Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সি আর দত্ত বীর উত্তম: আমৃত্যু সংগ্রামী এক দেশপ্রেমিকের নাম

মানিক লাল ঘোষ
২৫ আগস্ট ২০২৩ ১৪:২৮

বাংলাদেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং সমঅধিকার ও সমমর্যাদা আন্দোলনের সূচনাকারী চিত্তরঞ্জন দত্ত বাংলা মায়ের এক বীর সন্তানের নাম। সাহসী দেশপ্রেমিকের নাম। অন্যায় আর অবিচারের বিরূদ্ধে প্রতিবাদে জেগে উঠার নাম। কিন্তু এই নামটি এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা, তবে সিআর দত্ত বীর উত্তম সেই নামটির সাথে আমাদের পরিচয় যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করি, বহন করি কিংবা ইতিহাসকে জানতে চাই। তার মতো এমন একজন সাহসী বীরের সাফল্যগাঁথা সংগ্রামী জীবনী হতে পারে আগামী প্রজন্মের দেশপ্রেমের, অনুপ্রেরণার উৎস।

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালের ২৫ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন দেশবরেণ্য এই বীর সৈনিক। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৩ বছর। তিনি বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। মেজর জেনারেল (অব.) সি আর দত্ত মুক্তিযুদ্ধের ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

সিআর দত্ত বীর উত্তমের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের শোক প্রকাশের ভাষা এবং তার অবদান নিয়ে তাদের স্মৃতিচারণে বোঝা যায় কী অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তার না ফেরার দেশে চলে যাওয়ায়। করোনা সংক্রমণকালে নানা প্রতিবন্ধকতায় তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে দল মত জাতিভেদ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের বাঁধ ভাঙা জোয়ার প্রমাণ করে তিনি কতটা আপন ছিলেন সবার। আজীবন মানুষকে ভালবাসতেন ও শ্রদ্ধা করতেন বলেই তার প্রতি ও ছিল সবার অতল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাই তো শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অনন্য অবদান দেশ ও জাতি চিরদিন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে সংখ্যালঘুরা বিশেষ করে হিন্দুরা পাকিস্তানি সেনা আর তাদের দোসরদের কাছে ছিল গণিমতের মাল। সেই দিনগুলোতে যেখানে দেশে থাকাই কষ্টদায়ক হয়ে গিয়েছিল, যেখানে প্রাণ বাঁচাতে সংখ্যালঘু অনেকেই পার্শ্ববর্তী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে সি আর দত্ত নিঃসন্দেহে একটি বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য।

পাকিস্তান ব্যুরোর জরিপে জানা যায়, এই দেশে জনসংখ্যার মোট ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ ছিল সংখ্যালঘু। ১৯৭০ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সেই হার নেমে এসে দাঁড়ায় ২১ থেকে ২২ শতাংশে। অর্থাৎ ৭ শতাংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী হারিয়ে গেল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ২৪ বছরে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হলে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হত্যা করতে হবে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে করতে হবে ভিটে ছাড়া। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দেশত্যাগ করাতে প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগের। হত্যা-ধর্ষণ, জমি দখল থেকে শুরু করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে যত প্রচেষ্টা আছে সব ধরনের। এই অভিপ্রায়ে পাকসেনারা তাদের দোসরদের নিয়ে অত্যাচারের স্টিম-রোলার চালায় সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। মেতে ওঠে পৈশাচিক গণহত্যায়।

বিজ্ঞাপন

একাত্তরের পরাজিত শক্তির সংখ্যালঘু হ্রাসকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশে একটি গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের সংকট তৈরি করার প্রক্রিয়া দীর্ঘদিনের। তাদের ভাবনা যদি সংখ্যালঘুদের তাড়িয়ে দেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র করাও সহজতর হবে। সেই দৃষ্টিতে সি আর দত্তের তৎকালীন সিদ্ধান্ত ও অবদান নিঃসন্দেহে সাহসী ছিল। তিনি নিজে শুধু মুক্তিযুদ্ধে অবদানই রাখেননি বরং তার সাহসিকতা ও দেশপ্রেম দেখে সংখ্যালঘুরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রেরণা পেয়েছিল।

দেশবরেণ্য এই কৃতিমান দেশপ্রেমিক চিত্তরঞ্জন দত্ত ১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি আসামের শিলংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। কিন্তু বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত পুলিশ অফিসার হওয়ায় চাকুরির কারণে পরিবার থাকতো শিলংয়ে। মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত। তারা পাঁচ ভাই ও দুই বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। সি আর দত্তের ডাক নাম ছিল রাখাল। ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত সাহসী ও দুরন্ত ছিলেন তিনি।

শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। পরে তার বাবা চাকরি থেকে অবসর নিয়ে হবিগঞ্জে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে ১৯৪৪ সালে তিনি মাধ্যমিক পাস করেন। পরে কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন তিনি। এরপর খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন। পরে এই কলেজ থেকেই বিএসসি পাস করেন।

শিক্ষাজীবনে চৌকষ ছিলেন চিত্ত রঞ্জন দত্ত। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে শুরু করেন কর্মজীবন। কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেনেন্ট পদে প্রমোশন পান তিনি। ১৯৬৫ সালে সৈনিক জীবনে প্রথম যুদ্ধে লড়েন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটি কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। ওই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে পুরস্কৃত করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রথম ও একমাত্র বাঙালি হিন্দু অফিসার ছিলেন তিনি।

সি আর দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হিসেবে কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৮২ সালে তিনি পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। ১৯৮৪ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। পাকিস্তান আর বাংলাদেশ নয়, যখন যেখানে তাকে যেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সততা, আন্তরিকতা, সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের সাথে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ইতিহাস মুছে ফেলার যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলে তার ধারাবাহিকতায় সিআর দত্তের মতো বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা অবদান এই প্রজন্মের আমরা অনেকেই জানি না।

১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাস। ছুটি নিয়ে পাকিস্তান থেকে তিন মাসের ছুটিতে হবিগঞ্জে এলেন সিআর দত্ত। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিক্স ফ্রন্টিয়ার্সের বেঙ্গল সিনিয়র মেজর। চারদিকে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা। পাকিস্তানের শোষণ-শাসন আর নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে পথ খুঁজছে সবাই। ৭ মার্চ হবিগঞ্জে বসে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতা-সংগ্রামের অমর কবিতা, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ এই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আর পাকিস্তানে ফিরে গেলেন না। বাংলা মাকে পাকিস্তানের শাসন-শোষণের বেড়াজাল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন সিআর দত্ত। দেশমাতার সম্মান রক্ষায় মরণপন শপথ নিয়ে হবিগঞ্জ মৌলভীবাজার প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন। এরপর সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল খোয়াই শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তরদিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ৪ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন সিআর দত্ত। দায়িত্ব নিয়েই প্রথমে সিলেটের রশিদপুরে ক্যাম্প তৈরি করেন তিনি। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চা বাগান থাকার সুবাদে আড়াল থেকে শত্রুদের ঘায়েল করেন দ্রুত সময়ে। পরে তিনি রশিদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজার ক্যাম্প স্থাপন করেন। তার অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে তার এমন অবদান অবশ্যই তাকে স্মরণীয় বলা যায়।

ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়। ব্যক্তি জীবনে তার চাওয়া-পাওয়ার কোনো অপূর্ণতা নেই। কিন্তু একটা বড় ধরনের কষ্ট নিয়ে মারা গেছেন সিআর দত্ত। দেশ জাতির কল্যাণে আজীবন নিবেদিত তিনি সব সময় লড়াই করেছেন অসাম্য নিপীড়নের বিরুদ্ধে। এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সিআর দত্ত গঠন করে গেছেন ‘বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ’। এখানেই তার যত কষ্ট ও অভিমান। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কখনো ভাবিনি আমাকে এই দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য লড়াই করতে হবে। আমৃত্যু বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি।

কোনো চিন্তাশীল ও বিশিষ্ট নাগরিক এর প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উপায় হচ্ছে তার চেতনাকে লালন করা ও বাস্তবায়ন করা। সম্প্রীতির এই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সবসময় সকল ধর্মের মানুষের সমান অধিকারে বিশ্বাসী। তারপরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নানান ভাবনার জন্ম দেয়। সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠীর সকল অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার থাকতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার সুরক্ষায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সকল ইতিবাচক পদক্ষেপে বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত সিআর দত্ত বীর উত্তম এর অতৃপ্ত বাসনা ও স্বপ্নপূরণ হবে এই বিশ্বাস আমাদের সকলের। তৃতীয় প্রয়াণ দিবসে অতল শ্রদ্ধা তার স্মৃতির প্রতি।

লেখক: সহ-সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ এর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক

সারাবাংলা/এজেডএস

মানিক লাল ঘোষ সি আর দত্ত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর