Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এইচএসসি’র ফলাফল ও প্রাসঙ্গিক কথা

অলোক আচার্য
২৮ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:৩৪

এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলো। পাসের হার ও জিপিএ প্রাপ্তদের সংখ্যা এবার কমেছে। কারণ হিসেবে এইচএসসি’র ফল প্রকাশ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, গতবার পরীক্ষা সহজ ছিল। কম বিষয়, কম সময় ও কম নম্বরের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। এবার পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এজন্য, পরীক্ষাটাও তুলনামূলক কঠিন হয়েছে। এতে পাসের হার ও জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে। প্রকাশিত ফলাফলে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে। গত কয়েক বছর ধরেই এটা হচ্ছে। গত ১৪ বছর ধরে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় পাসের হারের দিক থেকে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ফেসবুকে যারা এ প্লাস পেয়েছে তারা তাদের ছবি ও ফল দেখছি। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, যারা এ গ্রেড পেয়েছে তারা কিন্তু কেউ নিজেদের ফলাফল প্রকাশ করছে না। এ প্লাস ও গোল্ডেন এ প্লাস প্রাপ্তদেরই যেখানে জয়গান সেখানে তারা লজ্জিত! যদিও লজ্জা পাওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না। যার যেটুকু অর্জন সেটুকু নিয়েই তৃপ্তি থাকার মানসিকতা তৈরি হওয়া উচিত এই স্তর থেকেই। নিজের দুর্বলতাগুলো ঝালিয়ে নিয়ে সমানে এগিয়ে যাওয়া দৃঢ়তা অর্জন করতে হয়। এ প্লাসের ছড়াছড়িকেই আজকাল সন্দেহের চোখে দেখা হয়। আর জীবনে সফলতা লাভের সূত্র এই রেজাল্ট নয়। এই সত্যটি তারা বোঝে না। তাদের কেউ বোঝাতেও যায় না। তাদের পরিবারও তাদের পাশে নেই। শতভাগ পাস এবং শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠানের তালিকা করা হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় শতভাগ পরীক্ষার্থী ফেল করা এবং শতভাগ পরীক্ষার্থী পাস করা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা এবার কমেছে। ২০২৩ সালের উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৯ হাজার ১৮৭ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪২টির কোনো পরীক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি। আর সব শিক্ষার্থী পাস করেছে এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৯৫৩টি। ২০২২ সালে কেউ পাস করতে পারেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৫০টি। সেই হিসাবে এবার শতভাগ ফেল প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কমেছে ৮টি। অন্যদিকে দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সাড়ে ১৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৯৫ জন। ২০২২ সালে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। সেই হিসাবে এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৮৩ হাজার ৬৮৭ জন।

যাদের সন্তান সামান্য পয়েন্টের জন্য এ প্লাস বা গোল্ডেন এ প্লাস পায়নি তারা হতাশ। কিন্তু তাদের হতাশ হওয়ার খুব বেশি কারণ নেই। নিজের সন্তানকে বোঝাতে হবে যে এই গ্রেড পাওয়াই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। প্রতিযোগীতা ভালো। তবে তা জীবনের বিনিময়ে অবশ্যই নয়। এই প্রতিযোগীতার চিন্তা তাদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে ভালো মানুষ হতে উৎসাহ দিতে হবে। আজ ফল খারাপ হয়েছে তবে ভালো করার সুযোগও তো আছে। সবাই চাই কেবল পাসের হারে বৃদ্ধি না বরং মেধার হারে বৃদ্ধি ঘটুক। মেধাবী শিক্ষার্থী যাচাইয়ে যদি পাসের হার কমে তাহলে একটুও আফসোস নেই। কারণ কয়েকজন নামমাত্র শিক্ষিত বেকার যুবকের চেয়ে একজন প্রকৃত মেধাবী দরকার। কারণ সেই একজন বাকিদের কাজের ক্ষেত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখে। সফলতা এবং ব্যর্থতা- জীবনের এই দুটি দিক গ্রহণের মানসিকতা থাকা উচিত। প্রকৃতপক্ষে সঠিক মূল্যায়ন বলতে সেই পরিমাপ কতটা সঠিক তা বলা যায় না। কারণ আজকাল বিভিন্ন পদ্ধতি বারবার পরিবর্তন করা হয়। ঠিক এখানেই নতুন কারিকুলামের স্বার্থকতা হবে। এই ধরনের মূল্যায়ন গ্রেড থাকবে না। আমি চাই কেউ যেন ফেল করে আত্মহত্যা না করে।

পরীক্ষা মানে পাশ আর ফেল। যারা পাশ করছে তারা নিঃসন্দেহে মেধাবী। কিন্তু যারা পাশ করছে না তারা কি মেধা শূণ্য? কোন একটা বা দুইটা বিষয়ে ফেল করলেই কি তার মেধা নেই বলা যেতে পারে? শুধু ফলাফল দিয়ে নিশ্চয়ই কোন ছাত্রছাত্রীর মেধা পরীক্ষা করা যায় না। কারণ স্কুল কলেজের পাশ ফেল শুধু সার্টিফিকেট দেওয়া হয়। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক উদাহরণ আছে যেখানে স্কুলে ছাত্র হিসেবে খুব খারাপ হয়ে পরবর্তী জীবনে বড় বড় ব্যাক্তিদের কাতারে নাম লিখিয়েছেন। এবং এই সংখ্যাটা কিন্তু কম নয়। তাহলে পাশ ফেল এবং মেধা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও সম্পূর্ণ নির্ভর নয়। যে শিক্ষা মানুষের ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে না তার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এতদিন ধরেই শিক্ষা যেন সেই মূল লক্ষ কেবল সার্টিফিকেট। কোনমতে একটা সার্টিফিকেট পেলেই সব শেষ। তারপর এদিক সেদিক ধরাধরি করে একটা চাকরি বাগিয়ে সমাজে দিব্বি মেধাবী সেজে ঘুরে বেড়ানো যায়। একসময় দেশে পরীক্ষায় নকল করার একটা প্রবণতা ছিল। তখন পাসের হারও কম ছিল। কিন্তু সবাই নকল করতে পারতো না। তবে আশ্চর্যের বিষয় কিন্তু সেটা নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো সেসময় পরীক্ষার কেন্দ্রে অসুদপায় অবলম্বন করলেও শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতো না। কে পরীক্ষার কেন্দ্রে নকল করেছে সে বিষয়টার স্বাক্ষী কেবল আরেক পরীক্ষার্থী থেকে যেত। আজ কেন্দ্রের সামনে লেখা থাকে নকলমুক্ত পরীক্ষা কেন্দ্র। তবে শিক্ষার্থীদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় কেন? পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর কোথাও কোথাও আত্মহত্যার খবর আসে যা একেবারেই অনাকাঙ্খিত। এটা একদিনে হয়নি। ধীরে ধীরে সমাজের মানসিকতা পরিকল্পিতভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্যও পরিবর্তিত হয়েছে।

একটু গ্রেড কম পেলে বা গোল্ডেন এ প্লাস না পেলেই জীবনে সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। হতাশার কিছু নেই। বরং অন্য কোন বিষয়ে তার আগ্রহ আছে ধরে নিতে হবে। জীবনের সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করে মনুষ্যত্ব অর্জনে। একজন সৎ সাধারণ মানুষ একজন দুর্নীতিগ্রস্থ অফিসারের চেয়ে দেশের জন্য প্রয়োজন বেশি। আর তাই যারা পরীক্ষায় ফেল করেছে বা আশানুরূপ ফল করতে পারে নি তারা যেন সব শেষ হয়ে গেছে এটা মনে না করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সঙ্গ দিতে পারে সন্তানের অভিভাবক। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি সেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখা দরকার। দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করতে মেধাবী ছাত্রছাত্রীই প্রয়োজন। পাসের হার বৃদ্ধি করে আপাত শিক্ষার প্রসার হলেও মান না বাড়লে স্থায়ী ক্ষতি হয়। এবার পাশের হার কমেছে। জানা গেছে, ইংরেজি বিষয়ের দুর্বলতার কারণ রয়েছে। অথচ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ছোটবেলা থেকে সন্তানকে ইংরেজি বিষয়েই বেশি সময় প্রাইভেট পড়ানো হয়। তাই আমরা চাই আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থায় মেধার বিকাশ ঘটুক। শেষ পর্যন্ত যদি কোন ছাত্রছাত্রী পাস না করতে পারে তার জন্য প্রচলিত সংস্কৃতি অনুসারে তার ফেল করার কারণ উদঘাটন করতে ব্যস্ত না হয়ে তাকে বোঝানো যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত তো সে অবশ্যই জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। জীবন যুদ্ধের পরীক্ষার মত কঠিন পরীক্ষা আর কি আছে। নৈতিকতা, মনুষ্যত্ব এসব লেখাপড়ার রেজাল্ট দিয়ে অর্জন করা সম্ভব না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এটা দিতে পারছে না। এ কারণেই চারদিকে দুর্নীতির বীজ। জিপিএ ফাইভ নিয়ে পাশ করাটাকে আমরা যত সহজে প্রচার করি ফেল করাটাকে গ্রহণ করার মন মানসিকতা আজও গড়ে ওঠেনি। যারা পাশ করতে পারেনি বা যারা এ প্লাস পায়নি তাদের সকলের জন্য রইলো শুভকামনা। নতুন কারিকুলামকে স্বাগত। পদ্ধতির পরিবর্তন হোক। শিক্ষা বাণিজ্যিকিকরণ থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন।

লেখক: কলামিষ্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

অলোক আচার্য এইচএসসি’র ফলাফল ও প্রাসঙ্গিক কথা মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর