Saturday 12 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চলুন সবাই নিদ্রা যাই

আনোয়ার হাকিম
২৮ আগস্ট ২০২৩ ১৬:৩৭

ঘুম লইয়া নানা গীত, নানা কথা, নানা কাহিনী চালু আছে। কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া সকলেরই এক আর্তি, ঘুম আসে না। ঘুমের জন্য কত জন যে কত পেরেশান তাহা সবাই কমবেশি জ্ঞাত। শিশুরা ফেরেস্তা তুল্য। তাহারা চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে পারলে আঠারো ঘন্টাই ঘুমাইয়া কাটায়। যৌবন কালে পাঁচ-ছয় ঘন্টা ঘুম কাফি। বয়সকালে আট-নয় ঘন্টা ঘুম জরুরি। কিন্তু সমস্যা একটাই, ঘুম আসে না। পেরাশান হয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ওষুধ মিলে কিন্তু তাতে ঘুমের কষ্ট আরও বাড়ে। নার্ভ শিথিল হলেও কেন জানি ঘুম আসে না। আসিলেও ক্ষণে ক্ষণে ভাঙিয়া যায়। ইহা লইয়া বয়ষ্কদের জীবন দুর্বিষহ হইয়া উঠে।

যৌবনে ঘুমের জ্বালা আরেক প্রকার হইয়া থাকে। ঘুম আসে না কারণ নানা কথা ভাসিয়া আসে। নানা কল্পনা, জল্পনা লইয়া চিন্তাভাবনা ডালপালা মেলিয়া চলে। প্রেমিক-প্রেমিকার চোখে ঘুম নাই। রাত-বিরাতে আনলিমিটেড টক তো আছেই। কত শত স্বপ্ন আছে। দিবা স্বপ্নই বলা যায়। কত প্ল্যান, কত ঘটনা, রটনা তাড়াইয়া লইয়া বেড়ায়। কত চাপ, কত তাপ সইতে হয়। কত সমীকরণ, কত কৌশল, কত নছীহত, কত চাপা, সত্য-মিথ্যা মিশ্রিত কত আশ্বাস, কত শপথ, কত অ্যাডজাস্টমেন্ট করিয়া ও নাকে খত দিয়া যে চলিতে হয় তাহা ভুক্তভোগী প্রেমিক-প্রেমিকারাই জানে। উহার ওপর রহিয়াছে পারিবারিক-সামাজিক ভীতি, আড়াল-আবডাল খেলা। মানিয়া না লওয়ার আল্টিমেট শঙ্কা। কপালে থাকিলে বাংলা আর হিন্দী সিনেমার মত এক লায়লা, অনেক মজনু জাতীয় চতুর্মাত্রিক প্রেক্ষাপটে ঢিসুম ঢিসুম দৌড়ঝাঁপ, মারামারি, ফন্দিফিকির, ছলচাতুরী। সবার উপরে কঠিন বাস্তবতা চাকরির ধান্ধা। এই সব লইয়া যাপিত জীবন ত্যানা ত্যানা হইয়া যায়। শরীর আর মনের নার্ভে টান পড়ে। ক্লান্তি আর শ্রান্তিতে দেহ বিছানা লয়। কিন্তু ঘুম আর আসে না।

বিজ্ঞাপন

কর্মজীবিদের দশ মাত্রার টেনশন জীবনব্যাপী। ভূমিকম্পের স্থায়িত্ব ক্ষণস্থায়ী। কিছু মুহুর্ত নাড়াচাড়া দিয়া শান্ত হইয়া যায়। ক্ষয়ক্ষতি কিছুমিছু রাখিয়া যায় সত্য। কিন্তু টেনশনের কোন কাল নাই, ক্ষণ নাই, হাওয়া হইয়া যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। জগদ্দল পাথরের মত মিশিয়া থাকা এই টেনশনের এতটুকু লয়-ক্ষয় নাই। অফিসের প্যারা বহুমুখী, সংসারের প্যারা চতুর্মুখী, বাজারের প্যারা উর্ধ্বমুখী। মানিয়া চলা আর মানাইয়া চলার প্যারা আরেক কিছিমের। খরচের খাত ক্রমে ক্রমে বাড়ে। আয়ের খাত ক্রমশ: হ্রাস পায়। এই দুই সতীনের কোন দিন মিলমিশ হয় না। ব্যায়ের উৎস মুখ অপ্রতিরোধ্য গতিতে নিত্যনতুন নানা উছিলা তৈরি করিয়া থাকে। এই লইয়া সংসারে ক্যাচাল। বাহিরে দাপাদাপি, খামছাখামছি, রাগারাগি, গুঁতাগুঁতি, লুটপাট, চুরিচামারি, রাহাজানি আর ছিনতাই। এত সবের মধ্যে ঘুম আসে কি করিয়া? ডাক্তার রাত দশটার মধ্যে ঘুমাইবার চেষ্টা করিবার কথা বলিয়া খালাস। ইহার জন্য ওষুধ লিখিয়া দেন। ঘুম তাহার অনুশাসন আর পথ্যকে থোরাই কেয়ার করে। যত আয়োজনই করেন না কেন, ঘুম আসে না। এইভাবে চলিতে থাকিলে বায়ুচড়া হইতে সময় লইবে না। ঘুমহীন জীবন দোযখ তুল্য। কেবল তখনই বুঝা যায় যে, ঘুম মহান আল্লাহর অশেষ নিয়ামত।

ঘুমেরও নাকি প্রকারভেদ আছে। মনোবিজ্ঞানীরা কীসব বলিয়া থাকেন। ডাক্তাররাও বলেন। ছোটবেলা হইতেই তন্দ্রার কথা শুনিয়া আসিতেছি। কেউ আবার কাক ঘুমের কথা বলিয়া থাকেন। কেউবা ভাত ঘুমের কথা বলেন। আবার পাতলা ঘুমের কথাও শুনা যায়। ঘুমেরও নাকি ঘনত্ব পরিমাপ করা যায়। বড় বড় অত্যাধুনিক হাসপাতালে নাকি এইরূপ মেশিন আছে। রোগীকে ঘুম পাড়াইয়া তাহার ঘুমের ঘনত্ব পরিমাপ করা হইয়া থাকে। ঘুম লইয়া যে এত ক্যাচাল আগে এত শুনা যাইত না। এখন হামেশাই শুনা যায়। আজকাল ছোটদেরও ঘুম আসে না। তাহাদেরও অনেক কাজ, নানাবিধ টেনশন। স্কুলের চাপ, প্রাইভেট টিউটরের হোমওয়াার্ক, প্লেস্টেশনের উত্তেজনা, মোবাইলের রঙিন ঝলকানি, এক্সট্রা কারিকুলার এক্টিভিটিজ, মৌজমাস্তি, বন্ধুবান্ধব আরো কত কি! সময় কই ঘুমাইবার? চাইলেই তো আর ঘুম আসে না। অথচ আমাদের ছেলেবেলায় বই লইয়া পড়িতে বসিলেই ঘুম আসিত। সেই ঘুমের জন্য বাবার মাইর খাইয়াছি কত! শিক্ষকের চড় থাপ্পড় ছিল নিয়মিত। তখন সব কাজ করিয়াও ঘুমাইবার অঢেল সময় পাওয়া যাইত। বড়রাও রুটিন করিয়া নিদ্রা যাইতেন। প্রচন্ড গরমেও ফ্যান, এসি-বিহীন আবহাওয়ায় তাহাদের ঘুমের ঘনত্ব মাপিবার আবশ্যকতা ছিলনা। তাহাদের নাসিকার গর্জনই বলিয়া দিত তাহারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ইহার জন্য দাওয়াইয়ের কথা কল্পনাও করা যাইত না।

যুগ পাল্টাইয়াছে। জীবন যাত্রার ব্যাকরণ বইয়ের নতুন সংস্করণ প্রবর্তিত হইয়াছে। সবাই মিলিয়া-ঝিলিয়াই উহা রচনা করা হইয়াছে। আমরাও উহাকে অন্ধ ভাবে অনুকরণ ও অনুশীলন করিতেছি। যত কিছুই করিতেছি, ঘুম অধরাই থাকিয়া যাইতেছে। ইহার কারণ কি? ইহা সমাজ বিজ্ঞানীদের কাজ। যাহারা নতুন ব্যাকরণ বইয়ের অনুসারী তাহাদেরও ঘুম-সংকট প্রবল। তবে ইহা তো লব্ধ সত্য যে, টেনশনই ইহার মূল আসামি। যাহাদের আয়ের খাত কম অথচ চোখের আর মনের ক্ষুধা বেশি তাহাদের এই ক্রাইসিস প্রবল। আবার যাহাদের আয়ের উৎমুখ স্বতঃস্ফূর্ত ও ¯্রােতস্বিনী তাহাদের কি থুইয়া কি করিলে সুখ বোধ হইবে ইহার যাতনায় টেনশন নাচানাচি করিয়া থাকে। আর যাহাদের আছে কম, চাই চাই খাই খাই কম তাহাদের ঘুম লইয়া টেনশন কম। আর যাহাদের কিছুই নাই তাহারা দিনে রাতে শুইলেই ঘুমাইয়া পড়ে। চাই সেটা ফুটপাতে বা খোলা আকাশের নিচে। সে যাহাই হোক না কেন, ঘুম অতীব জরুরি। কি করিলে ইহা সহজলভ্য হইবে তাহা বাহির করাই এখন ফরজ হইয়া পড়িয়াছে।

বলা যতটা সহজ করা ততোধিক কঠিন। ইহাই বাস্তব। তবে কখনো কখনো গতিতে ব্রেক কষিতে হয় ইহাই নিয়ম। আমরা গতিতে ভর করিয়া কোথায় চলিতেছি জানি না। তবে বৈশ্বিক আদলে নিজেকে শতভাগ না রাঙ্গাইয়া দেশীয় সিলেবাস প্রণয়ন করা যে জরুরি তাহা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর কত লক্ষ কোটি টাকা লোপাট করিলে, পাচার করিলে, ব্যাংকের ভল্ট হাল্কা করিলে আমাদের গতি কিছুটা হ্রাস পাইবে? আর কত দৌড়ঝাঁপ, কোপাকুপি, হণন-ক্ষরণ হইলে আমরা এক্সলেটর হইতে পা তুলিব? আর কত স্বাপ্নিক, সর্বভুক খাদক হইলে আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলিয়া আয়েসি নিদ্রা যাইবো?

আমাদের চরম ও পরম আনন্দ আছে, বেদনা-যাতনার তীব্রতাও আছে। আমাদের বিত্ত-বৈভব আছে, নাম-যশ, পদ-পদবী আছে, সুখ্যাতি-কুখ্যাতি আছে, পাওয়া না পাওয়ার বেদনা আছে, প্রেম আছে বিরহ আছে, রাগ-অনুরাগ-বিরাগ আছে। বলা চলে অঢেলই আছে। নাই শুধু সুখ নিদ্রা। আসুন নিজের প্রেসক্রিপশন নিজেই করি। ঘুমকে টার্গেট করিয়া অন্যান্য উপসর্গ গুলাকে খানিকটা চাপিয়া রাখিয়া, কাটছাট করিয়া ঘুমের মাত্রাকে খানিকটা বাড়াইবার জন্য প্রয়াসী হই। আজ যাহা স্ত্রী-পুত্র-কন্যার নাম দিয়া করিতেছি দম ফুরাইলে ইহার বা ইহাদের কী দশা হইবে উহা জানিবারও কোন ব্যবস্থা থাকিবে না। এত এত টেনশনও থাকিবে না। কী লাভ এত পাগলপারা হইয়া?

অনেকের আবার কিছু বিষয় লইয়া বড় বেশি আগ্রহ দেখা যায়। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি দুর্বলতা থাকে। কাহারো থাকে ব্যবসা-বাণিজ্য-অর্থনীতিতে। অনেকের নেশা রাজনীতি-সমাজনীতিতে। কারো প্রশাসনে-উন্নয়নে। লাভ নাই। বিষয়ভিত্তিক এইসব সেক্টর লইয়া গুটিকয়েকের লাভালাভ আর প্রতাপ প্রবল। সিন্ডিকেট কারবারে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশের প্রচেষ্টা ধর্তব্য অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। বেশি হেডম দেখাইতে গেলে চারিদিকে অন্ধকার ভিন্ন আলোর দেখা মিলিবে না। তবে ইহাদের সহিত মিশিয়া যাইতে পারিলে, ইহাদের অতি ক্ষুদ্র একজন খেদমতগার হইতে পারিলে অন্য কথা। তাই, অল্প পানির মাছের গভীর পানিতে বসবাসের খায়েস না থাকাই ভালো। হইলেই বিপদ ভীষণ। প্রেসার নাচানাচি করিবে, সুগার জ্বালাতন করিবে, হৃৎপিন্ডের পাম্প-শক্তি হ্রাস পাইবে। শ্বাস যন্ত্র ব্রেক ফেল করিবার মত উৎপাত করিবে। সবই টেনশন বাড়াইবার পক্ষে অতীব কার্যকর। কী লাভ চারিদিকে চোখ-কান এত ঘুরাইবার, এত নাক গলাইবার, এত গন্ধ শুঁকিবার? তাহার চাইতে নিদ্রাই উত্তম। জাগরণে সুখ নাই। তাই বলি, আসুন সবাই নিদ্রা যাই।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম চলুন সবাই নিদ্রা যাই মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর