সুরক্ষার জন্য টিকার চিন্তা হোক প্রথম ভাবনা
১০ আগস্ট ২০২৩ ১৬:৫৭
সিঙ্গাপুরে ১৯ বছরের চেষ্টায় মশা নিয়ন্ত্রণে এলেও সেখানে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কমেনি। দেশটিতে প্রথমে মশা নিধন করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের চেষ্টার পরে তা আবারও বেড়ে যায়। মূলত বিদেশ থেকে আসা মানুষ থেকে সেটি এক পর্যায়ে ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই উদাহরণ শুধু সিঙ্গাপুরের জন্য নয়, বিশ্বের অনেক দেশ নিয়ন্ত্রণে আনার পরও ডেঙ্গুর নতুন নতুন ঢেউয়ে কাবু হয়েছে।
এ জন্য শুধু মশা নিধন নয়, প্রয়োজন ভ্যাকসিন কার্যক্রম। ফলে হাসপাতালে ভর্তি ৯০ শতাংশ কমার কথা বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এতে কমবে মৃত্যুঝুঁকিও। দেশে ডেঙ্গু যখন মারাত্মক আকারে চোখ রাঙাচ্ছে তখন সবখানেই এক আলোচনা; আমরা প্রতিরোধের ব্যর্থতার দিকেই থাকব, নাকি টিকার দিকে যাব। কোনটি সত্যিকারের কার্যকর দাওয়াই?
সর্বোচ্চ প্রাণঘাতি জীবাণু বহন করে যে প্রাণী মৃত্যু ঘটায় তার ওপর বিপজ্জনক প্রাণীর বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে। সেই বিচারে ডিসকভার ওয়াইল্ড লাইফের এক জরিপে সবার আগে রয়েছে মশা। অর্থাৎ ছোট্ট এই প্রাণীটি অল্প দিনেই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেনি। সৃষ্টির সেরা প্রাণী মানুষের জন্য মশা অনেক আগেই থেকেই মহা বিপদের কারণ।
মশার দ্বারা সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর মৃত্যু হয় সাত লাখ ২৫ হাজার থেকে ১০ লাখ মানুষের।
এবছর দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ভয়াবহ রুপ নেয়ায় আবারো আলোচনায় এডিস মশা। যখন গোটা পৃথিবী অদৃশ্য শক্র করোনা মোকাবেলার যুদ্ধ করছে ঠিক তখন বাংলাদেশ সহ অনেক দেশকে মশার বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধে নামতে হয়েছে। যদিও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রতিবেশি দেশ ভারত সহ অনেক রাষ্ট্র সফল। তখন বাংলাদেশের ৬৪ জেলা আক্রান্ত। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় এ রোগ রীতিমতো মহামারি আকারে ছড়িয়েছে। মহা আতঙ্কে দিন কাটছে নগরবাসীর। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা।
দেশের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। এতে চাপ পড়ছে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর। এ পরিস্থিতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সামনের পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনেক হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা যাচ্ছে না। রক্তের জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। পরিস্থিতি এমন না হোক সামনের দিনে চিকিৎসা উপকরণের সংকট দেখা দেয়।
ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু মশা নিধন করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। তেমনি খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাস হলো আগামী দু’মাস আরো বিপজ্জনক। অর্থাৎ পরিস্থিতি যে বেশি খারাপের দিকে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
যদিও রাজধানী শহর হিসেবে সবদিক থেকে নাগরিকদের সুরক্ষিত থাকার কথা। তা না থেকে, সর্বোচ্চ বিপদের ঢেউ সবার আগে এই শহরেই লাগে। আস্তে আস্তে এর প্রভাব ছড়ায় গোটা দেশে। তাহলে একটি বিষয় একেবারেই পরিস্কার- প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট সব রকমের বিপদ থেকে নগরবাসী মোটেও সুরক্ষিত নয়। পরিকল্পনাগত ত্রুটি আর সঠিক চিন্তার অভাবেই সাধারণত এমন হয়।
ডেঙ্গু রোগী বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকটাই তোপের মুখে আছেন ঢাকার দুই মেয়র। কষ্টের কথা হলো দীর্ঘ সময় পরেও এই রোগ প্রতিরোধে নাগরিকদের সচেতন করা যায়নি। এটি সত্যিই ব্যর্থতা। তেমনি গতি প্রকৃতি পরিবর্তন করেছে মশা। এখন সব পানিতেই জন্ম নেয় এডিস, তেমনি রাতদিন কামড় দেয়। তাহলে প্রায় করোনার মতোই আরেকটি অদৃষ্য শক্তির বিরুদ্ধে বাঁচা-মড়ার লড়াই চলছে।
প্রশ্ন হলো আমরা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাব নাকি সংক্রামক এই ব্যাধি নির্মূলে টিকার দিকে যাব। এ ধরণের মহামারি টিকা ছাড়া নিয়ন্ত্রণ সম্ভব কিনা জানা নেই। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে টিকার কোন বিকল্প নেই। এর বড় কারণ হলো, প্রতি বছর মশা নিয়ন্ত্রণে যে পরিমান রাষ্ট্রের ব্যয় হয় তা কতোদিন চালিয়ে যেতে হবে এর নিশ্চয়তা নেই। মশা নির্মূলের নিশ্চয়তা দেয়া না গেলে মৃত্যু হবেই। আদো কি সব মশা নির্মূল সম্ভব? তেমনি ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু কখনই অর্থের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। যে ক্ষতিপূরণ দিয়ে অনেকটা নির্ভার হওয়া যাবে। আর ক্ষতিপূরণ দেয়া তো কোন স্থায়ি সমাধান নয়।
তাই টিকার ভাবনা জরুরী, যা এক নম্বর ভাবনা হওয়া উচিত। টিকার মাধ্যমেই সমাজকে জীবনসম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি থেকে রক্ষা করা সম্ভব। যদিও ডেঙ্গু নির্মূলে বিশ্বে এখন পর্যন্ত শতভাগ কার্যকর টিকার সংবাদ মিলেনি।
কারণ- মহামারি রোগ এমন একটি রোগ, যা নির্দিষ্ট জনপদের বিশাল অংশের জনগোষ্ঠীকে একবার আক্রান্ত করা শুরু করলে সাধারণত ৭০-৮০ শতাংশ লোককে অসুস্থ না করে ক্ষান্ত হয় না। মহামারির চরিত্রই হলো, যদি টিকা না নেওয়া হয়, সমাজে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ তৈরি না হওয়া পর্যন্ত প্রাকৃতিক নিয়মেই রোগটির একটার পর একটা ঢেউ এসে সমাজকে ধ্বংস করতে থাকবে। তত দিনে অনেক মূল্যবান জীবনসম্পদ বিদায় নেবে।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এডিস মশাবাহী ডেঙ্গুর বিষয়ে সতর্কতা জারি করেছে। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু গত বেশ কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়ে এসেছে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ তথা ডেঙ্গু মোকাবেলায় বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্তৃপক্ষের তৎপরতা ও সফল কৌশলগুলো নিয়েও আলোচনা বিস্তর। নিজেদের স্বার্থে সফল কৌশলগুলো কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নিতে পারে।
চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগে সাত আগস্ট পর্যন্ত অন্তত ২২৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এবারের মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২৩ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ঢাকায় ১৯৬৫ সালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব প্রথম দেখা যায়।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, প্রতিবছর বিশ্বে ১০ থেকে ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ আমেরিকার বৃষ্টিবহুল অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জনসাধারণকে মশা নির্মূলে সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি, প্রযুক্তি ও নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছে।
সেসব দেশে অনেক মানুষ আক্রান্ত হলেও তা মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা রয়েছে। ডেঙ্গুকে তারা আতঙ্ক তৈরির মতো জায়গায় পৌঁছতে দেয়নি। সার্বক্ষণিক তদারকি সহ প্রতিরোধমূলক নানা কার্যকর পদক্ষেপের কারণে চলতি বছর কলকাতায় এডিসে মৃত্যুর সংখ্যা নগণ্য। শুধু তাই নয় ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া সহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ টিকা ছাড়াই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল। তাই বলে টিকার প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে।
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতা ও মশক নিধনের পাশাপাশি এই রোগের বিস্তার রোধে সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি ভ্যাকসিন। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন সিডিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত দুটি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন আছে, যা এরই মধ্যে ২০টির মতো দেশে লাইসেন্স পেয়েছে। এর মধ্যে একটি ডেঙ্গুর চার ধরনেই কার্যকর। রোগ প্রতিরোধে ৮০ শতাংশের কাছাকাছি কার্যকর এবং এর প্রয়োগে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে না।
বর্তমানে বিশ্বের ৩৯০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে। ১৯৭০ সালে মাত্র ৯টি দেশে ডেঙ্গু ছিল। ২০২৩ সালে এটি ১২৫ দেশে ছড়িয়েছে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ দেশ এশিয়ায়। বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৯ কোটি। এর মধ্যে পাঁচ লাখ মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়। ২০ থেকে ২৫ হাজার মৃতুবরণ করে, যার বেশির ভাগ শিশু। দেশে এবার আক্রান্ত ও মৃত্যুতে রয়েছে শিশুদের একটি বড় অংশ রয়েছে। এ বিষয়টি নীতি নির্ধারকদের মাথায় রাখা দরকার।
বিশ্বব্যাপী ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ হলো বিদেশভ্রমণ। এ ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা এর জন্য দায়ী। প্রতি চারজনে তিনজনের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অর্থাৎ ১০০ জনের লক্ষণ প্রকাশ পেলে আক্রান্ত হবে ৪০০ জন। কারণ ৭৫ শতাংশ রোগীর কোনো উপসর্গ থাকে না। যাদের উপসর্গ দেখা দেয়, তাদের ৫ শতাংশের সিভিয়ার ডেঙ্গু হয়। যেমন, রক্তপাত, পেটে পানি জমা, এসব থেকে রোগী শকে চলে যায়। যখন চিকিৎসা করা যায় না, তখন মৃত্যুহার ২০ শতাংশ হতে পারে।
মূলত স্ত্রী এডিস মশা কামড়ায়। ডিম উৎপাদনে তাদের রক্তের প্রোটিন দরকার। স্ত্রী মশা বাঁচে ৪২ থেকে ৫৬ দিন। এরা নিজ ওজনের ৩ গুণ বেশি খেতে পারে। মনে রাখা দরকার, যদি পৃথিবীর প্রতিটি মশাকে মেরে ফেলা হয় তাহলে পরাগায়ণ কমে যাবে। শত শত প্রজাতির মাছকে তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। পাখি, বাদুড়, মাকড়সা, পোকামাকড়, সালামান্ডার, টিকটিকি এবং ব্যাঙও মশা খায়। তাদের বেঁচে থাকার লড়াই কঠিন হবে। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে একমাত্র পথই ভ্যাকসিন। সময় বলছে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পাশাপাশি টিকার দিকে সর্বোচ্চ নজর দেয়ার বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত রাজন ভট্টাচার্য সুরক্ষার জন্য টিকার চিন্তা হোক প্রথম ভাবনা