হুইসেল ব্লোয়ার নাই
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:১৫
আমরা যেন দিনে দিনে কেমন হইয়া যাইতেছি। নিজেরাও তাহা বুঝিয়া পারিতেছি, কিন্তু শুধরাইবার পরিবর্তে যেন আরো বেপোরোয়া, আরো বেয়াদব, আরো বেপর্দা হইয়া উঠিতেছি। হুইসেল বাজাইয়া আমাদেরকে থামাইবে এমন হুইসেল ব্লোয়ারও যেন কোথাও নাই।
আমাদের স্বাধীন স্বত্বায় বাধ সাধিলে আমরা এমন অবস্থার সৃষ্টি করিয়া থাকি যাহাতে সব কিছুতেই এক প্রকার বিশেষ ছাড় পাইয়া যাই। আচার-আচরণে এমন ভয়ানক করিয়া নিজেকে তুলিয়া ধরি যাহাতে আমাদের প্রতিবেশিরা প্রতিনিয়ত গুটিশুটি মারিয়া দরোজা-জানালা বন্ধ করিয়া থাকে। দৈবাৎ কপাল দোষে সামনে পড়িয়া গেলে যেন আগে পিছে আদব-কায়দা-লেহাজ-তমিজ সহকারে সালাম ঠুকে। ইহাতে আমাদের বেশুমার আনন্দ হইয়া থাকে। নিজেদেরকে কেউকেটা স্থানীয় বলিয়া মনে হয়। সমাজের বিশিষ্ট হইতে না পারিলে এ জীবন বৃথা ইহা আমরা সবাই জানি। শিশুকাল হইতে পড়িয়া আসিয়াছি যে, নিজে যাকে বড় বলে বড় সে নয়, লোকে যারে বড় বলে বড় সে হয়। আমি যে বড় উহা আমি নিজে বুঝিলে তো চলিবে না। সমাজের দশ জনকেও বুঝিতে হইবে। বুঝিতে না চাহিলে বুঝাইতে হইবে। ইহার জন্য প্রো এক্টিভ, রি এক্টিভ দুই রকমের তরিকা রহিয়াছে। উভয় তরিকা যুগপৎ ভাবে চালাইলে সমাজে ‘বড়ত্ব’ প্রতিষ্ঠা পাইতে সময় লাগিবে না। ইহার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রশান্ত মহাসাগর সম বুক ভরা সাহস, সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী বেয়াদবের খেতাব। ইহার সহিত সোনায় সোহাগা হিসাবে আনলিমিটেড চক্ষুলজ্জাহীন হইতে পারিলে আর ঠেকায় কে?
আজ সমাজের তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত বিশিষ্ট জনেরা দুই ভাগে ভাগ হইয়া গিয়াছে। ইহাদের একাংশ, বলাচলে সিংহভাগ, প্রগতির ধ্বজাধারী হইয়া বিভিন্ন সুবিধা প্রাপ্ত। তাহাদেরকে বহু সমীকরণের সূত্র মানিয়া চলিতে হয়। তাহাদেরও জ্বালা অনেক। তাই, তাহারা বেশিরভাগ সময়ই শীতনিদ্রায় থাকে। প্রয়োজনের জোয়ারে আর প্রভুর তলবমতে তাহারা বিবৃতি ইত্যাদি দিয়া তাহাদের উপস্থিতি জানান দিয়া থাকে। পাবলিক তাহাদের কথায় গা করে না। ইহাতে তাহাদেরও কিচ্ছু যায় আসে না। জো আপসে আতা হ্যায় ও হালাল হ্যায়। ইহাতেই তাহাদের পরম সুখ। এক জীবনে এত সরল সুখ আর কোথায় পাওয়া যাইবে? আরেক শ্রেণীর বিশিষ্ট জনেরা ঘরের কোনে আশ্রয় লইয়া নির্বিকার রহিয়াছে। তাহারা নীতি-নৈতিকতার পুঁথিপত্র ঘাটাঘাটি করিতেছে। তাহাদের জ্বালা অনেক। বিবেকের জ্বালা কঠিন, তবে ইহার চাইতেও কঠিন হইলো সর্বসম্মুখে হেনস্তা হওয়ার হ্যাপা। বিরাজমান এই অবস্থাতে আমাদের দৌরাত্ম্য আজ সর্বজন স্বীকৃত। আমরা তাই আজ অপ্রতিরোধ্য। ফাঁকা মাঠে ঠাসিয়া ঠাসিয়া গোল দিয়াও শতভাগ সুখবোধ হইতেছে না।
আমরা ছাত্রাবস্থায় অপথের দীক্ষা লইয়া অধ্যবসায়ী হইতেছি। শিক্ষকরা হয় আমাদের সমঝিয়া চলে, নয়তো হিজ হুজ তরিকায় চলে। চাকরি ক্ষেত্রে আমরা সিন্ডিকেটের যাবতীয় রোদ-বৃষ্টি নিরোধক বর্ণীল ছাতার নিচে থাকিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতেছি। এই ছাতাই আমাদেরকে পরম স্নেহে সর্বরুপ বিপদাপদ হইতে রক্ষা করিতেছে, অপত্যস্নেহে লালন-পালন করিতেছে। প্রকৃৃতপক্ষে ইহাই এখন আমাদের অভিভাবক। পদধারীগণ আমাদের মাথায় হাত বুলাইয়া চলে। আমাদের চোখ-মুখের ভাষা-অভিলাষ বুঝিয়া পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়া থাকে। আমরা কাহাকেও টার্গেট করিলে তাহার মান-মর্যাদা রক্ষা করিবার দায় আর কাহারো নাই। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়া লাভ নাই। শুনিবার কেহ নাই। শুনিবার থাকিলেও প্রতিকার করিবার কেহ নাই। প্রতিকার করিবার কেউ থাকিলেও তাহার নিজেরই পরবর্তী ঠিকানা পত্রপাঠ দৃশ্যমান হইয়া যাইবে। বাণিজ্যে আমরা রীতিমত শৃঙ্খলহীন। আমাদের রুধিবারে পারে এমন কেহ নাই। আমরা আর মামুরাই বাজারের অভিভাবক, নিয়ন্ত্রক। এর বিপরীতে যাহারা উচ্চকিত ও সৃজনশীল তাহাদেরকে ছলে-বলে-কৌশলে পক্ষভুক্ত করাই আমাদের কাজ। সোজা আঙ্গুলে প্রদর্শিত সরল পথে চলিলে কথা নাই। কিন্তু ইহার অন্যথা হইলে ভিন্ন কথা।
জীবনের রঙ্গমঞ্চে আমরা প্রত্যহ সুন্দর সাজে সাজিতেছি। সুবচনে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। চাপায় আমরা হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন। প্রতিশ্রুতিতে আমরা অকৃপণ। মঞ্চের বাহিরে আমরা ভিন্ন দ্বিপদী। আমাদের লইয়া পাবলিক চর্চা করে জানি। রং-ঢং করে তাহাও টের পাই। তাহাতে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না। আমাদের ‘বড়ত্ব’ ইতোমধ্যেই স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। সমাজে নিন্দুকের অভাব কোন কালেই ছিল না। তাহারা পশ্চাৎগামী। তাহাদের উৎপাত বেশি হইলে মাঝেমধ্যে উপযুক্ত দাওয়াই দেওয়া ফরয হইয়া পড়ে।
মাঝেমধ্যে আমাদের মধ্যে আত্মঘাতি কায়-কারবার হইয়া যায়। অনেকটা ফুটবল খেলার সেম সাইড গোলের মত। ইহা আমাদের জন্য অস্বস্তিকর সন্দেহ নাই। অনেক সময় আমরা নিজেরাও বুঝিতে পারিনা আমাদের কর্মের পরিধি কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের জন্য চন্দ্রকিরণ কতক্ষণ পর্যন্ত প্রখর থাকে, কখন তাহা শীতের পড়ন্ত বিকালের মত টুপ করিয়া খসিয়া পড়ে তাহাও মাঝেমধ্যে ঠাহর করিতে পারি না। আসলে কোন সেক্টরেই কোন হুইসেল ব্লোয়ার নাই। থাকিলে বোধহয় ভালোই হইত। আমরাও কিছুটা পরিশীলিত হইয়া চলিতাম। আর দেশ ও জাতিও কিছুটা রেহাই পাইত।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই