চমেকের ওয়ার্ডগুলোতে ডিউটি ডাক্তারের উপস্থিতি নিশ্চিত করুন
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৩৩
চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যতম প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যেখানে একটু উন্নত চিকিৎসার খোঁজে চট্টগ্রাম বিভাগের আওতাধীন সকল জেলা, আন্তঃজেলা, শহর ও উপশহর থেকে প্রতিনিয়তই লক্ষাধিক মানুষ ছুটছে।
চিকিৎসা আমাদের মৌলিক অধিকার। কিন্তু এই অধিকার বর্তমানে কেবল পাঠ্যপুস্তকের পাতায় সীমাবদ্ধ, যা আমাদের বাস্তবিক জীবনে আদায় করা বিলাসিতার শামিল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীকে চূড়ান্ত হয়রানি, রোগীকে চিকিৎসা দিতে ডিউটি ডাক্তারের গড়িমসি, নার্সদের ফাঁকিবাজি, ওয়ার্ডবয় ও ক্লিনারদের চাঁদাবাজি যেন রোজকার ঘটনা। চমেকের এই অনিয়মজনিত সিন্ডিকেট চক্র থেকে আনসার সদস্যরাও বাদ যায়নি। তারাও কোনো না কোনো ভাবে রোগী এবং রোগীর স্বজনদেরকে বিড়ম্বনায় ফেলে।
শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নয়, বর্তমানে দেশের প্রায়-ই সরকারি হাসপাতাল গুলো অনিয়মের যাঁতাকলে। সরকারি হাসপাতাল গুলোতে মূলত দেশের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগণ প্রতিনিয়তই চিকিৎসা নিতে ছুটছে। কিন্তু তাদের এই ছুটে চলার মূল্যায়ন যেন দেশ থেকে বিলুপ্তির পথে। সরকারি হাসপাতালে প্রজাতন্ত্রের নিয়ম যেন কেউই মানছেন না। যেখানে ওয়ার্ডে রোগী না দেখে মেডিকেলের ডিউটি ডাক্তার নিজেই লাপাত্তা, সেখানে ওয়ার্ডবয় ও নার্সদের সহযোগিতা প্রত্যাশায় রাখা কেবল বিলাসিতা।
সম্প্রতি চমেক হাসপাতালের ২৫ নং ওয়ার্ডে ডিউটি ডাক্তারের লাপাত্তার বিষয়টি চোখে পড়ে। গত ১৭ সেপ্টেম্বর, রাত ১০ টা–২ টা পর্যন্ত প্রায় ৪ ঘন্টা নাগাদ সন্ধান করেও ডিউটি ডাক্তারকে ওয়ার্ডে খুঁজে না পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে– এই একটা দীর্ঘ সময় (প্রায় ৪ ঘন্টা) ওয়ার্ডের ডিউটি ডাক্তার অনুপস্থিত কেন? রোগীর স্বজনদের প্রশ্ন– এতো-টা সময় ডিউটি ডাক্তার সাহেব কোথায় ছিলেন?
রোগীর স্বজনদের অভিযোগ– সরকারি মেডিকেলের ডাক্তাররা বর্তমানে বেসরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিকে সময় দিতে গিয়ে, সরকারি মেডিকেলে তাঁদের সিডিউল ভুক্ত ডিউটি ফাঁকি দিচ্ছেন।
সম্প্রতি চমেক হাসপাতালের ২৫ নং ওয়ার্ডে ভর্তি এক মুমূর্ষু রোগীর স্বজনের (বাবা) করুণ সাক্ষাৎকারে উঠে আসে মর্মান্তিক বর্ণনা।
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া থানার অন্তর্গত ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা মো: রুহুল কাদের। তার ছেলে মো: রিফাত (২০) ডুলহাজারা কলেজের ছাত্র। গত ১৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭ টা নাগাদ, রিফাত এটিএন পার্ক সংলগ্ন সড়কে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে আহত হয়। এসময় তাকে নিকটস্থ চকরিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে রেফার করে। গতরাত ১০টা ৩০মিনিটের দিকে তারা চট্টগ্রাম মেডিকেলে পৌঁছায়।
ভুক্তভোগী রিফাতের বাবা বলেন– দুঃখের বিষয় হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল যে এইরকম জঘন্য একটা হাসপাতাল, তা জানা ছিলো না। এরা আমার সন্তানের শরীরের ক্ষতগুলো ব্যান্ডেজ করে। ব্যান্ডেজ করার পর যখন আমার ছেলেকে এক্স-রে দেওয়ার জন্য নিচে নামানো হবে, ঐ অবস্থায় কয়েকজন ব্যক্তি টাকা দাবি করে বসে। তখন আমার কাছে খুচরো টাকা ছিলো না বিধায়- তাদেরকে কিছু টাকা দিতে চাইলে, তারা টাকা না নিয়ে চলে যায় এবং তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হয়। পরে জানতে পারি, তাদের এই টাকা দাবি সংক্রান্ত কর্মকান্ডে চট্টগ্রাম মেডিকেলের কর্মচারীরাও সম্পৃক্ত আছেন। এর কিছুক্ষণ পর রাত ১১টা নাগাদ আমার ছেলেকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় চরম ভোগান্তির প্রতীক্ষা। যেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও ওয়ার্ডের কোনো ডাক্তার বা নার্সের সাড়া নেই। এদিকে আমার ছেলের বেগতিক অবস্থা আমাকে বিষন্ন করে তুলেছে। আমি বারবার ছুটে গেছি ওয়ার্ড সংলগ্ন ডিউটি ডাক্তারের রুমে। কিন্তু কোনো প্রতিকার মেলেনি। আমি যতবারই ডাক্তারের সন্ধানে গেছি, ততবারই ডিউটিরত নার্স বলে ডাক্তার নাই। এভাবে ডাক্তার আসবে-আসবে বলে প্রায় ৪ ঘন্টা তারা আমার ছেলেকে অপারেশন থিয়েটারে ফেলে রাখে।
ভুক্তভোগী রিফাতের বাবা আরও বলেন– ডিউটি ডাক্তার আসবে, এমন প্রতীক্ষার প্রহর ৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি। এদিকে আমার ছেলের কন্ডিশন ক্রমাগত ভাবে অবনতি ঘটছে। বাবা হয়ে চোখের সামনে ছেলের এমন করুণ দৃশ্য দেখার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। এরমধ্যে চমেক হাসপাতালের অনিয়মের স্রোতে ভেসে গেলাম। নিরুপায় হয়ে আমার ছেলেকে চমেক হাসপাতালের ২৫ নং ওয়ার্ড থেকে বের করে নিচে নিয়ে আসি। তখন রাত প্রায় ৩ টার কাছাকাছি। তারপর চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমার ছেলেকে পার্কভিউ হসপিটালে ভর্তি করি।
ভুক্তভোগী রিফাতের বাবার একটাই প্রশ্ন– চট্টগ্রাম মেডিকেল কি প্রাইভেট হসপিটাল নাকি পাবলিক হসপিটাল? যদি পাবলিক হসপিটালই হয়ে থাকে, তবে চট্টগ্রাম মেডিকেলের সবাই কেন টাকা চেয়ে বসে?
ম্যানেজিং কমিটির সিডিউল ভুক্ত অন ডিউটি ডাক্তার যে ওয়ার্ডে থাকেন না, সে খবর কি আদৌ চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাখেন? নাকি ডাক্তারদের দায়িত্ব ফাঁকিবাজিতে কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করছেন? চমেক হাসপাতালের হাজারো ভুক্তভোগী মানুষ এখন এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে।
অতীতের রেকর্ড থেকে বলা যায়– চমেক হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় থেকে শুরু করে ক্লিনার পর্যন্ত, আপনি যতক্ষণ টাকা দিবেন এরা ততক্ষণই আপনাকে সেবা দিবে এবং সুন্দর ব্যবহার প্রত্যাশা করবেন। অন্যথায় চমেক হাসপাতালের এই কর্মচারীদের সেবা তো বিলাসিতা, আপনি সেখানে সুন্দর ব্যবহার টুকুই পাবেন না। চমেক হাসপাতালের নার্সরাও কিন্তু এই অভিযোগের বাইরে নয়, তারা যথাসময়ে সুযোগ বুঝে ভুক্তভোগীকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে।
এমন অনিয়ম শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নয়, এই অনিয়ম বাংলাদেশের সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছেয়ে গেছে। বস্তুতপক্ষে বর্তমানে বাংলাদেশের সরকারি মেডিকেলের ডাক্তারদের দায়িত্বে অবহেলা জনিত কারণে অনেক গরীব মা-বাবার সন্তান অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে।
সর্বোপরি– অদূর ভবিষ্যতে যেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো ডিউটি ডাক্তার শূন্য না থাকে, সেদিকে কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে এবং আগামীতে যদি ডিউটি ডাক্তারদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ উঠে, তবে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তবেই রিফাতের বাবাদের চিকিৎসা ঘাটতির ভার কাঁধে বহন করে রাত ৩ টায় ছেলেকে নিয়ে মেডিকেলের আঙিনা ছাড়তে হবে না। সরকারি মেডিকেলের ডাক্তাররা যদি সিডিউলের নির্ধারিত দায়িত্ব টুকু যথাযথ পালন করেন এবং মেডিকেলের কর্তৃপক্ষ যদি তা যথাযথ তদারকি নিশ্চিত করেন, তবেই কেবল রিফাতরা চিকিৎসা জনিত অবহেলার শিকার হবে না। অতঃপর– চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকার রক্ষা পাবে এবং রিফাতরা সুস্থ হয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরবে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই
এস এম রাহমান জিকু চমেকের ওয়ার্ড গুলোতে ডিউটি ডাক্তারের উপস্থিতি নিশ্চিত করুন মুক্তমত