Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মানুষ গড়ার কারিগর ছিলেন পান্না কায়সার

রাজন ভট্টাচার্য
১২ আগস্ট ২০২৩ ১৫:৪৩

‘আমি হতাশ হতে চাই না। হতাশা মানুষকে সাফল্য থেকে পেছনে নিয়ে যায়। আপনারাও হতাশ হবেন না। সবাই মিলে শিশুদের জন্য, দেশের জন্য কাজ করবো। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব প্রত্যেকের। আশাকরি যে অন্ধকার দুঃসময় চলছে, তা কেটে যাবে। এ কাজে আমরা ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরো বিপথগামী হবে। তাই রাষ্ট্র, সমাজ, সংগঠন কেউ পাশে না থাকলেও খেলাঘর শিশুদের নিয়ে এগিয়ে যাবে। হতাশায় আলোর মশাল কোনভাবেই নিভে যেতে দিতে পারি না।’

বিজ্ঞাপন

২০০১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নয়া পল্টনের এফবিএবি মিলনায়তনে বাইরে এরকম বক্তব্য কানে আসছিল। ভেতরে খেলাঘরের এক অনুষ্ঠানে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে কথা বলছিলেন সংগঠনের প্রাণ পান্না কায়সার। এই প্রথম তাকে সরাসরি দেখা। এরপর থেকে গলায় লাল স্কার্ফ লাগানো অবস্থায় এরকম হাজারো বক্তব্য শুনেছি তার। প্রতিটি বক্তব্য আমার মতো খেলাঘরের হাজারো কর্মী সংগঠকদের মনে প্রাণের সঞ্চার সৃষ্টি করেছে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে সাহসের সাথে এগিয়ে চলার স্বপ্ন দেখিয়েছে। তেমনি শিশুরাও খেলাঘরের সঙ্গে পথচলতে অনুপ্রেরণা পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

যখন সারাদেশের শিশুরা ভালো নেই, তাদের অধিকারের কথা বলতে সামাজিক সংগঠনগুলো নামেমাত্র নিভুনিভু জ¦লছে, এই অসময়ে চলে গেলেন শহীদ জায়া পান্না কায়সারও। গত চার আগস্ট সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে আকাশের তারা হয়ে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত নতুন প্রজন্মের নাগরিক গড়ে তুলতে অনবদ্য সংগ্রাম করেছেন মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে পরিচিত এই মহিয়সী নারী।

আলোকিত মানুষদের একে একে চলে যাওয়ার মিছিলে সমাজের অপূরনীয় ক্ষতি হচ্ছে। দিন দিন সাহসের সাথে সত্য কথা বলার লোক কমছে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অসঙ্গতি, স্বেচ্ছাচারিতা অন্যায় আর শোষণের বিরুদ্ধে দুর্বল হচ্ছে আওয়াজ। শুধু তাই নয় দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, মানুষের অধিকার আদায়ে সামনের দিনগুলোতে কথা বলার মানুষ হয়ত আরো কমবে। রাজনৈতিক চিন্তার ঊর্ধে ওঠে দেশের নানা সংকট, দুর্যোগে সঠিক পরামর্শ দেয়ার মানুষগুলো জাতির কতো বড় সম্পদ, তা বলে বোঝানো যাবে না।

জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন খেলাঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শহীদ বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী ও ঢাকা বিশ্বাবিদ্যালয়ের শিক্ষক শহীদুল্লাহ কায়সারের স্ত্রী পান্না কায়সার। পারিবারিক নাম সাইফুন্নাহার চৌধুরী। ডাক নাম পান্না। মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পুরনো ঢাকার ২৯ বি কে গাঙ্গুলী লেনের বাসা থেকে আলবদর বাহিনীর লোকজন শহীদুল্লা কায়সারকে তুলে নিয়ে যায়। আর ফিরেননি। অনেক চেষ্টা করেও ঘাতকদের হাত থেকে স্বামীকে রক্ষা করতে পারেননি তিনি। এরপর স্বামীর খোঁজে রায়েরবাজার বৌদ্ধভ‚মি সহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে চষে বেড়িয়েছেন।

তার বুকে স্বামী হাড়ানোর দগদগে ক্ষতের মধ্যে দেশ স্বাধীন হলো, আকাশে উড়ল লাল সবুজের পতাকা। শমি কায়সার ও অমি কায়সার এই দুই সন্তানকে নিয়ে বেঁচে থাকার নতুন লড়াইয়ে নামলেন তিনি। ১৯৭২ সালে রণেশ দাশগুপ্তের হাতধরে খেলাঘরের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন রণেশ দাশগুপ্ত পান্না কায়সারের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমাকে খেলাঘরে রেখে গেলাম। এখানে তুমি তোমার শহীদুল্লা কায়সারকে খুজে পাবে’। ১৯৯২ সাল থেকে আজীবন পান্না কায়সার খেলাঘরের সভাপতিমন্ডলীর চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। বদরুন্নেসা কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন এই লেখিকা।

এক কথায় বললে সংগ্রামী জীবন তার। ১৯৫০ সালের ২৫ মে কুমিল্লার বরুরা উপজেলায় রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম পান্না কায়সারের। পরিবার ও স্বামীর আদর্শে একজন খাটি দেশপ্রেমিক মানুষ হয়ে ওঠেন তিনি। নিবেদিতভাবে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার পর দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার কথা দেশে উচ্চারণ করা যায়নি। এমন ক্রান্তি লগ্নেও তিনি দমে যাননি। সকল রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এগিয়ে গেছেন সামনের দিকে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত এই নারী উপলব্দি করেছিলেন, এভাবে চলতে থাকলে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশের ইতিহাস আগামী প্রজন্ম ভুলে যাবে। বিপথগামী হবে শিশুরা। তাই নতুন প্রজন্মের দেশের সঠিক ইতিহাস জানা দরকার।

তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রের প্রকৃত ইতিহাস শিশুরা জানলে- তারা অবশ্যই সুনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠবে। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে নিরন্তর লড়াই চালিয়েছেন। শত প্রতিক‚ল পরিস্থিতির মধ্যেও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সমাজ ও জাতির কাছে তুলে ধরতে প্রগতিশিল ও দেশপ্রেমিক মানুষদের সঙ্গে সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নানা আয়োজনে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ করেছেন। শিশু-কিশোর সমাবেশে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তি সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস অকপটে তুলে ধরেছেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধপরাধীদের প্রতীকী বিচারের আন্দোলনেও তিনি ছিলেন সম্মুখ সাড়ির যোদ্ধা। উদীচী সহ বহু প্রগতিশীল সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পান্না কায়সার।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। আদালতে কাঁঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তখন নিজেই স্বামী হত্যাকারী জামায়াত নেতা খালেক মজুমদারকে সনাক্ত করেছিলেন। বিচারকে বলেছিলেন, নিজের হাতে স্বামী হত্যাকারীকে শাস্তি দিতে চান, এই বলে ঘাতকের গলা চেপে ধরেছিলেন তিনি। আসামি আদালতে খুনের কথা স্বীকার না করলেও তিনি শহীদুল্লা কায়সারকে তুলে নেয়ার কথা বলেন। এজন্য খালেক মজুমদারের ফাঁসি না হয়ে ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়েছিল। জেলে বসে জামায়াতের এই নেতা পান্না কায়সারকে হুমকি দেয়। ১৯৭১ সাল থেকেই তিনি জামায়াত সহ দেশবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন এই অশুভ শক্তিকে। যুদ্ধপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নিষিদ্ধেরও দাবি ছিল তার কণ্ঠে। উগ্র সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্টীর বিরুদ্ধে অনেক কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন তিনি। এভাবে আস্তে আস্তে দেশবিরোধী শক্তির নিশানায় পরিণত হন প্রগতির এই কণ্ঠস্বর।

বহুবার শুনেছি, তার নিউ ইস্কাটের বাসার গেটে কাফনের কাপড় রেখে আসার কথা। হত্যার হুমকি দেয়ার কথা। থেমে যাননি তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা সবচেয়ে বড় সামাজিক আন্দোলন গণজাগরণ মঞ্চের যাত্রা শুরুর পর নামকরণ ঠিক হলো। দুইজন শহীদ জায়াকে দিয়ে সংগঠনের নাম ঘোষণার সিদ্ধান্ত হয়। তাদের একজন পান্না কায়সার।

