নিরাপত্তামুক্ত শারদোৎসব কি সম্ভব?
৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:০৭
জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এরমধ্যে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা চলমান। সর্বশেষ ২০২১ সালে কুমিল্লায় নানুয়া দিঘির পাড়ের পূজা মণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা সনাতন সম্প্রদায় সহ সকল অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের হৃদয়ে তৈরী হওয়া বড় রকমের ক্ষত এখনও রয়ে গেছে।
এ ঘটনার মূল আসামী ইকবাল হোসেনকে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন সাজানোর মধ্যেও তার সাজা হয়েছে। কিন্তু আড়ালে রয়ে গেছে নেপথ্যের কুশিলবরা। এমন বাস্তবতার মধ্যে নানা আশঙ্কা নিয়ে অনেকটা উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হয়েছে এবারের শারদীয় দুর্গোৎসব! পূজা শুরুর আগে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ থেকে শুরু করে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটি ও সনাতন সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতাদের মুখে একটি কথা বারবার উচ্চারিত হতে শুনেছি, তা হলো ‘আমরা আইনশৃঙ্কলা বাহিনী বেষ্টিত শারদীয় উৎসব চাই না’। এরমধ্যে ঐক্য পরিষদের নেতা রাণা দাশগুপ্ত একটি অনুষ্ঠানে স্পষ্ট বলেছেন, ‘সরকার চাইলে দুর্গোৎসবে হামলা হবে, না চাইলে হবে না’।
হিন্দু সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতাদের চাওয়া পূরণ ও রাণা দাশগুপ্তের মন্তব্য দেশের বাস্তবতায় কতোটুকু বাস্তব সম্মত? সত্যিই বাংলাদেশে কোন রকম নিরাপত্তা বেষ্টনী ছাড়া দুর্গোৎসব পালন সম্ভব? সরকার তথা রাজনৈতিক শক্তি চাইলে নিরাপদে পাঁচদিনের দুর্গাপূজা সম্পন্ন করা খুব কঠিন বলে মনে হয় না।
একটা সময় সার্বজনীন অসাম্প্রদায়িক এই উৎসবে তো নিরাপত্তার প্রয়োজন হতো না। সবাই মিলে মিশে পূজার আয়োজন করত। এখনও বয়স্কদের থেকে ছোটবেলার দুর্গোৎসবের আয়োজনের কথা শুনলে আকাশ পাতাল ব্যবধান মনে হয়। সমাজ কতোটা বদলেছে, এটাই বড় প্রমাণ। আগে যা হয়েছে এখন এর ছিটেফুটাও নেই বললে চলে। তবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কিছু মানুষ আছে বলেই এখনও অন্যায়ের প্রতিবাদ হয়।
বিশেষ করে ’৯০ দশকের শুরু থেকে এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচড়া দিয়েছে। ধর্মান্ধ গোষ্টী সাধারণ মানুষদের নানা প্রলোভনে নিজেদের পাল্লা ভাড়ি করার চেষ্টায় অনেকটা সফল। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও দেশপ্রেমিক মানুষগুলো অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। এখন তো রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে সবখানেই পুলিশ, র্যাব, আনসার সহ ম-পে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরদারি। নেপথ্যে কাজ করে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। এরমধ্যে উৎসব পালনে বেশকিছু বিধিনিষেধ তো রয়েছেই। পাশাপাশি প্রতিটি পূজা কমিটি নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব জনবল রাখে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে সরকারকেও পাঁচদিনব্যাপী উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় পার করতে হয়। এবারও পূজার প্রস্তুতি সভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে এমন উৎকণ্ঠার কথা শোনা গেছে। বাস্তবতা এমন পর্যায়ে গেছে, প্রতীমা দ্রুত বিসর্জন দিতে পারলেই সবার স্বস্তি আর নিস্তার বলা যায়। একথা কোনভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই।
সত্যিই তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে কোন সার্বজনীন উৎসব হতে পারে? পরিবেশটি মনে হয় শেকলে জড়ানো। যেখানে ধর্ম চর্চায় অবাধ স্বাধীনতা নেই। কখন অন্য ধর্মের অনুভূতিতে আঘাত আসে, এই আতঙ্ক নিয়ে থাকতে হয়। যেন ছাদ ঢাকা- তবুও মুক্ত আকাশের নীচে বসবাস।
একটি ধর্মীয় উৎসব, যেখানে সকল ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের মানুষ অংশ নেয়, সেখানে এত বিধিনিষেধ বা পাহারা কেন থাকবে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমৃদ্ধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে কেউ ভাবেনি। যদিও এজন্য রাজনীতিই প্রধান দায়ি। এর কারণ হলো, ‘৭২ এর সংবিধান কাটাছেড়া করে রাজনৈতিক স্বার্থে রাষ্ট্রের গায়ে ধর্মের কালিমা লেপন করা হয়েছে। নানামুখি মহলের দাবির প্রেক্ষিতেও রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িকতার শেকড়ে আর ফিরে যেতে পারেনি। সেইসঙ্গে বিশে^র ক্ষমতাধর অশুভ শক্তি বাংলাদেশ সহ গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে। সমাজকে দুইভাবে বিভক্ত করার লক্ষ নিয়েই তারা এই অপকর্মটি করেছে। তাদের সফল হওয়া মানেই, সমাজে উগ্রবাদ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শান্তি বিনষ্ট করা।
রাজনৈতিক দলগুলো উগ্র-সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীকে নিজস্ব স্বার্থে ভোটের রাজনীতির কারণে লালন পালন করে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে কট্টরপন্থী ধার্মীক বাড়ছে। নানা পৃষ্ঠপোষকতায় বাড়ছে কট্টর ধর্মবাদীরা। যারা অন্য ধর্মকে কোনভাবেই সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আগে আমরা সাবাই মানুষ, পরে ধর্ম। এই চিন্তা এখন অনেকটাই উপেক্ষিত। কাজেই রাজনৈতিক চিন্তা ও আদর্শকে উপেক্ষা করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ থেকে উত্তোরণের জন্য রাজনৈতিক স্বদিচ্ছা নিয়ে রাষ্ট্রের গাঁ থেকে ধর্মের কলঙ্ক দূর করা গেলে, উগ্রবাদি গোষ্টী অনেকটা পিছু হঠবে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ গড়ার চেতনায় ফিরে যাওয়া সময়ের দাবি।
রাণা দাশগুপ্ত পূজায় হামলা প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা একেবারে অযৌক্তিক বলা যাবে না। নির্বাচন আসন্ন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আওয়ামী লীগ ভোট ব্যাংক মনে করে। তাই এবারের দুর্গাপূজায় সরকার হামলা রোধে বিশেষ সতর্কতা পালন করেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাঅষ্টীতে ঢাকেশ^রী জাতীয় মন্দিরে প্রতীমা দর্শন শেষে সনাতন সম্প্রদায়ের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন।
সরকারের মন্ত্রী, আমলা, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ এলাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পূজা ম-পে গেছেন। সেফলি তুলেছেন। অংশ নিয়েছেন উৎসবের নানা আয়োজনে। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরাও ম-পে ম-পে ঘুরেছেন। নির্বাচন সমাগত হওয়ায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ভীড় পূজা ম-পে বাড়লেও এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু এর ধারাবাহিকতা থাকা প্রয়োজন।
তেমনি বিরোধী দল বিএনপিও অতীতের কলঙ্ক মোচনের চেষ্টা করছে বলে মনে হয়। কারণ এবারের দুর্গাপূজায় দলের মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় ও মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতাদের মন্দিরে দেখা গেছে। জাতীয় পার্টির পিছিয়ে ছিল না। বিভিন্ন সেক্টরের পরিচিত মুখ ও ছোট বড় পর্দার অনেক তারকাকে পূজা ম-বে দেখা গেছে।
সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনার জায়গা থেকে উৎসবে যোগ দেন, তাহলে সাম্প্রদায়িক শক্তি পরাজিত হবে বলে বিশ^াস করি। কারণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকেও রাজনৈতিক শক্তিই সবচেয়ে বড়। ম-পে ম-পে যখন সার্বজনীন উৎসবে নেতাকর্মীরা অংশ নিবেন; তখন ষড়যন্ত্রকারীরা হিসাব করে পা ফেলবে। কেউ বিছিন্ন ঘটনা ঘটনানোর চেষ্টা করলেও সকলের উপস্থিতিতে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কোন অপ্রিতীকর ঘটনায় স্ব-স্ব এলাকায় রাজনৈতিক কর্মীরা ম-পে অবস্থান নিলে বা সংখ্যালঘুদের পাশে থাকলে কারো সাহস নেই হামলা করার। এর পরও যদি কোন অঘটন ঘটেই যায়, তাহলে সবাই মিলে প্রতিহত করার ঘটনা হামলাকারী গোষ্ঠীকে কড়া বার্তা দেবে। এই বিবেচনায় রাণা দাশগুপ্তের কথার যথার্থতা যথেষ্ট। আমরা এমন ঐক্যের বাংলাদেশ ফিরে যেতে পারি না?
এবারের শারদীয় দুর্গোৎসবে যেভাবে রাজনৈতিক সমর্থন, সকলের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা পাওয়া গেছে, এমন সার্বজননীনতার ধারাবাহিকতা রক্ষা হলে আগামী দিনে বাংলাদেশে হয়ত পূজায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজন হবে না। সকলে মিলে মিশে উৎসবের আয়োজন ও সম্পন্ন করা যাবে। এরআগে সবাইকে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। উৎসব যেন কারো ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক আক্রোশ মেটানোর উপলক্ষ না হয়, সেদিকে নিজ থেকেই স্বচ্ছ থাকা জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই