অনলাইন গেমস জাতির জন্য অশনি সংকেত
৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৪০
সারা বিশ্বে স্মার্ট ডিভাইসের ব্যবহার বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। স্মার্ট ডিভাইসের কল্যাণে বতর্মান পৃথিবী পরিণত হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজে। কিন্তু মুদ্রার ওপিঠে সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে অসুবিধাও। আজকের প্রেক্ষাপটে অস্বীকার করার উপায় নেই মোবাইল গেম আসক্তি ছোট্ট ছোট্ট শিশু থেকে তরুণ প্রজন্মের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। যে বয়সে কিশোর-কিশোরিদের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা অর্জনে শারীরিক কসরত, খেলাধুলা কিংবা গল্প-উপন্যাসের বই নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা সেই বয়সের কিশোর-কিশোরিরা আজকাল ইন্টারনেটে মোবাইল গেমসে নিমগ্ন থাকে। একদশক আগের কথায় ধরা যাক তখনকার তরুণ-তরুণীর স্কুল থেকে এসেই নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুরে লাফালাফি করতো কিংবা বিভিন্ন খেলাধুলায় মেতে উঠতো। ফলে তখনকার তরুণ-তরুণীরা ছিল হাস্সোজ্জল, প্রাণবন্ত। কিন্তু হায় এখন এসব সোনালী অতীত। এখনকার শিশু-কিশোরদের কাছে এসব রূপকথার গল্পের মতো। এখন তারা সময় পেলেই শুরু করে অনলাইন গেম খেলা।এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হয়। এখন অনলাইন গেমসই তরুণদের নিত্য দিনের সঙ্গী। বারিতে কিংবা গাড়িতে,বন্ধু-বান্ধবের আড্ডায় মোবাইল গেমস খেলায় ব্যস্ত হয়ে যায়। গেমস গুলোতে মূলত মারামারি,রক্তপাত,যুদ্ধ-বিগ্রহ ও উত্তেজনাপূর্ণ রসদ দিয়ে তৈরি করা হয়। ফলে যারা গেমস খেলে তাদের মধ্যে জিঘাংসা, জেদ, রাগ, মানসিক অবসাদ, বিষণ্বতা ও মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে নিয়মিত ভিডিও গেমস খেলার কারণে মাদকাসক্তদের মতো মস্তিষ্ক থেকে ডোপামিন নামক একটা নিউরোট্রান্সমিটারের ক্ষরণ হয়। আর এই কারণে তাদের কর্মক্ষমতাকে কমে যায় ও তাদের চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন নিয়ে আসে। এতে তাদের মন মেজাজ উত্তেজনাপূর্ণ হয় ও ভিডিও গেমসের উস্কানিমূলক বৈশিষ্ট্যের জন্য তাদের মানসিক প্রভাব পড়ে। পরবর্তীতে তা তাদের আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন আনে। এতে তারা তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের অবাধ্য হয়ে যায়। অনেক সময় তাদের গেমস খেলতে বাধা দিলে তারা উগ্র আচরণ করে। গেমস খেলতে ডাটাপ্যাক কেনার জন্য বাবা-মাকে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে টাকা নেয়। অনেক সময় টাকার জোগান দিতে ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। এতে সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন গেমসে আসক্ত থাকলে তারা চরমভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন হয়। অনেকসময় মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে গেমস খেলতে খেলতে রাস্তা পারাপারের সময় সড়ক দূর্ঘটনাও ঘটে। বাংলাদেশে মোবাইল গেমসের বাজার দিনদিন বড় হচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় ৮০বিলিয়ন ডলারের মোবাইল গেমিং ইন্ডাস্ট্রিতে ২.৫ বিলিয়ন একটিভ প্লেয়ার আছে যারা নিয়মিত নানা ধরনের মোবাইল গেমস খেলসে। এতে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে একটি জরিপে দেখা গেছে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে ৪দশমিক ৬ শতাংশ ইন্টারনেট গেমিং আসক্তিতে ভুগছেন। যাদের মধ্যে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হচ্ছে কিশোর আর ১ দশমিক ৩শতাংশ কিশোরী। (জেওয়াউ ফ্যাম, ২০২০)
যে তরুণ-তরুণীরা সপ্ন দেখবে বিশ্বজয়ের তারাই আজ অনলাইন গেমে আসক্তির কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত গেম খেলার ফলে সর্বদা চিন্তা-চেতনাও আচরণে বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা সামাজিক দক্ষতাকে কমিয়ে দেয়।
ইন্টারন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজ ১১তম সংশোধিত সংস্করণে (আইসিডি-১১) গেমিং আ্যাডিকশনকে এক মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করে ২০১৮ সালের জুনে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালে প্রকাশিতব্য “আইসিডি -১১” শীর্ষক রোগনির্ণয় গাইডবুকে এটি সংযুক্ত করা হয়েছে। অর্থাৎ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম,মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। অনেকসময় সঙ্গদোষের কারণেও এতে জড়িয়ে পড়ে। বখাটেদের সাথে মেশার ফলে তাদের কুমন্ত্রণায় ও গেমিংয়ে জড়িয়ে পড়ে।
অবশ্য সন্তানদের মোবাইল গেমিংয়ে আসকির জন্য অনেকাংশে মা-বাবা রাও দায়ী। আমাদের গ্রামগুলোতে অধিকাংশ বাবা-মা প্রযুক্তির অপব্যবহার সম্পর্কে অজ্ঞ। ফলে সন্তানেরা প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কে তারা উদাসীন। অপরদিকে শহরের বসবাসকারী বাবা-মা তারা তাদের ব্যস্ততার জন্য সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেনা। এবং ব্যস্ততার অযুহাতে সন্তানের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিয়ে স্বস্তি অনুভব করেন। অথচ খোঁজ-খবর রাখেন না যে তার সন্তান এটির সঠিক ব্যবহার করছে কিনা। ফলে তারা অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে তাদের পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া ঘুম বাদ দিয়ে রাতদিন বিভিন্ন গেমিং সাইটে মগ্ন থাকে। যা একসময় আসক্তিতে পরিণত হয়।
আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেভাবে এসব অনলাইন গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে তা জাতির জন্য অশনিসংকেত। তাই কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে চাই
চলে যাবো তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ,
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ সবল ভাবে গড়ে তুলতে এবং জাতীয় স্বার্থে এর থেকে পরিত্রান অত্যন্ত জরুরী।এতে অগ্রণী ভূমিকা পালণ করতে পারে তাদের বাবা-মা, ভাই -বোন ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা। দরকার একটু পারিবারিক সচেতনতা ও তীব্র ইচ্ছাশক্তি। তাদেরকে মোবাইল গেমিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। গেমস খেলা থেকে বিরত রাখতে তাদের বইপড়া, খেলাধুলা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় কাজে উৎসাহিত করা। এবং তাদের সার্বক্ষণিক মনিটরিং এ রাখা যাতে তারা এসব গেমসে খুব কম সময় ব্যয় করে। তারা অনলাইনে যেটুকু সময় ব্যয় করে তা যেন বিভিন্ন শিক্ষামুলক ওয়েবসাইট, বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল ইত্যাদিতে ব্যয় করে। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরাই পারে অনুশাসনের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে মোবাইল গেমিংয়ের এ অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনতে। না হলে পরবর্তী প্রজন্ম হবে জাতির জন্য হুমকি স্বরূপ এক মেধাশূন্য জাতি। যার দ্বায়ভার বয়োজ্যেষ্ঠরা কোনভাবেই এড়াতে পারেন না।
তাই আসুন অনলাইন ও মোবাইল গেমিংয়ের এই আসক্তিকে না বলি। সুস্থ ও মেধাবী প্রজন্ম গড়ে উঠতে সহায়তা করি। যারা নেতৃত্ব দিবে আগামীর বিশ্বে মহাকাশ গবেষণায় কিংবা প্রযুক্তির ক্ষেত্রে।
লেখক: শিক্ষার্থী, শেরপুর সরকারী কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
অনলাইন গেমস জাতির জন্য অশনি সংকেত মাজেদুল ইসলাম রিপন মুক্তমত