পাসপোর্ট অফিসের কাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে। কয়েক কোটি লোকের শহর ঢাকায় পাসপোর্ট করার জন্য ছিল একটিমাত্র অফিস। সরকার কয়েক মাস আগে ঢাকায় পাসপোর্টের জন্য অঞ্চলভিত্তিক ছয়টি অফিস করে দিয়েছে। আগারগাঁও অফিস তো আছেই। আজ পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছিলাম কন্যার পাসপোর্ট করতে। ১০ মিনিটেই কাজ হয়ে গেল! বছর খানেক আগে যারা পাসপোর্ট অফিসে গিয়েছেন, তাদের কাছে মনে হবে অভাবনীয়! অবিশ্বাস্য! গত বছর আমার পাসপোর্ট নবায়ন করতে গিয়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। করোনাকালে স্ত্রী ও পুত্রের পাসপোর্ট করতে গিয়ে ভুগতে হয়েছিল বেশ। একে তো করোনার ভয়, তার ওপর অসহনীয় ভিড়। আমরা যে করোনার চেয়ে শক্তিশালী, সেটা পাসপোর্ট অফিসে গিয়েও বুঝেছিলাম। সেই সময় সে কী অবর্ণনীয় কষ্ট আর যন্ত্রণা দেখেছি বৃদ্ধ, শিশু, নারী, শারীরিকভাবে অসুস্থ আর ক্লান্ত মানুষদের চোখে-মুখে। আর দালালদের দৌরাত্ম্য তো ছিলই। বহু বিলম্বে এবং অগণিত মানুষকে অমানবিক কষ্ট দিয়ে হলেও একটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে সরকার ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে ধন্যবাদ জানাই।
কীভাবে এতটা বদলে গেল? উত্তর খুব সোজা। বিকেন্দ্রীকরণ করে। সকাল নয়টায় কার্যক্রম শুরু হয় পাসপোর্ট অফিসের। অথচ মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে যেত সকাল ছয়টা-সাতটা থেকে। প্রকৃতির সমস্ত বৈরিতা উপেক্ষা করে আমাদের অসংখ্য রেমিট্যান্স যোদ্ধাসহ সব বয়সী মানুষ অপেক্ষা করেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পাসপোর্ট অফিসের গেট থেকে অন্তত এক কিলোমিটার দীর্ঘ সারি হতো প্রতিদিন। অর্থাৎ অফিস শুরুর দুই থেকে তিন ঘণ্টা আগে থেকে মানুষের অপেক্ষা শুরু হতো, আর অফিস শুরুর পর আরও প্রায় চার ঘণ্টা লেগে যেত কাগজপত্র যাচাইবাছাই, ছবি তোলা ইত্যাদি করতে করতে। গেট খুলে দেওয়ার পর আনন্দের চেয়ে ধাক্কাধাক্কি, কার আগে কে এসেছে, কে আরেকজনকে টপকে যাচ্ছে, এমন বাতচিত করতে করতে ঘণ্টা দুই পেরিয়ে যেত। এরপর আসত ভেতরে প্রবেশের সুযোগ। সেই আনন্দ মিইয়ে যেত মুহূর্তেই। ওখানে যে ভিড় আগের চেয়েও বেশি! শুরু হতো যেন অন্তহীন দাঁড়িয়ে থাকা।
এর মধ্যে দেড়-দুই হাজার টাকা, ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি দিয়ে যারা দালাল ধরত, তারা খুব অনায়াসে পাসপোর্টের কাজটাজ করে, নিজেকে ক্ষমতাবানদের একজন ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে যেত। এই সব চেয়ে চেয়ে দেখতে হতো আমাদের মতো- ঘুষ খামুও-না দিমুও-না ধরনের মানুষদের। কোথাও কোনো অভিযোগ দেওয়া যেত না। আর জনবলের তুলনায় চাপ বেশি থাকায় পাসপোর্ট অফিসের দায়িত্বরত বেশির ভাগ লোকের মেজাজ থাকত সপ্তমে। ফলে সহযোগিতার চেয়ে অসহযোগিতা পাওয়া যেত বেশি। সুতরাং ভোগান্তি ছিল অনিবার্য। আর কাগজপত্রে যদি কোনো ভুল থাকে, তাহলে তো….।
মুক্তি কীসে, সংযুক্তিতে নাকি বিযুক্তিতে?
কোনো নতুন থিওরি নেই কিন্তু। যে থিওরিতে পাসপোর্ট অফিসকে ভিড় ও যন্ত্রণামুক্ত করা হয়েছে, ঠিক একই থিওরিতে ঢাকা শহরকেও যানজটমুক্ত, ভিড়মুক্ত, দূষণমুক্ত নিরাপদ নগরী হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। থিওরিটা আর কিছুই না। সবধরনের প্রয়োজনে মানুষের ঢাকায় না আসার টেকসই ব্যবস্থা করতে হবে।। এর জন্য প্রয়োজন সবকিছুর বিকেন্দ্রীকরণ। ঢাকাকে বাঁচাতে হলে বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই। নইলে অসুস্থ নগরীটা অচিরেই বিকলাঙ্গ নগরীতে পরিণত হবে। বিনোদন কেন্দ্রে যাওয়ার চেয়ে, পার্কে যাওয়ার চেয়ে এই নগরে হাসপাতালে যাওয়ার বন্দোবস্তটা পাকাপোক্ত করা হয়েছে। ফলে লাভ আর লাভ!
পাসপোর্ট অফিস আগারগাঁওকে ভিড়মুক্ত করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন এই অধিদপ্তরটি উত্তরা, সেনানিবাস, আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, সচিবালয় জোনে ভাগ করেছে। ফলে এক ফুৎকারে দূর হয়ে গেছে সমস্ত যন্ত্রণা, অসহনীয় কষ্ট।
ধরা যাক, এই উদ্যোগ না নিয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ এই ছয়টি অঞ্চলের থেকে আগারগাঁও অফিসে আসার জন্য ছয়টি বড় বড় উড়াল সড়কের ব্যবস্থা করেছে! তাহলে কী হতো? এর সাথে যুক্ত কত অফিস আর অধিদপ্তর যে ঠিকাদার, কমিশনখোরদের মাধ্যমে লাভবান হতো! সবারই বাড়বাড়ন্ত হতো বিপুলভাবে! সবদিকে ব্যবসা হতো রমরমা; আর ভিড়ের বাড়বাড়ন্ত হতো সবচেয়ে বেশি।। উড়াল সড়ক দেখতে বড়ই নয়নপ্রীতিকর। কিন্তু পাসপোর্ট অফিস যদি সত্যিই সেটা করত, তবে জনগণের কাছে সেটা একটা ‘বিষবিরিক্ষের ফলে’ পরিণত হতো। যেমনটা আমরা ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে দেখছি। ঢাকার সাথে বিভিন্ন সড়কপথে, সেতুপথে সংযোগ বাড়িয়ে মানুষকে ঢাকায় প্রবেশের অবারিত সুযোগ করে দিচ্ছে। যদিও একবার এই জাদুর শহরে ঢুকলে নিরুপায় হয়ে আটকে যায় সবাই। কিন্তু ঢাকা থেকে মানুষ বের কেন হয় না? বের হলে কোথায় যাবে, গিয়ে কী করবে, তার কোনো পরিকল্পনা রাষ্ট্রপরিচালানার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গ নেবে বলে মনে হয় না। অর্থাৎ ঢাকার কেন্দ্রীয় সুবিধাকে কী করে বিকেন্দ্রীকরণ করা যায়, সেটা নিয়ে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো মোটেও ভাবছে না। ভাবছে ঢাকাকে কতটা ‘ফলপ্রসূভাবে’ সংযুক্ত করা যায়। অথচ করা দরকার বিযুক্ত।
লেখক: প্রভাষক, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি