Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তৈরি পোশাক শিল্প: মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি

বিপ্লব কুমার পাল
২ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:৩৭

গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে এসেছে। এই শিল্পের চারটি অংশীদার রয়েছে। বিজিএমইএ এই শিল্পের অন্যতম অংশীদার। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি করতে হলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্ততকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) বা বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্ততকারক ও রফতানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) -র সদস্য হতে হয়। এই শিল্পের দ্বিতীয় অংশীদার ট্রেড ইউনিয়নগুলো। তৃতীয় অংশীদার হচ্ছে বায়াররা। আর চতুর্থ অংশীদার সরকার।

বিজ্ঞাপন

যদিও বেসরকারি খাতে সরকারের ভূমিকা অল্প। কারখানাগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে। শ্রমিক আইন, কারখানার জন্য আইন, এগুলো প্রণয়ন করা সরকারের দায়িত্ব। এসব দায়িত্ব মালিক-শ্রমিক সবাইকেই রক্ষা করতে হয়। শ্রমিক-মালিকের অধিকার রক্ষায় চার অংশীদার একসাথে কাজ করতে হবে।

শ্রমিকের মৌলিক অধিকার হচ্ছে কাজ করার নিরাপদ পরিবেশ। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এখন বিশ্বের এক নম্বর। যদিও ১০ বছর আগে কারখানার পরিস্থিতি এতোটা ভালো ছিল না। তখন ইচ্ছা করলে যে কেউ জায়গা ভাড়া নিয়ে কারখানা করে ফেলত। কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। রানা প্লাজা ধসের পর পরিস্থিতি পাল্টেছে। উদ্যোক্তারা শত শত মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। কারখানার কাজের পরিবেশ ভালো না হলে বায়াররা কাজ দিত না।

শ্রমিকের আরেকটি অধিকার হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন করা। বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ রয়েছে। ইপিজেড-এর বাইরে যেকোনো স্থানে এই আইন প্রযোজ্য। এটাই বাংলাদেশের আইন। একজন উদ্যোক্তার কাছে ট্রেড ইউনিয়ন করা কোনো ইস্যু নয়। তাই ট্রেড ইউনিয়নকে মাথায় রেখে প্রত্যেক কারখানায় স্বতন্ত্র ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করে দিয়েছে বিজিএমইএ। এটি বায়ারদেরও চাহিদা ছিল। এই ওয়েলফেয়ার ওয়ার্কিং কমিটির মাধ্যমে কোনো সমস্যা থাকলে তা খুঁজে বের করা হয়। যাতে সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা সম্ভব না হলে সমস্যাগুলো বিজিএমইএ-র আরবিট্রেশন কমিটিতে চলে যায়।

বিজিএমইএ-র তিনটি সালিশ কমিটি আছে। সেখানে শ্রমিক ও কারখানা উভয়েরই প্রতিনিধি রয়েছে। আবার শ্রমিক চাইলে তার সমস্যা নিয়ে ইউনিয়নের প্রতিনিধির কাছেও যেতে পারে। ইউনিয়ন তখন কারখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বা বিজিএমইএ-র সঙ্গে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে পারে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প এখন এতটাই স্বচ্ছ।

বিজ্ঞাপন

দেশে তৈরি পোশাক শিল্পে মজুরি সংশোধন ১৫-২০ বছর পরে হয়েছে। কারণ শিল্পটি তার আগ পর্যন্ত বিকাশমান অবস্থায় ছিল। শিল্পটি পদে পদে শিখেছে, তার মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। বিকাশমান অবস্থাতেই তৈরি পোশাক শিল্প পণ্য তৈরি করেছে, রপ্তানি করেছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে, এভাবে বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে।

কিছুদিন ন্যুনতম মজুরি নিয়ে যে আন্দোলনটি হয়ে গেল, এমনটি ৪ থেকে ৫ বছর পরপরই হয়। মতের অমিল হলে আন্দোলন করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সহিংসতা করার অধিকার কারো নেই। বন্ধ কারখানার গেইট ভেঙে ঢুকে ভাংচুর চালানো কোনো অধিকার আদায়ের আন্দোলন হতে পারে না। একজন গর্ভবতী নার্সকে পেটানো হয়েছে। ফেব্রিক কাটিং ফ্লোরে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। আগুনে সৃষ্ট বিষাক্ত গ্যাসে এক শ্রমিক মারা গেছে। এই শ্রমিকের মৃত্যুর দায় কে নেবে? আন্দোলনকারীদের মধ্যে বহিরাগত ছিল কি না তাও তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে শ্রমিক অধিকারের পক্ষে কথা বলছে, তাদেরকেও এবিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া উচিত।

কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ইউরোপে আন্দোলন হলেও সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়, টিয়ার গ্যাস ছোড়া হয়। মানবাধিকার যেমন শ্রমিকের, মানবাধিকার তেমনি কারখানের পাশের দোকানিরও। আন্দোলন করতে করতে কারখানার চারপাশে বাড়িঘর দোকানপাট ভেঙে দিলে তা থামাতে হবে। এধরনের আন্দোলন কারা নেতৃত্ব দেয়, কারা তাদের মদদ দেয়, তা খুঁজে বের করা দরকার। এমন সহিংসতা থেকে জনগণকে রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব। যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে বাংলাদেশে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, তাহলে শ্রমিক নেতাদের পাশাপাশি বিজিএমইএ এবং সরকারের সঙ্গেও কথা বলা উচিত।

শ্রমিকদের অধিকার, কাজের সময়, সময়মতো মজুরি প্রদান, এসব বায়াররা নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ তাদেরকে ব্র্যান্ড ইমেজ ঠিক রাখতে হয়। এর জন্য তারা অডিট করে। বায়াররা তো ইউরোপের, যুক্তরাষ্ট্রের। যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ তো চাইলে সেই বায়ারদের ডেকে জেনে নিতে পারে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানার প্রকৃত চিত্র কী। জাতিসংঘ, আইএলও, সুশীল সমাজ, শ্রমিক ইউনিয়ন সবার কাছ থেকে সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। কিন্তু কারখানার কর্তৃপক্ষের সাক্ষ্য নেওয়া হয়না।

গত ৫-১০ বছরে সিংহভাগ শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে ন্যুনতম মজুরির দাবিতে। এর বাইরে আর কোনো ইস্যুতে আন্দোলন হয়নি। দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের অবস্থা যদি এতই খারাপ হতো, তাহলে অন্য ইস্যুতেও প্রায়ই আন্দোলন হতো। এখন কিন্তু বকেয়া বেতন-বোনাসের দাবিতে এখন আন্দোলন হয় না বললেই চলে।

তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য সর্বনিম্ন মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকা রাখার পাশাপাশি কর্মচারী শ্রেণিতে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৮০০ টাকা মজুরি করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্প নারী সমাজকে স্বাবলম্বী করেছে। আজ শ্রমিকরা ডিজিটালি পেমেন্ট পাচ্ছে। দেশ উন্নত হয়েছে বলেই এমনটি হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের পরিকল্পনা করেছেন বলেই আজ সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর