Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারী আটকায় না, ধরা দেয়

আনোয়ার হাকিম
২১ আগস্ট ২০২৩ ১৪:২২

বেশ কিছু দিন যাবৎ এই একটি বিষয় খুব চাউর হইয়াছে। মজা করিয়াই হউক আর সিরিয়াসলি ভাবিবার বিষয় বলিয়াই হউক ইহা এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণার বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আজকাল কোন কিছু ঘটিলেই নেট দুনিয়ায় তাহা ঘুরিতে থাকে। ভাইরাল হইতে সময় লয় না। ফুল টাইম আর পার্ট টাইম নেটিজেনরা এইসব ভাইরাল কনটেন্ট দেখেন, বলা চলে, দেখিতে বাধ্য হোন। বিষয়টি খুব ইন্টারেস্টিং তো বটেই ভাবিবারও বটে।

পুরাকালে, পন্ডিতেরা নারীর মন লইয়া গবেষণা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন যে, নারীর মন দেবতারাও বুঝিতে পারে না। ইহা নারীদের জন্য স্বস্তিকর নাকি গ্লানিকর তাহা লইয়া কেহ মাথা ঘামায় নাই। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষেরা চালকের আসনে বসিয়া বহিরাঙ্গ দাবড়াইয়া বেড়াইয়াছে। নানা কাজের ফাঁকেও তাহার বুভুক্ষ মন নারীতে মজিয়াছে, নারীতে সঁপিয়াছে। মন দিয়াছে, ভালোবাসিয়াছে, একান্ত করিয়া পাইবার জন্য স্বপ্ন দেখিয়াছে, মরিয়া হইয়া তাহাকে নিজের বাহুলগ্ন করিয়া পাইতে যারপরনাই পাগল হইয়াছে। সমাজে-সাহিত্যে-জনশ্রুতিতে ইহা লইয়া বিস্তর কাহিনী চালু রহিয়াছে। এই লইয়া পুরুষেরা তাহাদের প্রেমের সাতকাহন লিখিয়াছে। ইহাতে তাহাদের পাগলপারা মনের বিধ্বস্ত অবস্থার বর্ণনা করিয়াছে। না পাইবার আত্মঘাতি যাতনা চিত্রিত করিয়াছে। নারীকে পাইতে সিংহাসন পর্যন্তও বিসর্জন দিয়াছে। তাহার পরেও নারী কিসে আটকায় এই প্রশ্নের মিমাংসা হয় নাই।

বিজ্ঞাপন

মনুষ্য প্রজাতির মধ্যে নারী এক প্রকার। অন্যটি অতি অবশ্যই পুরুষ। বিশ্বব্যাপী ইহার একটি সার্বজনীন রূপ রহিয়াছে। আবার আঞ্চলিক ও দৈশিক রূপও রহিয়াছে। সব কিছু ছাপাইয়া স্থান-কাল-পাত্র ভেদে নারী নারীই, পুরুষ পুরুষই। বংশধারা প্রবাহমান রাখিতে এই দুইয়ের মিলন অতি আবশ্যক। যদিও আজকাল ইহার আবশ্যকতা, সংখ্যায় কম হইলেও, লাগেনা বলিয়া মিডিয়ার কল্যাণে জানা যাইতেছে। নিয়মের এই সামান্য ব্যাতিক্রম ছাড়া নারী পুরষের দাম্পত্য বন্ধন প্রাকৃতিক, শাশ্বত ও ধর্মীয়। তাই বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা সর্বব্যাপী ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। যদিও দেশে দেশে বিবাহ-বহির্ভূত সংসার ডালপালা বিস্তার করিতেছে।

বিজ্ঞাপন

বস্তুত: নারী পুরুষের এই দাম্পত্য বন্ধনের মূল সূত্র হইলো দায়িত্ববোধ, পরস্পরের প্রতি গভীর বিশ্বাস আর প্রগাঢ় মমত্ববোধ। দাম্পত্য বন্ধনে প্রবেশের প্রাথমিক স্তরে প্রেম-ভালোবাসা একটি অনুষঙ্গ হইতে পারে। আরেকটি হইতে পারে ভবিষ্যতের সংসার গড়িবার উদগ্র বাসনা। প্রেমের বিবাহতে অর্থবিত্ত খুব একটা বিবেচ্য থাকে না। আবার থাকিতেও পারে। কিন্তু আয়োজনের মাধ্যমে সম্পাদিত বিবাহে উপযুক্ততা, নিরাপত্তা, অর্থবিত্ত ইত্যাদি নানা উপাদান সংশ্লিষ্ট থাকে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রশ্ন দেখা দিয়াছে নারী তাহা হইলে কিসে আটকায়?

মানুষ স্বভাবগতভাবেই সৌন্দর্যের পূজারী। এই স্বভাব হইতেই সে আপনার করিয়া যাহাকে পাইবার চায় তাহার মধ্যে সৌন্দর্য খুঁজিয়া বেড়ায়। কথায় আছে আগে দর্শনদারি পরে গুণ বিচারী। কথাটা দশে দশ। তবে পছন্দের অগ্রাধিকার তালিকায় দ্বিতীয় ধাপে থাকা গুণ সমূহ সমাজ বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রেই বিবেচ্য হইয়া উঠে। ইহাতে সামাজিক অবস্থা, বিত্ত-বৈভব, খান্দান, নিরাপত্তা ও শিক্ষা-দীক্ষা বড় হইয়া দেখা দেয়। পুরুষ কিসে আটকায় ইহা লইয়াও কেহ কেহ পাল্টা চাল চালিতেছেন। ইহা অতি সহজ বিষয়। পুরুষ তাহার মনের মত নারীতেই নিজেকে সঁপিয়া দেয়। তাহার জন্যই সে নিয়মানুগ হয়, বিশ্বস্ত থাকিতে তৎপর থাকে, প্রতিনিয়ত ‘দায়িত্ববোধ’ মাথায় বহিয়া বেড়ায়। আর প্রিয় মানুষটির মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে। ইহার জন্য সে ধন-দৌলত কামাইতে থাকে। পদ-পদবীতে উপরে উঠিতে সচেষ্ট থাকে। সমাজে তাহার অবস্থান সুসংহত করিতে চাহে। আর এর সব কিছুই সে করিয়া থাকে তাহার প্রাণের প্রিয় নারীকে সন্তুষ্ট রাখিতে।

মূলত: পুরুষ আটকায় তাহার রিপুর কাছে পরাজিত হইয়া। একাধিক নারীতে মজিয়া, নীতি-নৈতিকতা বহির্ভূত কর্মে বেপোরোয়া হইয়া আর যথেচ্ছাচার জীবন যাপনে মত্ত থাকিয়া। কিন্তু নারী? নারী আটকায় না, লাগিয়া থাকে। এক পুরুষেই তাহার স্বপ্নসাধ, এক সংসারেই তাহার ধ্যান-জ্ঞান, স্বামীর উপার্জনেই তাহার নিপুণতা। এইসবকে পুঁজি করিয়াই নারী এক পুরুষে লাগিয়া থাকে। ইহার মধ্যে এক চিমটি বঞ্চনা, এক চিমটি সাংসারিক যাতনা, এক চিমটি পরাধীনতা, এক চিমটি অবজ্ঞা, অবমূল্যায়ন, পক্ষপাতদুষ্ট পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী ইত্যাদি মিশ্রিত থাকে। অন্য পাল্লায় আপন গৃহ, নিরাপত্তা, আস্থা, বিশ্বাস, মায়া, সন্তান, সংসার, ভবিষ্যতের দ্যুতি তাহার সমস্ত দু:খ ও মনোকষ্টকে নিমিষেই দূর করিয়া দেয়। যেসব নারী দৌড়াইতে পছন্দ করে, জলতরঙ্গে খুব সহজেই উদ্দীপিত হইয়া পড়ে, জানালার বাহিরের আলোকে দ্যুতি ভাবিয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে, স্বাধীনতাকে জীবনের একমাত্র সার্থকতা ভাবে তাহারাই বাহিরের ঋতুচক্রের ষড়যন্ত্রের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় আকৃষ্ট হইয়া থাকে। সেখানেই তাহারা ধরা দেয়, ধরা খায়। অতি সাম্প্রতিক নারীবাদী প্রপাগান্ডায় অনেকে মোহিত হইয়া বিভ্রান্ত হইয়া পড়িতেছে আবার নারী স্বাধীনতার কদর্থ করিয়া সাহসী হইয়া উঠিতেছে। নারীর আটকাইয়া ধরা খাইবার মূলে রহিয়াছে তাহার “যাহা পাই তাহা চাই না, যাহা চাই তাহা পাইনা” জাতীয় অতৃপ্তিবোধ। এই চিন্তনের মিমাংসা করিতে পারেনা বলিয়াই তাহারা দুর্গম পথ মাড়াইতে গিয়া আটকাইয়া যায় ও ধরা খায়।

এই প্রসঙ্গে নেট দুনিয়ার কল্যাণে, স্থুল বিশ্লেষণে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশা হইতে কিছু কথা উঠিয়া আসিয়াছে। ইহার মধ্যে রহিয়াছে পুরুষের রূপে নয় নারী আটকায় পুরুষের অর্থবিত্তে, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতায়, পরশ্রীকাতরতায়, বলিউড ঘরানার রোমান্টিকতায় আর নষ্টামীতে। এক মহিলা ইউটিউব কন্টেন্ট ক্রিয়েটর বিষোদগার করিয়া বলিয়াছেন যে, নারী আসলে আটকায় পুরুষের ছ্যাঁচড়ামিতে, লুতুপুতু প্রলোভনে। বোধকরি আজকালকার পরকীয়া ক্রাইসিসের কারণেই তাহার এই উপলব্ধি।

মিডিয়া এইখানে এন্টি হিরোর ভূমিকা লইয়াছে বলিয়াও কেহ কেহ মনে করেন। তাহারা যে কোন কারণেই হউক উগ্র নারীবাদীদের লাইম লাইটে আনিয়া শিকল ভাঙার স্লোগান তুলিয়া স্বেচ্ছাচারী স্বাধীনতাকেই পরম সুখের ও জন্মের আসল সার্থকতা হিসাবে তুলিয়া ধরিতেছে। পারিবারিক শাসন শিথিল হইয়া পড়িয়াছে। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শাসন কোন ভূমিকা রাখিতে পারিতেছে না। শিক্ষা আমাদেরকে স্মার্ট করিলেও সুশিক্ষিত করিতে পারিতেছে না। প্রগতিশীল ও বুদ্ধিপরজীবিদের সুবিধাবাদ তত্ত্বের গ্যাঁড়াকলে পড়িয়া ধর্মীয় মূল্যবোধ ‘সেঁকেলে’ ও ‘পশ্চাৎপদ’ তকমা পাইয়া উপেক্ষাযোগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতেছে। ফলতঃ কাহারো কোন কিছুতে দায়বদ্ধতা নাই। সবাই স্বেচ্ছাধীন হইয়া পড়িয়াছে।

বৈশ্বিক ঢেউ বিশ্বের সব প্রান্তের নারীকূলকে একই রঙ্গে রাঙ্গাইতে সর্বক্ষণ চেষ্টা করিতেছে। নারীর ভেতরের সৌন্দর্য নয়, বাহিরের চাকচিক্য, গ্লো-কেই মুখ্য রূপে ফুটাইয়া তুলিতে তৎপর রহিয়াছে। সমানাধিকারের নামে অগ্রাধিকারের চর্চা হইতেছে। আজকাল শিকল ছিন্নকারী কিছু নারী যেন তাবত নারীকূলের ‘মডেল’ হইয়া উঠিয়াছে। তাহারা হ্যামিলনের বংশীবাদকের মত মোহিনীশক্তিতে নারীদেরকে বচনে, বসনে, আহারে, বিহারে, ব্যাবহারে, ধ্যানে, জ্ঞানে, বিজ্ঞাপনে, বিনোদনে, সাহসে, বাহাসে মোহাবিষ্ট করিয়া ফেলিতেছে। এক শ্রেণীর পুরুষের বাণিজ্যিক ও অনৈতিক ফায়দার ফাঁদে পড়িয়া তাহারা যত্রতত্র ধরা দিতেছে। আর এই আটকাইয়া যাওয়ার ঘটনা যখন আইকনদের, সুপার স্টারদের, ধনকুবদের, ক্ষমতাবানদের অমিত শক্তিকেও ধরাশায়ী করে তখনই সর্বত্র প্রশ্ন উঠে নারী কিসে আটকায়? আসলে নারী আটকায় না। ধরা দেয়।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম নারী আটকায় না- ধরা দেয় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর