বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা ও কিছু কথা
৬ আগস্ট ২০২৩ ১৫:১২
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরকে পরিচালনাকারী দুটি বৃহৎ সংস্থা হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা যেন আজন্ম অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে নগরবাসীর কাছে। এই বিষয়ে জানতে চাইলে, সিডিএ-কে দোষারোপ করছে চসিক। আবার চসিক-এর কথায় একমত পোষণ করছে না সিডিএ। চসিক এবং সিডিএ-র মধ্যে সবসময়ই বিপরীতমুখী সম্পর্ক বিরাজ করে।
সিডিএ-র অভিযোগ– চসিককে বারাই পাড়া খাল খনন এবং সংস্কার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু গত ১০ বছরেও চসিক তা করে দেখাতে পারেনি।
চসিক-এর অভিযোগ– সিডিএ-কে ৫৬০০ কোটি টাকার বাজেট পাস করা হয়েছে। কিন্তু সিডিএ সেটার বাস্তবায়ন করতে পারছে না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত-ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং তৎকালীন সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুস সালামের একান্ত প্রচেষ্টার কারণে চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনের বাজেট পাস হয়। উক্ত ৫৬০০ কোটি টাকা বাজেটের সময়কাল ছিলো চলতি বছরের জুন পর্যন্ত। কিন্তু এই বাজেটের সময়কাল পেরিয়ে গেলেও তা বাস্তবায়নের কোনো প্রতিকার মেলেনি।
৫৬০০ কোটি টাকা বাজেট পাস হলেও বাস্তবে ৩৩০০ কোটি টাকা আসছে। সিডিএ বিবরণীতে ৩৩০০ কোটি টাকার কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এছাড়া সিডিএ-র প্রধান প্রকৌশলী জানান, ৩৩০০ কোটি টাকার কাজ শেষে বাকি খাল উদ্ধার করতে হলে বেশিরভাগ জায়গা অধিগ্রহণ করতে হবে। আর এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তৎকালীন দেড় গুণের জায়গায় তিন গুণ হয়েছে। যেহেতু জায়গার দাম বেড়ে গেছে, স্বাভাবিক ভাবে আবার নতুন প্রজেক্ট হয়েছে। এই নতুন প্রজেক্টের অর্থমূল্য সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা হিসাব করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এই নতুন প্রজেক্ট এখনো পাস হয়নি।
মূলত ৫৬০০ কোটি টাকা বাজেটের বাকি টাকা না আসায় জলাবদ্ধতা নিরসন কাজের মন্থরগতি হয়েছে। এরপর বলা যায় যে– সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট যদি পাস না হয়, তবে ৩৩০০ কোটি টাকার সম্পন্ন কৃত কাজের সুফল খুঁজে পাওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। অর্থাৎ পূর্বের বাজেটের সাথে বর্তমান বাজেটের সমমুখী সম্পর্ক না হলে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা অভিশাপ কখনোই লাঘব হবে না।
সিডিএ এবং চসিকের এই বৈপরীত্য শুধুমাত্র বাজেট বাস্তবায়ন, জলাবদ্ধতা নিরসনগত সমস্যা নয়। তাদের মূল সমস্যা হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা এবং যেখানে মনস্তাত্ত্বিক কোন্দলগত সমস্যাও বিরাজ করছে। যেহেতু চসিক এবং সিডিএ দুই সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী হলেন রাজনৈতিক দলের নেতা। তাই তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মনস্তাত্ত্বিক কোন্দল বিরাজ করে। আবার উক্ত দুই সংস্থার মধ্যেও বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।
আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে– চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা। যা আদৌও নিরসন হবে কিনা? এমন প্রশ্ন নগরবাসীর মনে থেকেই যায়। এই জলাবদ্ধতা নিরসন সমস্যার সমাধান সন্দিহান থেকে যায়। কারণ এইযে সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদি। যা মুখের আদলে বলা হলেও বাস্তবায়ন খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমি মনে করি– যদি এই প্রজেক্টের কাজ চসিককে দেওয়া হতো, তাদের নালা-নর্দমা করার অভিজ্ঞতা আছে; তারা করতো। তারা এই জলাবদ্ধতা নিরসন প্রজেক্টের কাজ করলে হয়তো দ্রুত সম্পন্ন করতে পারতো। আবার বাস্তবে করতে গেলে হয়তো তা বলা যায় না। আবার এই বিষয়ে সিডিএ-র অভিযোগের তীর ঘেষে, বরাবরই সিডিএ-র অভিযোগ– চসিক গত ১০ বছরেও বারাই পাড়া খাল খনন ও সংস্কার করতে পারেনি, তারা আবার এতো বড় বাজেট কিভাবে পাস করবে?
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা অভিশাপ আদৌও দূর হবে কিনা? আমি সন্দিহান।
জলাবদ্ধতা অভিশাপ নিরসন না হওয়ার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে–
আমাদের যে নালা-নর্দমা, তার মধ্যে পানির তুলনায় ময়লার প্রবাহ বেশি। স্বাভাবিক ভাবে মানুষ ময়লা নিয়ে নালা-নর্দমায় ফেলে। সে ময়লাই তো ভালো মতো পরিষ্কার করা হচ্ছে না। নালা-নর্দমা ও ড্রেনগুলো পরিষ্কার করা যাচ্ছে না।
এই ময়লাই চট্টগ্রাম নগরীর জন্য আজন্ম অভিশাপ। কিন্তু উন্নত দেশগুলোতে ময়লাগুলো অভিশাপ নয়, তাদের জন্য এই ময়লা আশীর্বাদ। কারণ সেখানে মানুষ বাসাবাড়ির ময়লা কেজি হিসেবে বিক্রি করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে ময়লা বিক্রি করার সুযোগ তো দূরের কথা, বাসাবাড়ির ময়লাগুলো নির্দিষ্ট কোথাও ফেলার সেই ব্যবস্থা বা পরিকল্পনা এখনো গড়ে উঠেনি।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে গার্মেন্টস রিসাইকল প্ল্যান করার জন্য অনেক প্রজেক্ট এসেছে বিভিন্ন ধরনের। তাদের নিজেদের টাকা দিয়ে করে দিবে বললেও চসিক সেই বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এদিকে চট্টগ্রাম নগরীতে ময়লা ফেলার জায়গার সংকট দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ তো ময়লা ফেলছে রাজপথে। এভাবে ময়লার স্তূপের আকার পাহাড়ের রূপ ধারণ করে। এই ময়লাগুলো পাহাড় সমান স্তূপ হয়ে গেলেও তার কোনো যথাযথ নিরসন পরিকল্পনা ঠিক হচ্ছে না।
যতক্ষণ পর্যন্ত চসিক গার্মেন্টস রিসাইকল প্ল্যান করবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত নালা-নর্দমা, ড্রেন পরিষ্কার সম্ভব হবে না। আর নগরবাসীর জলাবদ্ধতা অভিশাপও দূর হবে না।
এই গার্মেন্টস রিসাইকল প্ল্যানের আদলে যা যা থাকছে–
১. বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে।
২. জাপানিজ কোম্পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনে সহায়তা করবে।
৩. মানুষের বাসাবাড়ি থেকে ময়লা ক্রয় করা হবে।
এছাড়া জানা যায়– গার্মেন্টস রিসাইকল প্ল্যানে যে পরিমাণ ময়লা প্রয়োজন হবে, সেই পরিমাণ ময়লা চট্টগ্রামের নগরবাসী যোগান দিতে পারবে না। এইসব সুন্দর সুন্দর পরিকল্পনা আমাদের নাগালে থাকা সত্ত্বেও আমরা গার্মেন্টস রিসাইকল প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারছি না। যতক্ষণ এই প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পারছি না, ততক্ষণ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি নালা-নর্দমা এবং ড্রেন পরিষ্কার সম্ভব হবে না। নালা-নর্দমা, ড্রেন অপরিষ্কার থাকবে। অর্থাৎ অপরিষ্কার নালা-নর্দমা ও ড্রেনের কারণে প্রতিনিয়তই এভাবে জলাবদ্ধতার স্বীকার হবে চট্টগ্রামের নগরবাসী।
নগরীর নিম্ন-অঞ্চলের পানি নেমে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে চাকতাই খাল। সম্প্রতি চাকতাই খালের সুইস গেট নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু পানি নামার জায়গাটা খুবই সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। যেখানে নৌকা যাতায়াতে প্রতিনিয়তই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এই সুইস গেট পুনঃনির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। এদিকে নিম্নাঞ্চলের পানি নামতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। যেহেতু পানি নামতে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, সেখানে ময়লা জমে যাবে। এভাবে ময়লা জমতে জমতে একসময় স্তূপের সৃষ্টি হবে। ফলে পানি নামার পথে বাঁধার সৃষ্টি হবে। আর এতে জলাবদ্ধতা সমস্যা করে নগর জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
অন্যদিকে চাকতাই খালের তলা পাকা করেও বিশাল অর্থের খরচ হয়েছে। ৫৬০০ কোটি টাকা নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন কাজের কথা থাকলেও ৩৩০০ কোটি টাকার যে কাজ হয়েছে, তা-ও দৃশ্যমান নয়।
এই ধারণা থেকে বলা যায় যে, রাজনৈতিক দলের নেতাদের অর্থাৎ চসিক এবং সিডিএ প্রধানের রাজনৈতিক মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো যতক্ষণ পর্যন্ত সমাধান হবে না এবং যে নতুন প্রজেক্ট হয়েছে তার টাকা, যথাযথ কাজ যদি সম্পন্ন না হয়; ততক্ষণ পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরবাসীর জলাবদ্ধতা নিরসনের ভোগান্তি দূর হবে না।
আরেক তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৫৬০০ কোটি টাকার বাজেট পাস হলেও তার কোনো ডিটেইলস প্ল্যান হয়নি। এই বাজেটের কাজ: যেমন- কয়টা খাল সংস্কার বা খনন করতে হবে, এসবের কোনো নির্দিষ্ট হিসাবও হয়নি।
মূল কথা হচ্ছে– আমাদের জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করে সিডিএ, চসিক, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং ওয়াসা। কাজ হচ্ছে একটা, আর সংস্থা হচ্ছে ৪টি। সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে তাহলে এই সমস্যা কেন? তারা কি আদৌও সমন্বয়ের ভিতরে কাজ করে নাকি সমন্বয়হীনতার মধ্যে দিয়ে কাজ করে? এসব প্রশ্ন এখন নগরবাসীর মনে দানা বেঁধে আছে।
আমি মনে করি, এই জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনের দায়িত্ব যেকোনো একটি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া উচিত। নয়তো হাজার-হাজার কোটি টাকা খরচ করলেও চট্টগ্রাম শহরে এই জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব হবে না।
সর্বোপরি– গার্মেন্টস রিসাইকল প্ল্যান বাস্তবায়ন, কাজের ক্ষেত্রে মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব, নালা-নর্দমা ও ড্রেনে মানুষের ময়লা ফেলা ইত্যাদি এসব যদি শেষ করতে না পারি; তাহলে আমরা কখনোই জলাবদ্ধতা অভিশাপ মুক্ত হবে পারবো না।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
এস এম রাহমান জিকু বন্দরনগরী চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা ও কিছু কথা মুক্তমত