নারী বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:৩৫
সম্প্রতি বাংলাদেশ জাতীয় দলের নতুন ও তরুণ ক্রিকেটার তানজিম হাসান সাকিবের পুরাতন ফেসবুক পোস্ট কে ঘিরে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। গেল এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে নজর কাড়া পারফরম্যান্সের কারণে নেট দুনিয়ায় প্রশংসার পাশাপাশি সেই পুরাতন ও বিতর্কিত পোষ্টগুলোও ভাইরাল হয় এবং সমালোচনার ঝড় ওঠে। সেখানে তিনি সমাজের নারীগোষ্ঠী সম্পর্কে ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে অবমাননাকর কিছু অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন। যেমন-‘স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয়না; স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয়না; স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়; স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়; স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নস্ট হয়; স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নস্ট হয়।’ এছাড়া লেখেন-‘ ভার্সিটির ফ্রী মিক্সিং আড্ডায় অভ্যস্ত মেয়েকে বিয়ে করলে আর যাই হোক সন্তানের জন্য একজন লজ্জাশীলা মা দিতে পারবেননা।’
প্রসঙ্গত এ কথা গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি এই উক্তিগুলো তার নিজের জীবন ও পরিবারকে ঘিরে বলেননি বরং সমাজের সাধারণ নারীগোষ্ঠীকে হেয় প্রতিপন্নের মাধ্যমে কার্যত বিকৃত মানসিকতারই পরিচয় দিয়েছেন যা এরকম আইকনিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে কখনোই আশা করা যায়না। যদিও তিনি পরবর্তীতে বিষয়টির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন তবুও সামাজিক মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি আলোচনার দাবী রাখে। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে সংঘটিত নারী বিদ্বেষী ঘটনা নতুন নয়। ইতোপূর্বেও ঢাকায় ইউনিফর্ম পরিহিত একজন পুলিশ কর্তৃক প্রকাশ্যে জনাকীর্ণ দিবালোকে লতা সমাদ্দার নামে তেজগাঁও কলেজের ‘ফিল্ম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ’ বিভাগের শিক্ষককে নারী বিদ্বেষমূলক খেদোক্তির মাধ্যমে নাজেহাল করা হয়। এটি গবেষণালব্ধ যে, ধর্মীয় বিকৃতি ও গোঁড়ামি থেকেই মুলতঃ নারী বিদ্বেষী মনোভাব সকল সমাজে কালক্রমে আবর্তিত হয়ে তা নারীর অধিকার বিরোধী বিকৃত মতবাদে পরিণত হয়েছে। সতীদাহ প্রথা তার একটি মর্মান্তিক জ্বাজ্জল্য উদাহরণ। গভীর পর্যবেক্ষণে বুঝা যায়, ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্যে নারী বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ-এই তিনটি উপাদান সহবস্থানে থাকে। কখনো-কখনো তা প্রকট রুপে প্রকাশ পায়। অবাক বিষয় হলো, এই প্রবণতা প্রান্তিক স্তরের মানুষদের চেয়ে বর্তমানে উচ্চবিত্ত শিক্ষিত তরুণদের বেশী গ্রাস করছে। হলি আর্টিজানসহ একাধিক জঙ্গি ঘটনায় আমরা তা বিষ্ময়ভরে লক্ষ্য করেছি। বলাবাহুল্য, তরুণদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমানে ধর্মের বিকৃত চেতনায় ভ্রষ্ট। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ধর্মাশ্রয়ী বিকৃত আচরণ দেখলে তা সহজেই অনুমেয় হয়। একশ্রেণির মৌসুমি ওয়াজী ধর্ম ব্যবসায়ীদের অবাধ বিকৃত ধর্মাচার এর প্রধান কারণ। তারা কৌশলে ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে তরুণ সমাজ সহ একশ্রেণির সরলমনা মানুষদের মননে ধর্মের অপব্যাখ্যায় নারী বিদ্বেষ ছড়িয়ে যাচ্ছে। তারা প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনসহ কথিত ইসলামি জিহাদের নামে জঙ্গিবাদকে উস্কে দিচ্ছে। প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার তাদের এই অপকর্মে বাড়তি উপযোগ সৃষ্টি করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের অনুসারীর সংখ্যা দেখলে রীতিমতো আঁতকে উঠতে হয়। এ সকল পেইড ধর্মব্যবসায়ীরা ধর্মকে তাদের শুধু ব্যবসায়িক উপকরণই বানায়নি, উপরন্তু তারা তাদের অন্তর্জগতের কু-প্রবৃত্তি চরিতার্থের জন্য সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাধ্যমে সামাজিক সম্প্রতিও বিনষ্ট করে চলছে। শুধু তাই নয়, অনেক মসজিদ মাদ্রাসায়ও একই দৃশ্য বিরাজমান। এমনকি বহু সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও একই অপচর্চা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভাবে লক্ষ্য করা যায়। ইতোপূর্বে সংঘটিত শিক্ষক- স্বপন কুমার, আমোদিনী পাল, হৃদয় মন্ডলকে ঘিরে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক আঘাতের ইস্যুগুলো সেই আতংকের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দুঃখ জনক হলেও সত্য ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসালামি ফাউন্ডেশন এ চর্চা রোধকল্পে জনসচতেনতা সৃষ্টিতে কখনোই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করেনি। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতাও লক্ষ্যণীয়।
তানজিমের রেশ কাটতে না কাটাতেই আমরা দেখলাম শাবিপ্রবির বর্তমান ভিসি জনাব ফরিদ উদ্দীনের বিতর্কিত আচরণ। তিনি নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে তালেবানি শাসনকেই শ্রেয় মনে করেছেন। অর্থাৎ কোনো সৃজনশীল অনুশাসনে তিনি বিশ্বাসী নন মর্মে সচেতন মহলকে হতবাক করেছে। অর্থাৎ আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে ঘৃণিত ও ধিকৃত নারী বিরুদ্ধ অপশাসন-‘তালেবানি শাসন’ যদি একজন বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি’র মগজে মননে ব্রত হয়ে থাকে তবে আমাদের শিক্ষার নৈতিকতা কত বেশি বিক্ষত তা আর বলার অপেক্ষা থাকেনা। বিশ্বায়নের যুগে নারীর অবদান কল্পনায়ও অস্বীকার করা যায়না। আমাদের জাতীয় রপ্তানী আয়ের প্রধান অংশ পোশাকশিল্প যার মূল চালিকাশক্তি নারী। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে নারীর অবদান অপরিসীম। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও নারীর ঐতিহাসিক বীরোচিত অবদান রয়েছে। যারা নারীর অগ্রায়ন বিরোধী মতবাদ দিচ্ছে তারা প্রকারান্তরে দেশ, সমাজ ও ধর্মের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিচ্ছে। পবিত্র কোরআনে তথা ইসলামে নারীকে উচ্চ মর্যাদাশীল করা হয়েছে। কোরআনে বর্ণিত, ‘নারীদের ওপর যেমন পুরুষের অধিকার রয়েছে, তেমনি পুরুষের ওপর রয়েছে নারীর অধিকার’-(সূরা বাকারা;আয়াত ২২৮)। অর্থাৎ,পারস্পরিক সমঅধিকারের ভিত্তিতে সমাজে ‘নারী-পুরুষ’ অধিকারের ভারসাম্য সুরক্ষিত হবে। এখানে ধর্মীয় দৃষ্টিতে নারীর অধিকারকে ক্ষুন্ন করার নুন্যতম সুযোগ নাই। এর বাইরে যে কোনো চিন্তাই ধর্ম ও সুসভ্যতার সাথে সাংঘর্ষিক এক বিকৃত মনস্তত্ত্ব।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এজেডএস