ইলিশের দেশে ইলিশের অগ্নিমূল্য
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:২০
মাছের রাজা ইলিশ। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। স্বাদে-গন্ধে অদ্বিতীয় এই রুপালি মাছ। ইলিশ আমদের সম্পদ। এক সময় দেশের সব ধরনের পেশার মানুষই ইলিশের মৌসুমে অন্তত পাতে তুলতে পারতো। ছেলেমেয়ে নিয়ে খেতে পারতো। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে ইলিশ চলে যাচ্ছে সাধারণ আয়ের মানুষের হাতের নাগালের বাইরে। বাজারে যে ইলিশ নেই তা নয়, পর্যাপ্ত ইলিশ ধরাও পরছে জেলেদের জালে কিন্তু নিম্নবিত্ত মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরেই থেকে যাচ্ছে এর দাম। এমনকি মধ্যবিত্তও কালেভদ্রে ইলিশের স্বাদ নিতে সক্ষম। নিজেদের দেশীয় পণ্য পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও কেন সাধারণ আয়ের মানুষ কিনতে পারছে না তার উত্তর কে দিবে? সকলেই তো কিনতে চায়। তার সন্তানদের খাওয়াতে চায়। শুধু ধনীরাই ইলিশের স্বাদ নিবে অবস্থা দাঁড়িয়েছে এমনই। অথচ বিশ্বের ৮০ ভাগের বেশি ইলিশ উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। ইতোমধ্যেই ইলিশের হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরে পেয়েছে দেশ। দেশের কৃষিজ সম্পদের মধ্যে অন্যতম হলো মৎস সম্পদ। একটি পণ্য বিশ্বের বুকে দেশের সুনাম বয়ে আনতে পারে। দেশের অর্থনীতি উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষ মাছ প্রিয়। যদিও এখন মাছে ভাতে বাঙালি মাছে স্বাদ হিসেবে বিদেশি মাছ সেটাও আবার কিনতে গেলে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা হচ্ছে। সেখানে ইলিশ তো সাধ্য-সাধনার ব্যাপার। আর মাছের ভেতর বাঙালির রসনায় ইলিশ একটু বেশিই ভালোবাসে। তবে সে ইতিহাস অতীত হতে চলেছে। ইলিশ বাংলাদেশের গর্ব, ঐতিহ্য। মৎস খাতের অন্যতম ফসল ইলিশ। যে মাছের আহরণমাত্রা এক যুগে বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের ইলিশ মাছ ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য বা জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইলিশ আহরণ কাজে নিয়োজিত রয়েছে ৫ লাখ মানুষ।
২০-২৫ লাখ মানুষ এ খাতে প্রতক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত রয়েছে। আজ বিশ্ব্বজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে ইলিশের বাজার। মাছ হিসেবে সরাসরি খাওয়া ছাড়াও স্যুপ এবং আরও কয়েকভাবে খাওয়া ইত্যাদি তৈরির প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে ইলিশের ভিন্ন ব্যবহার নতুন বাজারের পথ দেখাচ্ছে। সাগর থেকে যখন ট্রলার বোঝাই ইলিশ নিয়ে তীরে ফেরে তখন রাত জাগা জেলেদের মুখে থাকে খুশির ঝিলিক। শত শত ট্রলার ইলিশ নিয়ে ঘরে ফেরে। মা ইলিশের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে ২০১৭ সাল থেকে ইলিশ মাছ প্রজননের সময় মা ইলিশ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ২২ দিন করা হয়। কম-বেশি সারা বছর ডিম দিলেও সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হলো প্রজনন মৌসুম। এই সময় মা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ করতে পারলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। জাটকা নিধন এবং মা ইলিশ নিধন বন্ধে সফলতা এবং জেলেদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি হওয়ায় ইলিশ উৎপাদন ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় শতকরা ৮৬ ভাগ আহরণ করা হয় এদেশে। দেশের মৎস সম্পদ সমৃদ্ধ হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৫.০৩ লাখ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, ইলিশ মাছের উৎপাদনও গত কয়েক বছরে বেড়েছে। এক তথ্যে দেখা যায়, ২০০০-২০০১ সালে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ দশমিক ২৯ মে. টন। ২০০১-২০০২ ও ২০০২-২০০৩ সালে তা হ্রাস পেয়ে ২ দশমিক ২০ মে. টন এবং ১ দশমিক ৯৯ মে. টন হয়। এবং ২০০৩-০৪ অর্থবছরে ২ লাখ ৫৫ হাজার ৮৩৯ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়।
সেখান থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদিত ইলিশ ছিল ৫ দশমিক ১৭ লাখ মেট্রিক টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয় সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন। সঠিক পরিকল্পনা, জেলেদের ইলিশ আহরণে নিষেধাজ্ঞার সময় সহায়তা প্রদান, তাদের সচেতন করা এবং নজরদারি ইত্যাদি কারণে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। জানা গেছে ইলিশের বিচরণক্ষেত্রে পানির গুণগত মান বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো ইলিশের এত সুখ্যাতি যদি কেবল সুখ্যাতি অর্জনের জন্যই হয় তাহলে আর আমাদের কি লাভ! আমরা তো চাই এই সুস্বাদু পণ্যটি অন্ততপক্ষে ইলিশের সিজনে মুখে তুলতে। আমাদের ছেলেমেয়েদের দু’একবেলা খাওয়াতেই না পারি তাহলে এসব দিয়ে কি হবে! আমরা তো চাই আমাদের পণ্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করুক। কিন্তু কেবল বইয়ের পাতায় থেকে গেলে তাতে আর কি লাভ! ইলিশের সিজনে ইলিশ সকলের হাতের নাগালে থাকুক এটুকুই আমাদের চাওয়া।
লেখক: প্রাবন্ধিক
সারাবাংলা/এজেডএস