প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাংকিং ব্যবস্থার মতো
২ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৫৫
“ক্ষুধার কারণে কোনো পড়াশুনোই আমার মাথায় ঢুকতো না। এমন না যে আমি বোকা ছিলাম বা আমার আগ্রহের কোনো অভাব ছিল। আমার সামাজিক অবস্থা আমাকে শিক্ষা নিতে দেয়নি। বাস্তব অভিজ্ঞতা আরও একবার সামাজিক শ্রেণী ও শিক্ষার মধ্যের সম্পর্ককে বুঝিয়ে দিল”।
উক্তিটির মধ্যে নিহীত রয়েছে একটি সমাজের প্রতিচ্ছবি, একটি দেশের আর্থ সামাজিক প্রতিচ্ছবি এবং একটি সংগ্রামময় জীবনের প্রতিচ্ছবি। বলছিলাম বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ, সমাজ সংস্কারক, একজন মানবতাবাদী শিক্ষক ও দার্শনিক পাওলো ফ্রেইরির কথা। নিজের জীবনের এই কঠিন বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি নিজে শিক্ষায় আলোকিত হয়েছেন এবং দরিদ্র, নিপীড়িত মানুষের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের অনুপ্রেরণা লাভ করেছিলেন।
পাওলো ফ্রেইরি ১৯২১-সালের ১৯-শে সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের উত্তর-পূর্ব প্রদেশ পারনামবুকোর রাজধানী রেসিফের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩০-এর বিশ্বজুড়ে তৈরী হওয়া মহামন্দার সময় তার পরিবার রেসিফে ছেড়ে তুলনামূলক ভাবে কম খরচের শহর গুয়ারারপেসে স্থানান্তরিত হয়ে আসেন। এর কয়েক বছর পরেই তার বাবা মারা যান। দারিদ্র্য ও ক্ষুধার জ্বালা তখন তার নিত্যসঙ্গী। পড়াশুনোতে ক্রমশ পিছিয়ে পড়েন। দিন কাটে বস্তির আরো পাঁচজন দরিদ্র সমবয়সীদের সঙ্গে অলি-গলিতে ফুটবল খেলে। রূঢ় বাস্তব থেকে শিক্ষা নিতে থাকেন। এই সময়ের অভিজ্ঞতাই তাঁর পরবর্তী জীবনের কর্মপন্থাকে নির্দিষ্ট করে দেয়। শেষ পর্যন্ত তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়। ১৯৪৩-সালে তিনি রেসিফে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’স্কুলে পড়ার সুযোগ পান।
এখানে তিনি মূলতঃ দর্শন, ফেনোমেনোলজি এবং ভাষার মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনো করেন। যদিও তিনি আইনজীবী হিসাবে নাম নথিভূক্ত করেছিলেন, কিন্তু কোনোদিনই এই পেশায় অংশ গ্রহণ করেন নি। নিজের পেশা হিসাবে বেছে নেন একটি সেকেন্ডারি স্কুলের পর্তুগীজ ভাষার শিক্ষকতাকে। ১৯৪৪-এ বিবাহ করেন সহকর্মী এলজা অলিভিয়েরাকে। ১৯৪৬-এ পাওলো ফ্রেইরি পারনামবুকো প্রদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। প্রাথমিক ভাবে দরিদ্র, নিরক্ষর শিশুদের মধ্যে শিক্ষা প্রসারের জন্য নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করতে শুরু করেন, যা পরবর্তীতে সমগ্র ব্রাজিলের সমাজ-সংস্কৃতির ক্ষেত্র ছাড়িয়ে রাজনীতির আঙিনায় আলোড়ন সৃষ্টি করে।
পাওলো ফ্রেইরি ও ব্রাজিলের উত্তরপূর্বের রাজনীতি ১৯৫৮-১৯৬৪:
ব্রাজিলের উত্তরপূর্ব অংশটি গঠিত ছিল তিনটি প্রদেশ নিয়ে—পারনামবুকো, রিও গ্র্যান্ডে দোনারতে এবং সারগিপে, যা আয়তনে মূল ভূ-খন্ডের ১৫ শতাংশ এবং জনসংখ্যায় এক তৃতীয়াংশ। খরা-পিড়ীত, দারিদ্র্য-কবলিত অধিবাসীদের মাথাপিছু আয় ছিল লাতিন আমেরিকায় সর্বনিম্ন। নিরক্ষরতা ব্রাজিলের আর্থিক উন্নতির পথে ছিল প্রধান বাধা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নব গঠিত ইউনেস্কো অনুন্নত দেশগুলিতে কার্যকরী শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারের ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। এদিকে চল্লিশের দশকে ব্রাজিলে নিরক্ষর মানুষের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। তাই বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাদেশিক বা জাতীয় সরকার গঠনে কোনো ভূমিকা ছিল না। ১৯৪৭-এ ব্রাজিল বয়স্ক শিক্ষার জন্য রাত্রিকালীন শিক্ষার ব্যবস্থা করে, যা ১৯৫৪ সালে বন্ধ হয়ে গেলেও শিক্ষা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে আগ্রহ তৈরী করে দেয়। ১৯৫৮-তে নিরক্ষরতাকে একটি ব্যাধি হিসাবে গন্য করে তা দূরীকরণের প্রচার চালানো হয়। ইতিমধ্যে বিপ্লবোত্তর কিউবা এক বছরে নিরক্ষরতার হার ২৩ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশে নামিয়ে আনে। লাতিন আমেরিকাকে কিউবার প্রভাব মুক্ত রাখার তাগিদ থেকে ইউ এস ১৯৭০-এর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে সমগ্র লাতিন আমেরিকাকে নিরক্ষরতা মুক্ত করার প্রতিজ্ঞা করে, এবং ব্রাজিলে নিজেদের পছন্দসই সরকার রাখার তাগিদে শিক্ষা অভিযানে আর্থিক সাহায্য নিয়ে আসরে হাজির হয়ে যায়। এমতাবস্থায় ব্রাজিলের উত্তরপূর্বের স্বাক্ষরতা অভিযান প্রাদেশিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনীতি তথা ব্যালট বাক্সের লড়াই এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল।
পারনামবুকোর শিক্ষা ও সংস্কৃতি দপ্তরের অধ্যক্ষ হিসাবে ফ্রেইরি প্রথমেই বিদ্যালয় ও পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনে মনোযোগ দিলেন এবং বাস্তব সমস্যায় শিক্ষার প্রয়োগ সংক্রান্ত অসুবিধাকে অনুধাবন করলেন। তিনি তার নিজস্ব পদ্ধতি—কথোপকথনের মাধ্যমে বিশ্বকে জানা-বোঝার কাজে অগ্রসর হলেন। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি আরও কিছু ব্যক্তির মিলিত প্রচেষ্টায় রেসিফের দরিদ্র মানুষের মধ্যে “জনমুখী সাংস্কৃতিক অভিযান” নামে একটি উদ্যোগ শুরু করলেন। রেসিফের মেয়রের সক্রিয় সহযোগিতায় শিল্পী, রাজনৈতিক কর্মী, পেশাজীবী মানুষেরা পাড়ার ক্লাবঘর, চার্চ ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ২০০-টির মতো স্কুলে ১৯০০০ ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে কাজ শুরু হয়, যেখানে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের পরিবেশ ও সংস্কৃতিকে জানা-বোঝার চেষ্টা চলে। ১৯৬২-তে ফ্রেইরি রেসিফে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীকে তিনি তাঁর শিক্ষা অভিযানের কারিগর হিসাবে যুক্ত করে নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিত কর্মসূচী হিসাবে। জনমুখী সাংস্কৃতিক অভিযানের বয়স্ক শিক্ষাকে ইউ এসের মিনিস্ট্রি অব কাউনসেল জেনারেল শ্রেণী-দ্বন্দ্ব তৈরীর উপযোগী রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যক্ত করেন।
এরপর রিও গ্র্যান্ডে দোনার্তে প্রদেশ থেকে ফ্রেইরিকে আমন্ত্রন জানানো হয় সেখানকার স্বাক্ষরতা অভিযানের দায়িত্ব নেবার জন্য। এখানে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪০ বছর। প্রতি ১০০০ নবজাতকের মধ্যে ৪২০ জন মারা যেত। বেশির ভাগ মানুষ ছিল কৃষিজীবী। কিন্তু ৯০ শতাংশ জমি ছিল আংশিক ঊষর। তাই মানুষের অবস্থাও ছিল হতদরিদ্র। রিও গ্র্যান্ডে দোনার্তের অঙ্গিকসে ব্রাজিল সরকারের তরফ থেকে স্বাক্ষরতা অভিযানের পাইলট প্রোগ্রাম নামানো হলো। এখানে ফ্রেইরি ও তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিত কর্মসূচীর কারিগররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিরক্ষর মানুষজনকে সংগ্রহ করলেন। মাইকে ভ্রাম্যমান প্রচার চালানো হলো অংশগ্রহনের জন্য। এখানে ফ্রেইরি ছোট ছোট সাংস্কৃতিক চক্র তৈরী করলেন। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সের মোট ২৯৯ জন এবং একজন ৭২ বছর বয়সের মানুষ শিক্ষার্থী হিসাবে অংশগ্রহন করলেন, যাদের মধ্যে ৯২ জন ছিলেন গৃহ পরিচারক-পরিচারিকা। সাংস্কৃতিক চক্র গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা কথোপকথনে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করতেন। তাদের প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন শব্দ থেকে আলোচনা শুরু হয়ে তা ক্রমশ গভীরতা ও বিস্তার লাভ করতো। ক্রমে অঙ্গিকসের অনুকরণে বিভিন্ন জায়গায় আরও অনেক সাংস্কৃতিক চক্র গড়ে উঠলো। ফ্রেইরির কথায়—এটা শুধু শব্দ বা বাক্য পাঠ নয়, এটা ছিল জীবনকে পাঠের অনুশীলন। নতুন মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির পথে ব্রাজিলের অধিক্রমণ।
ছোট্ট প্রদেশ সারগেপির স্বারক্ষতা অভিযানের মূল চালিকা শক্তি ছিল ব্রাজিলের ফ্রেডারেল সরকার। কিন্তু রিও গ্র্যান্ডে দোনার্তের সাফল্য এবং মানুষের সচেতন জন জাগরণ তাদের দ্বিধান্বিত করে তুলল। এদিকে ব্রাজিলে ভোটাধিকার পেতে পারেন এমন নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা ছিল ২০ মিলিয়ন। সংসদে নিরক্ষর মানুষের ভোটাধিকারের আইন যখন পাশ করানো গেল না তখন বাধ্য হয়ে ফ্রেডারেল সরকার ফ্রেইরির স্মরণাপন্ন হলো। কিন্ত এখানে ফ্রেইরি শিক্ষক প্রশিক্ষণের পরে আর অগ্রসর হতে পারলেন না। ১৯৬৪-র জানুয়ারীতে আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধ হলো। ইউ এস ব্রাজিলে কিউবার ভূত দেখতে পেল। তার থেকেও মজার বিষয় হলো সেনা বাহিনী অধিক সচেতন ও সক্রিয় হয়ে উঠল। তারা আর নিজেদের কেবল মাত্র ভোটদানে সীমাবদ্ধ না রেখে নিজেরাই ক্ষমতা দখল করে নিল ১৯৬৪-র মার্চ মাসে। পিছনে থাকল ইউ এসের সমর্থন। ফ্রেইরি ও তার সহযোগীরা কারারুদ্ধ হলেন। কিন্ত সেনাবাহিনী দ্বিধাবিভক্ত হলো এই প্রশ্নে যে—শিক্ষণ পদ্ধতিটি বিপ্লবাত্মক নাকি ফ্রেইরি ও তার সহযোগীরা বিপ্লব করার চেষ্টা করছিলেন। যাই হোক ৭০ দিনের মাথায় ফ্রেইরি মুক্ত হন ও বোলিভিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেন।
১৯৬৪-র পরবর্তীতে ফ্রেইরি:
ফ্রেইরি ও তাঁর পরিবার ১৯৬৪ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত নির্বাসিত জীবনযাপন করেন প্রথমে বোলিভিয়ায় ও পরে চিলিতে। চিলির সরকারের আমন্ত্রনে তিনি তার স্বাক্ষরতা প্রকল্প চালিয়ে যান সেখানকার কৃষকদের মধ্যে। নির্বাসিত জীবনে তিনি তার শিক্ষা ভাবনা নিয়ে বেশ কয়েকটি বই রচনা করেন। যার মধ্যে ১৯৬৮ সালে লেখা “পেডাগগি অব দি অপ্রেস্ট” সর্বাধিক সাড়া জাগানো একটি বই। এটি আজ পর্যন্ত সমাজ বিজ্ঞানে তৃতীয় সর্বোচ্চ উদ্ধৃত বই। ১৯৬৯-এ হার্ভার্ড সেন্টার ফর দি স্টাডিজ ইন এডুকেশন এন্ড ডেভলপমেন্টের অতিথি অধ্যাপক হিসাবে কাজ করার পাশাপাশি জেনেভার “অফিস অব দি ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস”-এর উপদেষ্টা হিসাবেও কাজ করেছেন। তিনি “সেন্টার ফর দি স্টাডি অব ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সোস্যাল চেঞ্জ”-এর ফেলো এবং আন্তর্জাতিক জুড়ি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। চিলির বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন এবং চিলির ইউনেস্কোর “ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং ইন এগ্রারিয়ান রিফর্ম”-এর উপদেষ্টা ছিলেন পাঁচ বছর।
১৯৮০-তে তিনি স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে “ওয়ার্কারস পার্টিতে” যোগদান করেন এবং পার্টির প্রাপ্তবয়স্ক স্বাক্ষরতা প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে কাজ করেন। ১৯৮৮ সালে ওয়ার্কারস পার্টি থেকে সাও পাওলোর মেয়র নির্বাচনে জয়ী হয়ে শিক্ষা বিষয়ক পৌর সচিব নিযুক্ত হন। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার ২৯ টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মান সূচক ডিগ্রী লাভ করা মানুষটি, ১৯৯৭ সালের ২-রা মে ৭৫ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তাঁর লেখা পেডাগগি অব দি অপ্রেস্ট প্রসঙ্গে:
“পেডাগগি অব দি অপ্রেস্ট” বা নিপীড়িতের শিক্ষাতত্ত্ব বইটি তিনি চিলির কৃষকদের নিয়ে কাজ করার সময় লেখেন। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাকে মহান দান হিসাবে হাজির করা হয়, যাকে ফ্রেইরি ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করেছেন। শিক্ষক এখানে একজন করনীকের মতো ঘটনা ও ধারণাগুলোকে বলে যান আর ছাত্র-ছাত্রী প্রশ্নাতীতভাবে তাকে ভিতরে জমা করেন। যা পুজি হিসাবে কাজ করে। এই পুজিকে কাজে লাগিয়ে যে সমাজকে আলোকিত করতে পারে সে ব্যবসায় লাভবান আর পুজি কাজে লাগিয়ে লাভবান না হতে পারলে শুধু ঋণের বোঝা ভারী হবে মাত্র। শিক্ষার্থীকে বলা হয় “কঠোর পরিশ্রমই উন্নতির পথ”, বা “সদা সত্য কথা বলিবে”—অথচ সে দেখে তার আশেপাশের লোকজন উদয়োস্ত পরিশ্রম করেও একই অবস্থায় থেকে যায় এবং আদালতে প্রায়শই তারা মিথ্যা অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যায়। শোষিতের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ এই ব্যবস্থায় শোষিত নিজের স্বত্ত্বা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যন্ত্রবৎ আজ্ঞাবহে পরিণত হন। অন্ধ অনুগমন খুব সহজেই প্রতিক্রিয়াশীল আচরনে লিপ্ত হবার সুযোগ তৈরী করে। আর নির্বাক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে শিক্ষক নিজে কিছুই শেখেন না। ফ্রেইরি তাই, এই ব্যবস্থাকে বাতিল করে তার ডায়ালগ বা কথোপকথনের মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের শিক্ষার তত্ত্বকে সামনে নিয়ে আসেন।
তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি কোন বিষয়ে অভ্যাসকে ক্রিয়াশীলতা ও প্রতিফলনের সমন্বয় হিসাবে ব্যক্ত করেন। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক জগতকে দেখার ও ইতিহাসকে বোঝার একটি রূপরেখা তৈরী করে দেন। এখানে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে ঘটা বিভিন্ন ঘটনাকে নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে বোঝার কোনো সুযোগ পান না। পশুরা শুধুমাত্র বর্তমানে বাঁচে কিন্তু মানুষ অতীতকে সঙ্গে নিয়ে বর্তমানে বাঁচে ও ভবিষ্যতকে রূপ দিতে পারে। ফ্রেইরির নিপীড়িতের শিক্ষাতত্ত্ব শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সতীর্থের মধ্যে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যার উৎস ও সমাধানের লক্ষ্যে পৌঁছায়।
শেষ অধ্যায়ে ফ্রেইরির উপস্থাপনায় আমরা দেখতে পাই কীভাবে নিপীড়িত মানুষ নিজেকে একজন মুক্ত মানুষে পরিণত করতে পারে। শোষক তার শিক্ষা পদ্ধতিতে শুধু যে শোষিতের মনুষ্যত্বকে অবদমিত করে তাই নয়, তার মুক্ত হবার প্রক্রিয়াটিকেও অবদমন করে। সংলাপহীনতা হলো সেই যন্ত্র যা অধিকার করে, কৌশলে বিভেদ ও শাসন করে এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালায়। এর বিপরীতে সংলাপ ঐক্য, সহমর্মিতা, সংগঠন ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
সারাবাংলা/এসবিডিই
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাংকিং ব্যবস্থার মতো মুক্তমত মো. সুমন মিয়া