Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার

ড. দেবাশিস চন্দ্র আচার্য্য
২৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৪:৩৫

বর্তমান সরকার কৃষি বান্ধব সরকার। ২০০৮ সালে সরকার গঠনের পর কৃষি ও কৃষকের কথা চিন্তা করে ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি কোনো ঝামেলা ছাড়াই সরকারি ভর্তুকি পেতে কৃষকদের ১০ টাকা প্রারম্ভিক জমা দিয়ে ব্যাংক হিসাব খোলার অনুমতি দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকার বিশেষ নির্দেশ দেয়।

সেক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয় যে, কৃষকদের অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ব্যালেন্স রাখার শর্তটি বাতিল করতে হবে এবং তাদের পরিষেবার জন্য কোনো ধরনের ফিও নেওয়া যাবে না। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে কৃষকদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কৃষকরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষিঋণ প্রপ্তির ফলে কৃষিতে ব্যাপক বিপ্লব সাধিত হয়। এতে গ্রামীণ ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকেরা গ্রামীণ মহাজনের কাছ থেকে উচ্চহার দাদনের হাত থেকে মুক্তি পান।

বিজ্ঞাপন

এখন যে কোনো কৃষক জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্ম নিবন্ধন সনদ বা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্ড দেখিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। কৃষক সম্প্রদায় যেন সরকারের দেওয়া ভর্তুকি সহজে পেতে পারে, সেজন্য সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে সরকার সার, বিদ্যুৎ ও ডিজেলে বিশেষ ভর্তুকি দিচ্ছে, যেন কৃষকরা স্বল্প খরচে তাদের কৃষি পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে পারে এবং এর মাধ্যমে দেশের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বিধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমান সরকার কৃষি সরঞ্জামে ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে কৃষকদের উৎপাদিত ফসল স্বল্প খরচে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে কাজ করে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার সরকার কৃষককে মাত্র ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলার সুযোগ করে দেওয়ায় ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৫৪৮টি ব্যাংক হিসাব খোলা সম্ভব হয়েছে। যেখানে বর্তমান স্থিতি প্রায় ২৮২ কোটি টাকা।

বিজ্ঞাপন

দেশের মানুষ শতভাগ বিদ্যুতের আওয়ায় আসায় সেচ ব্যবস্থা নিয়মিত হয়েছে। সেচ মৌসুমে প্রান্তিক অঞ্চলে বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে সরকারের পক্ষ থেকে মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে কৃষিকাজে নিয়োজিত জনসংখ্যার মধ্যে ব্যাপক দারিদ্র্য, কৃষি কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাব, কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে উপযুক্ত প্রযুক্তির অপ্রতুলতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবজনিত কারণে বিভিন্ন ফসলের ফলন হ্রাসের কারণে কৃষিতে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি ও সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বজায় রাখতে খাদ্য উৎপাদনে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে ভবিষ্যতে যে কোনো সংকট মোকাবেলার জন্য নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে। সম্ভাব্য খাদ্য সংকট এড়াতে নিজস্ব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তাই এখন আমাদের শ্লোগান হওয়া উচিত, “এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী রাখা উচিত নয়” বৈশ্বিক সংকটের কারণে আমাদের সোনার বাংলাদেশ যেন কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হয়, সেজন্য কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা নিরসনকল্পে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে, যেন খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর হতে প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।

বর্তমান সরকার টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল উন্নতি সাধিত হয়েছে, যা কৃষি এবং ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। পণ্য পরিবহন অধিকতর সহজ হয়েছে। ফলে কৃ্ষক তার উৎপাদিত ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছেন ও কৃষিকাজে আগ্রহী হচ্ছেন। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সারাদেশে কৃষি জমি চাষে ৯০%, আগাছা দমনে ৬৫%, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০%, সেচকার্যে ৯৫% এবং ফসল মাড়াইয়ের কাজে ৭০% যান্ত্রিকীকরণ সম্ভব হয়েছে।

বর্তমান সরকারের আরেকটি বড় সাফল্য হলো কৃষি গবেষণাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। এর ফলে প্রতিটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে গবেষণার মাধ্যমে নতুন ফসলের জাত উদ্ভাবনের ফলে কৃষি উৎপাদনে বিশ্বে প্রাথমিক কৃষি পণ্য (শুধুমাত্র ফসল) উৎপাদনে ১৪ তম স্থান অর্জন করেছে। দেশে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল কৃষি তথা ই-কৃষি’র প্রবর্তন করা হয়েছে। মোট ৪৯৯টি কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র, কৃষি কল সেন্টার-১৬১২৩, কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষি তথ্য বাতায়ন তৈরি করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রান্তিক কৃষকসমাজ সহজেই কৃষিখাতের আধুনিকায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারছেন।

বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির মধ্যেও কৃষকের পাশে ছিল শেখ হাসিনার সরকার। করোনায় শ্রমিক সংকটে থাকা কৃষকদের জমির পাকা ধান যেন ঘরে তুলতে সমস্যা না হয়, সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা স্বেচ্ছাশ্রমে কৃষকদের ধান কাটতে সহায়তা দেন। কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ তহবিল থেকে সহজ শর্তে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ নিতে পেরেছিলেন কৃষক। করোনার সময়ে সারের ভর্তুকি বাবদ ৯ হাজার কোটি টাকা, কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য ১০০ কোটি টাকা, বীজের জন্য ১৫০ কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য আরও ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশের বেকার যুব সমাজকে কৃষিতে উৎসাহিত করতে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের অধীনে কৃষি বিষয়ক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ন্যূনতম ৮ম শ্রেণি পাশ যে কোনো যুবক এ প্রশিক্ষণে অংশ নিতে পেরেছেন। অংশগ্রহণকারীদের প্রত্যেককে মাসিক চার হাজার পাঁচশ টাকা প্রশিক্ষণ ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রশিক্ষিতদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্যে ৬০ হাজার থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষকদের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। বর্তমান সরকার বিগত ১৩ বছরে কৃষি খাতে ৯৭ হাজার ৮৭৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ভর্তুকি দিয়েছে । এর মধ্যে সারে ভর্তুকি ছিল ৯৫ হাজার ১৬১ কোটি ৫ লাখ এবং বিদ্যুতে এক হাজার ৯৬২ কোটি ৫০ লাখ টাকা।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেশভিত্তিক কৃষি উৎপাদন পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় ২০২১ সালে ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। এতে চাল, মসুর ডাল, আলু, পেঁয়াজ এবং চা, সেইসঙ্গে বিভিন্ন ধরণের ফলের মতো পণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। গত এক দশকে কুমড়া, ফুলকপি এবং সমজাতীয় সবজির মতো কিছু পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ তালিকায় যুক্ত হয়েছে। মাছেভাতে বাঙালি। বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। গত চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ইন্দোনেশিয়ার পিছনে তৃতীয় অবস্থানে চলে যায়। শীর্ষে রয়েছে চীন ও ভারত।

বাংলাদেশ পাট, সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে । ধান, রসুন এবং অন্যান্য শ্রেণির শস্যের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। জাম, বরই, করমচা, লটকন ইত্যাদি এবং অন্যান্য শ্রেণিবদ্ধ সুগন্ধি মশলা চতুর্থ। মসুর ডাল ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল (কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি) উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। সপ্তম অবস্থানে রয়েছে পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বীজ এবং নারকেল উৎপাদনে। চা ও কুমড়ায় বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। আম, পেয়ারা ও কাউডাল, ফুলকপি ও ব্রোকলি এবং মটরশুটি ও পাখির খাদ্যে (বীজ) বাংলাদেশের অবস্থান নবম।

বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পাঁচ বছরের উদ্যোগ গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত করতে পারলে আমরা আরও অনেক ফসলের মাথাপিছু ব্যবহারের ক্ষেত্রে শীর্ষ দশে প্রবেশ করতে পারব। আমাদের কৃষির এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হবে এবং এর জন্য আমাদের সকলকে নিরলসভাবে কাজ করে যেতে হবে, যেন পুনরায় বর্তমান শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসতে পারে এবং কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নে পূর্বের ন্যায় ভবিষ্যতেও কাজ করে যেতে পারে।

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে কৃষকদেরও স্মার্ট কৃষক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে সুখী, সমৃদ্ধি ও উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারা বাংলাদেশের জনগণের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা নিশ্চিত করতে হবে এবং বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের কৃষি নীতিসমূহ যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে খোরপোশ কৃষিকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে হবে।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর