দেশে এ বছর ৮২ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকারিতা হারিয়েছে। পাঁচ বছর আগে যা ছিল ৭১ শতাংশ। সে হিসাবে পাঁচ বছরে জীবনরক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতার হার বেড়েছে ১১ শতাংশ। গত এক বছর সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয়েছে সেফট্রিয়েক্সন গ্রুপের ওষুধ। সম্প্রতি রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এক গবেষণায় গনমাধ্যম সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের পরিস্থিতি কী তা জানতে ২০১৭ সাল থেকে গবেষণা করছে আইইডিসিআর। গত জুন পর্যন্ত চলে এই গবেষণা। দীর্ঘ সাত বছরে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মিলিয়ে প্রায় ৪০ হাজার নমুনা নিয়ে এ গবেষণা চালানো হয়েছে। সম্প্রতি আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. জাকির হাবিব এক অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির অতিরিক্ত ব্যবসায়ী মনোভাব, অপ্রয়োজনে চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্রে অ্যান্টিবায়োটিক লেখার প্রবণতা এবং ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধের দোকানে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি এ ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সমাধান পেতে সংবেদনশীলতা পরীক্ষা ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
গবেষণা প্রতিবেদন বলা হয়েছে, হাসপাতালের ভর্তি ৬১ শতাংশ রোগীর অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ আইসিইউর রোগী ও ১৩ শতাংশ বহির্বিভাগের রোগী রয়েছে। দেশে তিন শ্রেণির আন্টিবায়োটিক রয়েছে।
এর মধ্যে ওয়াচ গ্রুপ ও রিজার্ভ গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর বেশি হচ্ছে; যা ডায়রিয়া, মূত্রনালি ও ফুসফুসের ইনফেকশনসহ শরীরের বিভিন্ন ক্ষত সারানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বজুড়ে সুপারবাগ ইনফেকশনে বছরে মারা যাচ্ছে ৫০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ মানুষ এই রোগে মারা যায়। বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিস রেজিস্ট্যান্স বেশি হচ্ছে।
সবচেয়ে বেশি খুঁজে পাওয়া জীবাণু ই-কোলাইয়ের বেলায় পোলট্রি শিল্পে ব্যবহৃত ১২ অ্যান্টিবায়োটিকের আটটিই অকার্যকর হয়েছে অন্তত ৪০ শতাংশ। অ্যাম্পিসিলিন, টেট্রাসাইক্লিন ও সিপ্রোফ্লোক্সাসিলিনের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৯০ শতাংশ। দেশে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। সঙ্গে রোগীর শরীরেও অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে উঠেছে। ব্যাকটেরিয়া অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক হয়ে ওঠা একটি নীরব ঘাতক। তাই আমাদের এই সমস্যা থেকে উত্তরণে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। রোগ প্রতিরোধে যেসব নিয়ম মানা উচিত সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা বিপজ্জনক আমরা সবাই জানি, তবে মানছি না। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসকরাও প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছে– এ জন্য অবশ্যই ওষুধ কোম্পানিগুলোর অতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণেও হচ্ছে।
গ্রামের হাতুরে ডাক্তাররা ব্যাপক হারে অ্যান্টিবায়োটিক দেয়। দোকানে প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেভাবে বিক্রি হচ্ছে, এটা বন্ধ করতে না পারলে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হবে না। দোকানদাররা না জেনে এক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দেয়, কিন্তু সে জানে না কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রোগীকে দিতে হবে। কী পরিমাণ দিতে হবে তাও জানে না। রোগী সমস্যা বলার সাথে সাথে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেয়। এ ব্যাপারে রোগী ও ডাক্তারদের মধ্যে সচেতনতা নেই। অনেক রোগী অ্যান্টিবায়োটিকের পুরো ডোজ খায় না। এদিকে মানবদেহে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক পশু-পাখিকে খাওয়ালে ওই পশু যে পানিতে ধোয়া হবে, সেই পানি তা মিশে যায়, এরপর মানবদেহের ভেতরে যায়। এভাবে জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিকের চেয়ে বেশি প্রতিরোধী হয়ে উঠে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ১০ থেকে ২০ বছর পরে অসংক্রমণব্যাধীতে যে সংখ্যক মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মারা যাবে অ্যান্টিবায়োটিকের কারণে। সচেতনতা থাকতে হবে ডাক্তার ও রোগীদের মধ্যে। অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রিও নিয়মতান্ত্রিক হতে হবে। সংসদে কঠোর আইন করে পাশ করে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্হা নিতে হবে। দেশে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে। এক শ্রেণীর চিকিৎসক জেনে-না জেনে কিংবা কোম্পানিকে খুশি করতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রিপশনে লিখছেন। আবার ব্যবসার স্বার্থে প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেদারসে অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করছে ফার্মেসিগুলো। আবার এক শ্রেণীর মানুষ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই নিজেরা অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার বন্ধে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কঠোর নজরদারির কোন বিকল্প নেই।
লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক