টিকারী হাতিশুঁড়, সোনালী বাঁশ, ডুমুর, দারুচিনি, ম্যগনোলিয়াসহ পুরো পল্লী জুড়ে আছে সবুজের হাত ছানি ও অৎ¯্র স্মৃতিবৃক্ষ। জীবনের শেষ সময়েও এসে যখন তিনি শরীরে ধরা পড়ল মরণ ব্যাধী কুলন ক্যানসার তখনও তিনিও নিউইয়র্ক শহরের যে বাসায় থাকতেন সেখানে বারান্দায় নিজহাতে লাগিয়েছেন লাউ গাছ। আমেরিকা থাকাকালীন সময়ে তিনি বার বার খবর নিতেন নুহাশপল্লীর বৃক্ষগুলোর কথা । বৃক্ষগুলো ভিডিও করে তাঁকে দেখানো হতো। শেষবার যখন বাংলদেশে এসেছিলেন বিমান থেকে নেমে সুজা নুহাশপল্লীতে ছুটে গেলেন গিয়ে চলে গেলেন নিজের হাতে লাগানো বৃক্ষগুলোর কাছে। সত্যি বৃক্ষের প্রতি যে ভালোবাসা লেখকের গভীর প্রেম, বৃক্ষের সাথে কথা বলা, আমার কাছে মনে হয়েছে সুবজ বৃক্ষগুলো লেখকের কাছে ছিল অনেকটা সন্তানতুল্য। বৃক্ষ এবং প্রকৃতির সাথে যে মানব জীবনের একটা নিবিড় সম্পর্ক তিনি তাঁর প্রায় গল্পে এবং নাটকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেন একপশলা বৃষ্টির পড়ে আকাশে উধিত রংধনুর মতো মানুষ আর প্রকৃতি যেন জীবনের সাথে খেলা করে। এ জন্য মানুষের উচিত বৃক্ষের মতো সবুজ হওয়া। সবুজ হতে হলে অবশ্যই বৃক্ষরোপন করতে হবে। এক একটা বৃক্ষমানে এক একটা অক্সিজেন কারখানা।

প্রিয় গল্প জাদুকরকে দেখেছি প্রকৃতি প্রেমী হিসেবে_

কথাসাহিত্যিক লেখক হুমায়ুন্ আহমেদ পাঠকদের ভক্তদের বইয়ের মাধ্যেমে শিখিয়েছেন কিভাবে তৃতীয় নয়ন দিয়ে প্রকৃতি ভালোবাসতে হয়। বৃষ্টিতে ভেজা, বাদল দিনে প্রিয়জনকে কদম ফুল দেয়া, জোছনা উপভোগ করা, সমুদ্র বিলাস করা। প্রকৃতির কাছে তিনি বার বার ছুটে যেতেন। অদৃশ্য ভালোবাসা বিনিময় করতেন। সমুদ্র সৌন্দর্যরাণী প্রবাল দ্বীপে নিজের পরিকল্পনায় তৈরি করেছেন, সমুদ্র বিলাস নামে ছোট একটা কুটির। প্রায় সময়ে লেখক ছুটে যান সমুদ্রস্নান করতে, সুমুদ্রের গর্জণ শুনতে, গভীর রাতে সমুদ্র পাড়ে জোছনা উপভোগ করতেন।

জীবনের শেষদিনগুলিতে তিনি প্রকৃতিকে উপভোগ করেছেন। নিউইয়র্ক নীলকাশে ঝকঝকে রোদে লেখক লিখেছেন, “ম্যাপল গাছের উপর নিলর্জ্জর মতো চাঁদ উঠেছে তার থাকার কথা ছিল বাঁশবাগানের উপর। বাংলাশের দুঃখিনী চাঁদ আমাকে ভালোবেসে কংক্রিটের নিউইয়র্ক নগরে চলে এসেছে”। নুহাশপল্লীতে চাঁদনী প্রসর রাইতে গানের আসরের আয়োজন হতো। গানের আসরে চলত, চাদনী প্রসরে কে আমায় স্মরণ করে, কে এসে দাঁড়াইছে গো আমার দুয়ারে, তাহারে চিনিনা আমি সে আমারে চিনে”। “কখনও বা হও যদি তুমি নীল আকাশ আমি মেঘ হবো আকাশে হও যদি অথৈ সাগর আমি ঢেউ হব সাগরে”।

“ও কারিগর দয়ার সাগর ওগো দয়াময় চাঁদনী প্রসর রাইতে যেন আমার মরণ হয়। চান্নি পসর চান্নি পসর আহারে আলো কে বেসেছে বেসেছে তাহারে ভালো কে দিয়েছে নিশি রাইতে দুধের চাদর গায় কে খেলেছে চন্দ্র খেলা ধবল ছায়ায়”।
বিষ্টির দিনেও দেখা যায় গল্প জাদুকরকে বিষ্টি নিয়ে গান লিখতে, “বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলে বেলার গান…বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এলো বান। যদি ডেকে বলি, এসো হাত ধরো চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে এসো গান করি”। কখনও বা গেয়েছেন, “যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো তুমি চলে এসো এক বর্ষায়”।

গল্প কারিগর হুমায়ূন আহমেদ নিজের জীবনকে বৃক্ষ ও প্রকৃতির মাঝে পুরোপুরি বিলিয়ে দিয়েছেন এবং কল্পনার রাজ্য প্রকৃতিকে এমনভাবে উপভোগ করেছেন, যেন জলজোছনার ছায়ার সাথে জীবন বাস্তবতার চিত্র চোখের সামনে খেলা করে।

মৃত্যুর দুয়ারে এসে লেখক নিয়মিত শোনতেন, “মরিলে কান্দিস না আমার দায় রে যাদু ধন মরিলে কান্দিস না আমার দায় সুরা ইয়াসিন পাঠ করিও বসিয়া কাছায়। যাইবার কালে বাঁচি যেন শয়তানেরর ধোঁকায়”।

২০১২ সালে ১৯জুলাই বৃক্ষ-প্রকৃতিপ্রেমী রসিক প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ অগনিত ভক্ত পাঠককে কাঁদিয়ে তুমুল বিষ্টির ছোঁয়া নিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। নুহাশ পল্লীর লিচুবাগানে চীরতরে শুয়ে আছেন। প্রিয় লেখকের ১১ম মৃত্যুবাষির্কীতে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রকৃতি ও বৃক্ষপ্রেমী গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ মুক্তমত রশীদ এনাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর