বাবা-মায়ের বার্ধক্যে কেন সন্তানের এত অবহেলা
৪ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৩৫
বাবা-মা হলেন মহান আল্লাহ তায়ালার দেওয়া সবচেয়ে বড় নেয়ামত। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের সূরা বনি ইসরাইলে বর্ণিত আছে যে, তোমরা আল্লাহকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না, বাবা-মায়ের সাথে উত্তম ব্যবহার কর এবং তাঁদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয় তবে, তাঁদের উহ’ শব্দটিও বলো না, তাঁদের ধমক দিও না আর তাঁদের সঙ্গে সুন্দরভাবে কথা বল। এছাড়া আরো বলা হয়েছে তোমাদের যদি তাঁরা কোন শিরক করতেও বলে তোমরা তা না করে তাদের সাথে সুন্দর সম্পর্ক বজায় রাখবে। অর্থাৎ আমাদের উচিত বাবা-মাকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে সকল ধরনের সহযোগিতা করা।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে বাবা-মায়ের বার্ধক্য তাঁদের জন্য সুখকর না হয়ে অভিশাপে রুপান্তরিত হচ্ছে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে অনেক সন্তান তার মাথার বোঝা মনে করে। এরকম কিছু ঘটনার সারসংক্ষেপ দেখে নেওয়া যাক। আপনাদের নিশ্চয় কুমিল্লার মাহে আলমের কথা মনে আছে। পারিবারিক কলহের জের ধরে সন্তান রাসেল আহমেদ বাবাকে খাটের উপর ফেলে মারধর করে। আপনাদের নিশ্চয় চাঁদপুরের শিল্পী বেগমের কথা মনে আছে। বৃদ্ধ বাবার কোন ছেলে নেই। তিন কন্যার মধ্যে সবচেয়ে ছোট কন্যা শিল্পী বেগমের সাথে তিনি থাকেন। বাবার গায়ে হাত দেওয়া অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা এগুলো ছিল শিল্পী বেগমের নিত্য দিনের বুলি। আরো আছে তো। আপনাদের নিশ্চয় ফিরোজ ভূঁইয়ার কথা মনে আছে। তিনি ছিলেন সোনালী ব্যাংকের একজন অফিসার। মৃত্যুর ছয় মাস পূর্বে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, সন্তানের নির্যাতনে নিজের সকল সম্পত্তি তার নামে লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ছেলে আবির বাবার সবকিছু কেড়ে নিয়েই শান্ত হয়নি করেছেন তাদের বাড়ি ছাড়া। অসুস্থ ফিরোজ ভূঁইয়ার বৌ সহ ঠাঁই হয়েছে অন্যের বাড়িতে।
এভাবেই প্রতিনিয়ত এমন হাজারো রাসেল আহমেদ,শিল্পী বেগম এবং আবিরের মতো সন্তানদের নির্যাতনে বৃদ্ধ বাবা-মা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে দুনিয়া ত্যাগ করেন। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। আল্লাহ কী আমাদের মধ্যে বিবেক নামের কোন কিছু দেয়নি? আল্লাহ কী আমাদের অন্তরে ধর্মীয় শিক্ষার জ্ঞান দেয়নি? কিভাবে আমরা বাবা-মায়ের প্রতি এরকম বর্বর আচরণ করার সাহস করি ? হায়রে কোথায় আমাদের বিবেক কোথায় আমাদের মানবিক গুণাবলী। তবে কী আমরা বাবা-মায়ের প্রতি এরকম আচরণ করে আমাদের আর পশুর মধ্যে যে তফাৎ রয়েছে সেটা ভেঙ্গে দিচ্ছি।
আসুন বাবা-মায়ের উপর নির্যাতন করা সন্তানেরা। আপনাদের চোখে আঙুল দিয়ে একটু দেখানোর চেষ্টা করি। আজকের আমাদের পিছনে তাঁদের অবদান কতটুকু। দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করে একজন মা আমাদের দুনিয়ার মুখ দেখান। বলা হয়ে থাকে,একটি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একজন মা প্রায় ৫৭ ডেল ব্যাথা অনুভব করেন যা একসাথে প্রায় ২০ টি হাড় ভাঙ্গার সমান। যদিও রিউমর স্ক্যানার টিম বলছে,সন্তান জম্ম দানের সময় একজন মা ৫৭ ডেল ব্যাথা অনুভব করার তথ্যটি সঠিক নয় । তবে ১৯৪০ এর দশকে ব্যথার তীব্রতা পরিমাপ করার জন্য “ডল স্কেল নামের একটি সিস্টেম তৈরি করা হয়েছিল যা ডল স্কেল একক হিসেবে পরিচিত। আবার ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, ১০.৫ ডল স্কেল হলো সর্বাধিক ব্যথার তীব্রতা। অর্থাৎ একজন মা সন্তান ভূমিষ্ঠ করার সময় সর্বাধিক ১০.৫ ডেল স্কেল ব্যথা অনুভব করেন। এতটুকু তো শুধু আমাদের দুনিয়ার মুখ দেখাতে মায়ের ত্যাগ। আমরা যখন দুনিয়ায় এসে কান্না ছাড়া কিছুই করতে পারি না। মা তখন আমাদের কান্নার ভাষা বুঝে সকল চাহিদা পূরণ করেন। এই মা আমাদের দীর্ঘ দু’বছরের অধিক সময় দুগ্ধ পান করান। এভাবেই মা আমাদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। এবার আসুন বাবার অবদান নিয়ে বলি। আমি সবসময় বলি বাবা হচ্ছেন ক্যামেরার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একজন মানুষ। ক্যামেরার আড়ালে থাকা একজন মানুষ যেমন নিজে সামনে না এসেও এত সুন্দর করে একটি চলচ্চিত্র ফুটিয়ে তুলেন ঠিক তেমনি বাবাও আমাদের পিছনে থেকে জীবনে বড় হওয়ার সকল সরঞ্জাম দিয়ে থাকেন।
একবার চিন্তা করুন, এই দুজন মানুষ নিজেদের জীবনের সবকিছু ত্যাগ করে আমাদের জীবন সাজিয়েছেন। আর বিনিময়ে আমরা তাদের বার্ধক্যে দিচ্ছি চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এই কী তবে আমাদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রতিদান। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমার মায়ের পায়ের নিচে তোমার জান্নাত। যে সন্তান বৃদ্ধ বয়সে মাকে ঠিকমতো খেতে পর্যন্ত দেইনি সে কিভাবে মসজিদে সেজদা দিয়ে জান্নাতের আশা করে। যে বাবা-মা সন্তানদের পেট ভরে খাওয়ানোর জন্য নিজেরাই উপোস থাকতেন বৃদ্ধকালে সেই সন্তানই বলে, আমি তোমাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে পারবো না।
বাবা-মায়ের বার্ধক্যে সন্তানের এই অবমাননার পিছনে আমি ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এবং নৈতিকতা হারিয়ে যাওয়াকে দায়ী করছি। আমরা হয়তো নৈতিক ভাবে অবগতই নই বাবা-মা আমাদের জন্য কী এবং কেন বাবা-মাকে আগলে রাখতে হবে। অনেকে বাবা-মা হয়তো জানেন না, তাঁরা যখন বৃদ্ধ হবেন কর্মক্ষম সন্তানের কাছে তাঁদের আইনত কিছু অধিকার থাকবে।প্রচলিত আইন অনুযায়ী বৃদ্ধ মা-বাবা তার কর্মক্ষম সন্তানের কাছে সম্মান ও ভরণপোষণ পেতে আইনের আশ্রয় চাইতে পারবেন। দেশে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ কার্যকর রয়েছে। এ আইনের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক কর্মক্ষম সন্তানকে মা-বাবার ভরণপোষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আসুন একদিন আমি- আপনি সকলেই বাবা-মা হবো। সেদিন হয়তো আমাদের সন্তানেরাও আমাদের সাথে একই আচরণ করবে। আল্লাহ আমাদের উত্তম নৈতিকতা দান করুক এবং ধর্মীয় শিক্ষার ধারন করার তৌফিক দান করুক। আসুন বাবা-মায়ের বার্ধক্যে তাঁদের হাসিখুশি রাখার শপথ করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম
সারাবাংলা/এসবিডিই
বাবা-মায়ের বার্ধক্যে কেন সন্তানের এত অবহেলা মুক্তমত মো. রাকিব