৯ আগস্ট ভয়াবহ নাগাসাকি দিবস। মানবসভ্যতার ইতিহাসে যে কয়েকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় রয়েছে তার মধ্যে নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞ অন্যতম। আজ থেকে ৭৮ বছর আগের এই দিনে জাপানের নাগাসাকি শহরে চালানো হয় মানব ইতিহাসের দ্বিতীয় পারমানবিক আক্রমণ। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমায় বিশ্ববাসী প্রথমবার দেখে পারমানবিক মারণাস্ত্রের ধ্বংসলীলা। নাগাসাকির সাধারণ জনগন হয়তো কখনই ভাবেনি, হিরোশিমায় আক্রমণের রেশ না কাটতেই দ্বিতীয়বারের মতো নাগাসাকি স্বীকার হবে ভয়ঙ্কর পারমাণবিক মারণাস্ত্রের।
জাপানের কিউশো দ্বীপের এক শহর নাগাসাকি। অন্য আর দশটা দিনের মতো সাধারনভাবে শুরু হয়েছে নাগাসাকির সকাল। আকাশে সূর্য ওঠেছে, ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে নগরী। ঘরের গৃহিণীরা ঘরের কাজে, শিশুরা বিদ্যালয়ে আর কর্মজীবীরা কর্মস্থালে ব্যস্ত সময় পার করছেন। জীবিকার সন্ধানে ছুটেচলা নিরপরাধ লাখো মানুষের জীবনাবসান ঘটতে যাচ্ছে, তাদের দিকে ধেয়ে আসছে প্রাণনাশী এক পারমাণবিক দানব–এমন এক ভয়ঙ্কর দিনের মুখোমুখি হতে হবে এটা নাগাসাকির মানুষদের ভাবনায় ভুলেও আসেনি।
নাগাসাকিতে যে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার নাম “ফ্যাট ম্যান”। শুরুটা হয়েছিল ৯ আগস্ট তিনিয়ানের স্থানীয় সময় ভোররাত ৩ টা বেজে ৪৭ মিনিটে। এই সময় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ তিনিয়ানের এক বিমানঘাঁটি থেকে ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি এয়ার ফোর্সেস বি-২৯ (বোকস্কার) নামক বিমানটি একটি পারমাণবিক বোমা নিয়ে জাপানের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। এর মাধ্যমে শুরু হয় জাপানের একটি শহরে দ্বিতীয় পারমাণবিক বোমা ফেলার মিশন। যার নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন সেন্টার বোর্ড টু’।
অপারেশন সেন্টার বোর্ড টু-এর নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন ফ্রেডরিক সি. বোক। বোমারু বিমান ‘বোকস্কার’-এর নামকরণ করা হয়েছে তার নামের অনুকরণে। বোকস্কার বিমানটি এর যাত্রা শুরুর প্রায় ৭ ঘন্টার ব্যবধানে কোকুরা শহরের আকাশে পৌঁছায়। বোমা নিক্ষেপের ঠিক আদর্শ বলতে যা বুঝায় আকাশ তেমন ছিল না, আকাশ ছিলো অস্বচ্ছ। আকাশে তখন জমে ছিলো ঘন কালো মেঘ। যার কারণে তারা তাদের লক্ষ্য চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বিমানটি শহর ত্যাগ করার নির্দেশ পায়। এতে বেঁচে যায় কোকুরা শহর।
বোমারু বিমানটি দ্রুত বেগে ছুটে চলে দ্বিতীয় লক্ষ্যবস্তু নাগাসাকি শহরের দিকে। বন্দরনগরী নাগাসাকিতে জাপানের রাজকীয় নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানা ছিল। এ কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাগাসাকি জাপানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরে পরিণত হয়েছিল। আর মিত্রবাহিনীর প্রধান লক্ষ্য ছিল জাপানের সামরিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া। যাতে তারা শত্রুর বিরুদ্ধে আর লড়তে না পারে। তাই তারা তাদের দ্বিতীয় লক্ষ্যস্থান হিসেবে নাগাসাকিকে নির্ধারণ করে।
জাপানের স্থানীয় সময় সকাল ১০ টা ৫৮ মিনিটে নাগাসাকির ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়। বিমানটির পাইলট ১ হাজার ৬৫০ ফুট উচ্চতা থেকে বোমাটি নিক্ষেপ করে। বোমাটির ক্ষমতা ছিল ৮৮ টেরাজুল বা ২১ কিলোটন টিএনটি। জাপানের বুকে অচিরেই আছড়ে পরে ৪৬৭০ কেজি ওজনের এক নতুন দানব, যার নাম ‘ফ্যাট ম্যান’।
এর ঠিক ৪৩ সেকেন্ড পর ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৬৫০ মিটার উচ্চতায় ফ্যাট ম্যান বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরিত হতেই ফ্যাট ম্যান বিশাল এলাকাজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বিষ্ফোরণস্থলের উষ্ণতা ৩০০,০০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড হয় এবং নিচের ভূমিতে এর তাপমাত্রা ৪০০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে পৌছায়। নাগাসাকির আকাশ ছেয়ে যায় এক বিশাল মাশরুম আকারের মেঘে। যাকে বলা হয় ‘মাশরুম ক্লাউড’।
স্বল্প সময়ের মধ্যে অকল্পনীয়ভাবে বেড়ে যায় বায়ু চাপ, প্রতি বর্গমিটার এলাকায় ৩৫ টন বায়ু চাপ সৃষ্টি হয়। বিস্ফোরণের ঘন্টাখানেক সময়ের মধ্যে ক্ষতিকর তেজষ্ক্রিয় পদার্থগুলো কালো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকায়।
ফ্যাট ম্যান নামক পারমানবিক মারণাস্ত্র মুহূর্তেই সব লন্ডভন্ড করে দেয়। নাগাসাকিতে নিক্ষেপ করা বোমাটি হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা বোমা লিটল বয় থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। হিরোশিমার যে স্থানে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে সেই স্থানটি ছিল বাণিজ্যিক। কিন্তু নাগাসাকির আকাশ মেঘে ঢাকা থাকার করণে সঠিকভাবে লক্ষ্যস্থল নির্ধারণ করা যায়নি। এতে বোমাটি কেন্দ্রস্থল বিচ্যুত হয় এবং হিরোশিমার তুলনায় নাগাসাকিতে তুলনামূলক ক্ষয়ক্ষতি কম হয়।
নাগাসাকিতে প্রায় ৪০ হাজার লোক ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়া ২৫ হাজার লোক মারাত্মকভাবে আহত হন। এর পরবর্তী কয়েক মাসে অসহ্য পারমাণবিক বিকিরণের প্রভাবজনিত রোগে ভুগে শত শত লোক মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখে পৌঁছে।
নাগাসাকি আক্রমণের ৬ দিন পর ১৫ আগস্ট জাপান মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয় কয়েক বছরব্যাপী চলা রক্তক্ষয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
অমানবিক মর্মান্তিক এই পারমাণবিক হামলায় যারা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের জাপানি ভাষায় বলা হয় ‘হিবাকুশা’। যার বাংলা অর্থ বিস্ফোরণে আক্রান্ত মানুষজন। জাপান সরকার নতুন আইন করে হিবাকুশা হওয়ার সংজ্ঞা নির্ধারন করেছে। এই আইনের নাম হয় ‘দ্য অ্যাটমিক বোম্ব সারভাইভারস রিলিফ’।
তিন শ্রেণির মানুষ, যারা বোমা বিস্ফোরণস্থলের সামান্য কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে বসবাস করতেন, পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণের দুই সপ্তাহের মধ্যে বিস্ফোরণস্থলের দুই কিলোমিটারের মধ্যে ছিলেন বা বিস্ফোরণ নিঃসৃত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়েছেন–এই তিন শ্রেণির মানুষকে দ্য অ্যাটমিক বোম্ব সারভাইভারস রিলিফ আইনে বলা হয় হিবাকুশা।
এদের কেউ হিবাকুশা হতে চাননি, চেয়েছিলেন আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে। ফ্যাট ম্যান নামক ভয়াবহ মারণাস্ত্র তছনছ করে দেয় তাদের সাজানো সংসার, সাজানো স্বপ্নসহ সবকিছুই। বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমেরিকার নৃশংসতার গ্লানি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে নাগাসাকিকে। ভয়ঙ্কর তেজস্ক্রিয় বিকিরণে শুধু মানুষ নয় বন্য পশু-পাখিরাও এখানে স্বাভাবিক জীবনে স্থির হতে পারেনি।
আজ থেকে ৭৮ বছর পর পূর্বে ১৯৪৫ সালে নৃশংসতা পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার সেই নাগাসাকি শহর এখন কেমন আছে? সেদিনকার মৃতনগরী নাগাসাকির বর্তমান চিত্র দেখলে কেউ অবাক না হয়ে পারবে না। নাগাসাকি এখন বদলে গেছে, জাপান ঘুরে দাঁড়িয়েছে। নাগাসাকির ক্ষত পুরোপুরি না সারলেও আজকের উন্নত শহরটি দেখে বিগত শতাব্দীর ভয়াবহতার চিত্র আন্দাজ করা ভার!
তবে এতো বছর পরও নাগাসাকিতে এখনো বন্য পশু-পাখি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। তেজস্ক্রিয়তার ক্ষতির প্রভাব পাওয়া যায় এখনকার বসবাসকারীদের শরীরে। তেজস্ক্রিয়তা থেকে ক্যান্সার ঝুঁকি থাকায় এ অঞ্চলে এখনও কেউ দীর্ঘ সময় থাকতে চায় না। এতো বছর পরও এখান থেকে জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু।
প্রতিবছর ৯ আগস্ট ফিরে ফিরে আসে। জাপানে প্রতিবছর নিহতদের স্মরণে দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়। এই দিন সমবেত হন লক্ষ লক্ষ মানুষ। সকলের কণ্ঠে বিশ্ব থেকে পারমানবিক অস্ত্রের অস্তিত্ব মুছে ফেলার আওয়াজ আসে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে প্রস্তাবনা কি পারমানবিক শক্তিধর দেশগুলো মেনে চলে? দিনশেষে এই মারণাস্ত্রের অপব্যবহারই লক্ষ্য করা যায়।
নাগাসকি দিবস উপলক্ষ্যে আমরা পারমানবিক অস্ত্রের অপব্যবহার বন্ধে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে আবেদন জানাই। বিশ্ববাসী যুদ্ধ নয়, শান্তি কামনা করে। পারমানবিক বোমা জাতির জন্য অভিশাপ। যার ভয়াবহতা ও অভিশাপ জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিবাসী এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন। জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকির এই ধ্বংসযজ্ঞ বিশ্ব ইতিহাসে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। পারমানবিক মারণাস্ত্রের এমন ঘটনার আমরা আর পুনরাবৃত্তি চাই না।
লেখক: কলামিস্ট