জীবন সংগ্রামের মধ্যে লেখালেখি চালিয়ে গেছেন তিনি। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ সহ অনেক কিছুই লিখেছেন কাজের ফঁকে। ‘মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে (১৯৯১), মুক্তি (১৯৯২), নীলিমায় নীল (১৯৯২), হৃদয়ে বাংলাদেশ (১৯৯৩), মানুষ (১৯৯৪), রাসেলের যুদ্ধযাত্রা (১৯৯৪), অন্য রকম ভালোবাসা (১৯৯৫) সহ অন্তত ১২টি বই প্রকাশিত হয়েছে তার। সংবাদপত্রে বিভিন্ন ইস্যুতে লিখতেন, দেশের নানা সংকটে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতেন।

তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংকল্প ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন প্রজন্ম গড়ে তোলা। এজন্য তিনি খেলাঘর ও নিষ্পাপ শিশুদের অনেক বেশি ভালোবাসতেন। ভয়াবহ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখেও তিনি খেলাঘর আন্দোলন ছেড়ে যাননি। অনেক আশাবাদি মানুষ ছিলেন। ৫২ বছর ধরে যে সংগঠনটি মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করেছে, সেই সংগঠন কিছু পায়নি। অর্থ সংকটের পাশাপাশি একটু জায়গা পর্যন্ত নেই। নিজেদের পকেটের টাকায় কোন রকমে সংগঠন চলে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলেও খেলাঘরের জন্য কিছু করেনি। এতে মোটেও বিচলিত ছিলেন না তিনি। বলতেন, তবুও এগিয়ে যেতে হবে। কারো কাছে কিছু আশাকরে লাভ নেই। আমরা এগিয়ে যাবোই। কোন অবস্থাতেই শিশুদের ছেড়ে যাওয়া যাবে না।

ডাক পেলেই সরল মন নিয়ে ছুটে যেতেন শিশুদের কাছে। ভালো কাজে সবাইকে অনুপ্রেরণা যোগাতেন। হাসিমুখে কথা বলতেন। খেলাঘরের নানা আয়োজনে বিভিন্ন জেলায় অংশ নিয়ে সবাইকে একটি কথা বলার চেষ্টা করেছেন, খেলাঘর করে কোন শিশু বিপথগামী হয় না। তারা দেশপ্রেমিক হয়, সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে।

তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন, শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের দেশপ্রেমে গড়ে তোলা সম্ভব হলে, বাংলাদেশ আরো এগিয়ে যাবে। কারণ দেশপ্রেমিক মানুষগুলো কখনও ব্যর্থ হয় না, অন্ধকারে পা বাড়ায় না।

সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়, বিশ্বায়নের প্রভাব, ডিভাইস আসক্তি সহ নেতিবাচক নানা সূচকের কারণে তিনি নতুন প্রজন্মকে নিয়ে বেশ চিন্তিত ছিলেন। ভাবতেন। নতুন নতুন কর্মসূচি দিয়ে কিভাবে খেলাঘরের পতাকাতলে শিশুদেও আরো বেশি যুক্ত করা যায়, এ নিয়ে সংগঠকদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। ১৯৫২ সালের দুই মে খেলাঘরের যাত্রা শুরুর পর মহান মুক্তিসংগ্রামে সংগঠনের কর্মীদের ত্যাগ ও অবদানের কথা শিশু-কিশোরদের মাঝে তুলে ধরতেন। গল্প শোনাতেন মুক্তিযুদ্ধের। বলতেন নিজের জীবন সংগ্রামের মধ্যে এগিয়ে চলার কথাও।

দুঃখকে কিভাবে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যেতে হয়, তা দেখিয়েছেন তিনি। পান্না কায়সার শুধু সংগ্রামী নারীদের জন্য অনুপ্রেরণা নয় একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে সবার কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। চেতনার এই বাতিঘরের চলে যাওয়ায় শিশুরা কেঁদেছে অঝোরে। তারা একজন অভিভাবক হারালো। আর জাতি হারিয়েছে একজন সংগ্রামী নারী, সাহসি ও দেশপ্রেমিক মানুষকে।

আকস্মিকভাবে ৭৩ বছরে বিদায়ে তার স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ার কাজটি বাকি রয়ে গেছে। নতুন প্রজন্ম সহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ প্রগতিশিল সকলের দায় রয়েছে পান্না কায়সারের স্বপ্ন পূরণের। তা কতোটুকু সম্ভব, সময়েই বলবে। তবে এটা সত্য, দেশ ও সমাজের প্রয়োজনে সবাইকে এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিকল্প নেই।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

পান্না কায়সার রাজন ভট্টাচার্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর