চমেক হাসপাতালে আনসার সদস্যদের দৌরাত্ম্য; কতদূর?
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:২৪
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি অনন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যেখানে চিকিৎসা সেবা নিতে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা, শহর, উপশহর থেকে প্রতিনিয়তই সাধারণ মানুষ ছুটে আসেন। মূলত চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে মুমূর্ষু রোগীদেরকে চমেক হাসপাতালে রেফার করে পাঠানো হয়।
হাসপাতালের বেডে সন্তান প্রসবের আশায় স্ত্রী অপেক্ষায় আছে স্বামীর। আর স্বামী বাইরে অপেক্ষায় আছে ওয়ার্ডে ঢুকার। কিন্তু কিভাবে আর ঢুকবে?
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ওয়ার্ডের দরজায় আনসার সদস্যের চরম অনিয়ম ও ক্ষমতার দাপটের রোষানলে বিড়ম্বনার শিকার হয় স্বামী। এভাবে ওয়ার্ডে ঢুকা নিয়ে আনসার সদস্যের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয় স্বামী। চমেক হাসপাতালে আনসার সদস্যের এই চরম দৌরাত্ম্যের ভিডিও ফুটেজ সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উঠে আসে। সেখানে দেখা যায়, ওয়ার্ডের দরজায় রফিকুল নামে এক আনসার সদস্য রোগীর স্বামীকে বেধড়ক থাপ্পড়াতে থাকে। এই নির্মম দৃশ্য চমেক হাসপাতালের ওয়ার্ডের দরজাগুলোর যেন নিয়মিত চিত্র।
এখানেই শেষ নয়। এই আনসার সদস্যরা প্রতিনিয়ত হয়তো কারো কাছে টাকা দাবি করে, হয়তো কাউকে গলা ধাক্কা দেয়। কিংবা কাউকে করে চূড়ান্ত অপমান। সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিও ফুটেজের কারণেই মূলত তাদের এই অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠে এবং এই ধরণের ঘটনা যেন চমেক হাসপাতালের ওয়ার্ডের দরজায় প্রতিদিন কড়া নাড়ে।
কিন্তু যারা প্রতিনিয়ত হাসপাতালে আসা-যাওয়া করে, তাদের সাথে এই ধরণের ঘটনা নিত্যদিনই ঘটে থাকে। রোগীর স্বজনদের সাথে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ নেতিবাচক আচরণ আগে ঘটে থাকলেও তা ক্যামেরার আড়ালে চাপা পড়ায় সামনে আসেনি। যা এবার জনসম্মুখে খোলাসা হলো।
রোগীর স্বজনকে আনসার সদস্যের থাপ্পড়ানোর ভিডিও ফুটেজের মধ্যে ঘটনা শেষ হয়নি। এই থাপ্পড়ের পর রোগীর স্বজনের উপর চলে আরো সংঘবদ্ধ নির্যাতন। যা ভিডিও ফুটেজে খুবই স্পষ্ট।
ভুক্তভোগী রোগীর স্বামীর ভাষ্যমতে– আনসার সদস্য রফিকুল আমাকে মারার পরে, আমার বাচ্চাকে এইচডিউ থেকে বের করে দিয়ে নরমাল একটা বেডে নামিয়ে দেয়। তারপর উনারা হুমকি দিচ্ছে আমার বাচ্চাকে মেরে ফেলবে। এই করবে, সেই করবে। এখন আমি মানসিকভাবে টেনশনে আছি। চট্টগ্রাম মেডিকেলে আমার থাকাটাই অনিরাপদ মনে করছি। আপনারা দ্রুত এটার ব্যবস্থা নিন। এখন আমার স্ত্রী ২০০ প্রেসারে আক্রান্ত। এখন যে কোনো মুহূর্তে আমার স্ত্রীর দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
রোগীর ভুক্তভোগী স্বামীর উপর এই শারীরিক নির্যাতনের দায় কি আদৌ চমেক কর্তৃপক্ষ নিবেন কিনা?
আনসার সদস্য কর্তৃক রোগীর স্বামী নির্যাতনের রেশ কাটতে না কাটতেই– সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনসার সদস্যের লাঠির আঘাতে আহত হয় রোগীর স্বজন।
ওয়ার্ডের দরজায় আনসার সদস্যের থাপ্পড়ের ঘটনার পরপরই মাহফুজ নামে আরেক রোগীর স্বজনের উপর চড়াও হয় চমেক হাসপাতালের আনসার সদস্যরা। মাহফুজ মেডিকেলে আসে মূলত, তার স্ত্রীর সন্তান হবে এবং তার স্ত্রী একটু শারীরিকভাবে অসুস্থতায় ভুগছেন। ডাক্তারের পরামর্শে রক্ত জোগাড় করার জন্য ছুটছে মাহফুজ। এভাবে রক্ত জোগাড় করার জন্য মাহফুজ ওয়ার্ডের বাইরে যায়। অতঃপর রক্ত জোগাড় করে বাইরে থেকে এসে ওয়ার্ডে ঢুকতে চাইলে এক আনসার সদস্য মাহফুজের কাছে টাকা দাবি করে বসে। টাকা না দেওয়ায় মাহফুজকে লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয় আনসার সদস্য রফিকুল ইসলাম।
ভুক্তভোগী মাহফুজের ভাষ্যমতে– ডাক্তার বলেন, ব্লাড লাগবে। ব্লাড জোগাড় হলেই সিজার করবে। আমার রোগীর কন্ডিশন খারাপ। আনসার সদস্য রফিকুল আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। যথেষ্ট চেষ্টা করলাম। উনি আমাকে ৫০০ টাকার নিচে ওয়ার্ডের ভিতরে ঢুকতেই দিবে না। উনি প্রথমে আমার ডান হাতের বাহুতে লাঠি দিয়ে একটা আঘাত করে। এরপর লাথি দিয়ে আমাকে ফেলে দেয়। আমি কোনোমতে উঠে বলি, ভাই আমাকে ভিতরে যেতে হবে। আমার স্ত্রীর অবস্থা ভালো না। তারপর হঠাৎ চোখ না ফেরাতেই আমার মাথায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে। সাথে সাথেই রক্ত পড়ে আমার সারা শরীর ভিজে গেছে। মাথায় এখন পাঁচটা সেলাই। আমি দেশের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে এই মর্মান্তিক ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।
এভাবে চমেক হাসপাতালে সাধারণ মানুষের উপর জুলুম কবে নাগাদ শেষ হবে? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে দেশের সাধারণ মানুষ।
এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যথাযথ ব্যবস্থা ও নজরদারি বাড়াতে হবে। দেশের আইনের শাসন অক্ষুণ্ণ রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের সুদৃষ্টি বিবেচনা করতে হবে।
আনসার সদস্যদের এমন লাগামহীন আচরণে যেন চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর কলুষিত না হয়, এমন বিচার প্রত্যাশা করেন ভুক্তভোগী রোগীর স্বজন ও দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ।
এই আনসার সদস্যরা ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১০০, ২০০ এবং ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দাবি করে। যাকে, যখন, যেভাবে শিকার করতে পারে। এভাবে প্রতিনিয়তই চালিয়ে নিচ্ছে তাদের এই রমরমা লাঠির দাপট।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমন চাঁদাবাজির ফাঁদ তৈরি করে রেখেছে আনসার সদস্যসহ মেডিকেলের আয়া, টলি বহনকারীরা। এমনকি যেখানে পরিচ্ছন্নতা কর্মীও বাদ যায়নি।
রোগীর স্বজনদের প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ ও হুমকিতে রাখে এইসব স্টাফরা।
স্বজনরা যখন রোগীকে নিয়ে প্রচন্ড ভাবে মানসিক চাপে থাকেন, সেই অসহায় মুহুর্তটাকে কাজে লাগিয়ে তৎপর এইসব অসাধু চাঁদাবাজরা।
জনৈক ভুক্তভোগী জানান– আনসার সদস্যরা বলে, আমাদেরকে টাকা কিছু দিলে আমরা ওয়ার্ডে ঢুকতে দিব। সমস্যা নেই।
এই আনসার সদস্যদের মূলত মেডিকেলে রাখা হয়েছে, মেডিকেল কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করার জন্য এবং মেডিকেলের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে। কিন্তু এই আনসার সদস্যরা নিরাপত্তা না দিয়ে সাধারণ মানুষকে নানান ভাবে পুঁজি করে চলেছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছে তারা নানান ভাবে হয়রানির জাল পেতে বসেছে।
আনসার সদস্যদের এমন নিষ্ঠুরতা থেকে শিশু ওয়ার্ডও রেহাই পায়নি। তারা প্রতিনিয়তই তাদের এই পাতানো জালে রোগী থেকে শুরু করে রোগীর স্বজনদেরও আটকিয়ে থাকে। বর্তমানে আনসার সদস্যদের অবৈধ দাপটের একটাই মূলনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে– টাকা দিলে ওয়ার্ডে ঢুকার অনুমতি মিলবে, অন্যথায় অনুমতি মিলবে না।
তবে একটা বিষয় হচ্ছে– যেহেতু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার ৪/৫ গুণ বেশি মানুষ আসা-যাওয়া করে। যার ফলে মেডিকেলে রোগীর স্বজনের সংখ্যাও বেশি থাকে। আরো দেখা যায়, অহেতুক কিছু কিছু রোগীর স্বজনগণ নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে চলে। শুধুমাত্র আনসার সদস্যদের দোষ তা-ও কিন্তু নয়। অনেক রোগীর স্বজনদের বেপরোয়া চলাচলও চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, যা-ই কিছু হোক না কেন– রোগীর স্বজনদের গায়ে হাত তোলার মতো দুঃসাহস আনসার সদস্যরা কিভাবে পায়?
এছাড়া যথেষ্ট সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকা এবং রমরমা সিন্ডিকেটের রোষানলে কোনো প্রকারের আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যায় না।
ভুক্তভোগী সবাইকে এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় আনা সময়ের দাবি।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বর্তমানে সক্রিয় সিন্ডিকেট চক্রের অধীনে নিরীহ মানুষদেরকে হয়রানির কারখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় সিন্ডিকেট হওয়ায় অনেকেই কথা বলতে সাহস পায় না। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রশাসনের কাজ কি তাহলে? তারাও কি এসব সরকারি পোশাকের গুন্ডাপান্ডা লালন-পালন করছে সাধারণ মানুষদেরকে নির্যাতন করার জন্য? রোগীর স্বজন থেকে জোর করে আদায় করা টাকার ভাগ কারা কারা পায়?
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনসার থেকে শুরু করে নার্স, ওয়ার্ড বয় এবং ক্লিনার পর্যন্ত সবার আচরণই খুবই বাজে। সরকারিভাবে আচরণগত বিষয়ে কঠোর মনিটরিং দরকার।
সর্বোপরি– চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি বাড়াতে হবে এবং কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আনসার সদস্যদের দৌরাত্ম্যের লাগাম টানতে হবে। সেই সাথে সর্বসাধারণের চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসার অধিকার। আর এই অধিকারহরণের সিন্ডিকেট চক্রকে শনাক্ত করে কঠোর আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবেই কেবল সাধারণ রোগীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হবে এবং চমেক হাসপাতালের সিন্ডিকেট চক্র নিপাত যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
সারাবাংলা/এজেডএস
এস এম রাহমান জিকু চমেক হাসপাতালে আনসার সদস্যদের দৌরাত্ম্য কতদূর?