Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাইডেনের মেমোরেন্ডাম, অতঃপর নানামুখী আলোচনা

পলাশ আহসান
৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৩:২৭

বাইডেন সাহেবের সাম্প্রতিক মেমোরেন্ডাম নিয়ে লেখার জন্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের অবস্থা কী—জানতে গুগল সার্চ করেছিলাম। চোখ আটকে গেল একটি খবরে। খবরটি ২০২২ সালে ডেইলি স্টার অনলাইনে প্রকাশিত। “বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব কারখানার স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশের গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেড”। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল প্রতিষ্ঠানটিকে ‘লিড প্লাটিনাম’ সনদ দিয়েছে। ময়মনসিংহের ভালুকায় বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এপিক গ্রুপ এবং বাংলাদেশের এনভয় লিগ্যাসি গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে গ্রিন টেক্সটাইল লিমিটেড।

বিজ্ঞাপন

একদিকে মেমোরেন্ডাম অন্যদিকে এরকম একটি খবর। আমার কৌতূহল বাড়ল। গণমাধ্যমগুলো বলছে, শুধু একটি গার্মেন্টস নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিবেশবান্ধব কারখানা বাংলাদেশে। বর্তমানে বাংলাদেশে চালু ৪ হাজার কারখানার মধ্যে পরিবেশ বান্ধব কারখানার ২৫০ এর বেশি। আবেদন করে পরিবেশবান্ধব হওয়ার পাইপ লাইনে আছে অন্তত সাড়ে পাঁচশ কারখানা। কী আছে সেই পরিবেশবান্ধব কারখানায়। ইউটিউবে একাত্তর টেলিভিশনে প্রচারিত একটি রিপোর্ট দেখলাম। সেখানে দেখানো হচ্ছে- কারখানা পরিবেশবান্ধব করার জন্যে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং কাজের পরিবেশ নিরাপদ করা হচ্ছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য সম্মত খাবারের ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

২০২২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বহু গণমাধ্যমে আসছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি শ্রমিকবান্ধব কারখানাগুলো এখন বাংলাদেশে। এবছর ২৩শে ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত স্থপতিদের সংগঠন ইউএসজিবিসি বলছে, বিশ্বের পরিবেশবান্ধব শীর্ষ ১০০ কারখানার মধ্যে ৫২টির অবস্থান বাংলাদেশে। এছাড়া বিশ্বের পরিবেশবান্ধব সেরা ১০টি কারখানার ৮টিই বাংলাদেশি। শীর্ষ পরিবেশ বান্ধব কারখানা গ্রিন টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভির আহমেদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন ‘এ অর্জন বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে সহায়তা করবে। এর জন্যে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো গত ১৫ বছর ধরে কাজ করে এখন ফল পাচ্ছে।

গণমাধ্যম দেখলে বোঝাই যায়, আমাদের পোশাক খাতে আসলেই নীরব বিপ্লব চলছে। বর্তমানে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। ৪০ লাখ শ্রমিক এখানে কাজ করছে। বলা হচ্ছে শ্রম সস্তা বলেই বাংলাদেশের প্রতি বাইরের ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। বাংলাদেশ মুজুরি বোর্ড প্রথম ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করেছিল এক হাজার টাকারও কম। তখন দেশের অন্যান্য খাতে ন্যূনতম বেতন ছিল ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। অন্যদের চেয়ে প্রায় ৫ গুণ কম বেতন পেতেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। এখন সব শেষ মুজুরি বোর্ডের ঘোষণা অনুযায়ী গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন ১২ হাজার ৫০০টাকা। সেই হিসাবে অন্যান্য বেশিরভাগ খাতের ন্যূনতম বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজারে আটকে আছে।

অন্যান্য পেশাজীবীদের বিবেচনায় আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকরা ভালো আছেন বললে খুব যে ভুল হবে তা নয়। বলতেই হবে, বাড়তি বাজার দরে দেশের প্রতিটি মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এই দুর্ভোগ এখন প্রত্যেকের। তাই কোন সন্দেহ নেই, আজকের গার্মেন্টস খাতে যারা কাজ করছেন, তারা একটা যুদ্ধ করছেন। দেশের জন্যে একটা টেকসই অর্থনৈতিক খাত নির্মাণের চেষ্টা করছেন। যে চেষ্টায় তারা এগিয়ে গেছেন অনেকটা। এর মধ্যে করোনার স্থবির অর্থনীতি, ইউক্রেন যুদ্ধের মত দুর্যোগ পেছনে টেনে ধরলেও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারেনি।

সাম্প্রতিক বেতন নিয়ে অস্থিরতার পর যখন শ্রমিকরা কাজে ফিরছিলেন তখন তাদের অনেককেই গণমাধ্যমে বলতে দেখলাম। বেতনটা ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা হলে ভালো হতো। তবে এই মুহূর্তে যা দিয়েছে সরকার তাতে চালিয়ে নেওয়া যাবে। সারাদেশের মানুষ আসলে তাই করছেন। কোন রকম চালিয়ে নিচ্ছেন। বোঝা গেল আসলে শ্রমিকরাও জানেন, সব কারখানার অবস্থা একরকম নয়। এই যে ন্যূনতম বেতন নির্ধারণ হয়েছে সেটাও সব মালিক দিতে পারবেন না। পোশাক মালিকদের সংগঠনও স্বীকার করে, আমাদের চালু কারখানাগুলোর মধ্যে টেকসই কারখানার সংখ্যা হাজার দেড়েকের মত। চেষ্টা চলছে প্রত্যেককে সোজা করে দাঁড় করানোর। সরকারও তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে সব সময়।

এই যখন একটি সম্ভাবনাময় খাতের অবস্থা, তখন আসল বাইডেনের মেমোরেন্ডাম। অবশ্য সেখানে বলা হয়েছে, যদি শ্রমিক নিগ্রহের কোন ঘটনা ঘটে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সোচ্চার হবে। তাহলে কেন উদ্বেগ? সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিজিএমইএর নেতারাও বলছেন ‘প্লিজ পোশাক খাতে আঘাত করবেন না’। এরকম আবেদন যেখানে, সেখানে তো বুঝতে বাকি থাকে না যে উদ্বিগ্ন হওয়ার মত যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। কী সেই কারণ? আবারও গণমাধ্যমে পাতা উল্টে দেখা গেলো গত ২৩শে অক্টোবর যখন শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা চলছে তখন বাংলাদেশ সফর করছিল ইইউ এর একটি প্রতিনিধি দল। তাদের কাছে ওই অস্থিরতার ভুল ব্যাখ্যা তৈরি হতে পারে।

এরকম আরও অনেক কিছুই হতে পারে। বাংলাদেশের একই সঙ্গে চলছে নির্বাচন। নির্বাচনে একটি পক্ষ অংশ নিচ্ছে না। তারা দীর্ঘদিন দেশে সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে সুবিধা না করতে পেরে আন্তর্জাতিক লবিং শক্ত করছেন। ইইউ এর প্রতিনিধি দলটিকে ওই সময়ই আসতে হলো? একই সময় বাইডেন সাহেবকে মেমোরেন্ডাম দিতে হলো? এটা যে কোন লবিংএর অংশ নয় তা কে নিশ্চিত করবে? বিজিএমএ পরিচালক ফয়সল সামাদও সাংবাদিকদের জানান, উদ্বেগের কারণ, কোন কিছু তদন্ত না করেই আমাদের বড় ক্রেতারা একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

ফয়সল সামাদ আরও জানান, শিল্প এলাকায় সম্প্রতি যে সহিংসতা হয়েছে এর সঙ্গে বেশিরভাগ শ্রমিকের কোন সম্পর্ক নেই। আন্দোলন করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সহিংসতা করার অধিকার কারো নেই। বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতে মজুরি নিয়ে ছাড়া আন্দোলন হয় না। এখানে আন্দোলনের নামে যারা সহিংসতা করে তারা কেউ শ্রমিক নয়। এটা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও বার বার বলেছেন। ছবি দেখিয়ে প্রমাণ দিয়েছে।

এ নিয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেছেন, শ্রম আইনের সংশোধন ও বেজা আইনের মাধ্যমে শ্রম অধিকারের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে, শিগগির যুক্তরাষ্ট্রকে এ অগ্রগতির চিত্র জানানো হবে। তবে শ্রম অধিকারের ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। ‘কারও দয়ায় নয়, পণ্যের গুণগত মান, আন্তর্জাতিক চাহিদা ও শ্রমিক অধিকার রক্ষা করেই তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। ’ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দ্বিবার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের শ্রম আইনে শ্রম অধিকারের যেসব বিষয় আছে, তার মধ্যে বেশ কিছু পালন করা হয়েছে। তবে তারা চায় আরও অগ্রগতি হোক।

তপন কান্তি আরও জানান, শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে মেমোরেন্ডাম দিয়েছে, তা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে বাংলাদেশ। এযাবৎ বাংলাদেশে শ্রমিকদের কল্যাণে সরকার কী কী করেছে, কী কী করার উদ্যোগ নিয়েছে, সে বিষয়টির লিখিতভাবে অগ্রগতি জানানো হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমনীতি গ্লোবাল ইস্যু। তবে বাংলাদেশে যারা ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে কাজ করেন, তাদের বিরুদ্ধে যেন কোন পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখার পক্ষে সরকার। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন সুযোগ পায় না। তাই নতুন মার্কিন শ্রমনীতি নিয়ে কোন চাপ অনুভব করছে না।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের মেমোরেন্ডামে ভয় পাওয়ার মত কোন যৌক্তিক কারণ নেই। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি বাংলাদেশের দিকে মার্কিনিদের বাঁকা চোখে তাকানোর সব কারণ কী যৌক্তিক? এরইমধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, পোশাক খাতের যে অস্থিরতা গেল এতে বিএনপির ইন্ধন রয়েছে। বিএনপির কর্মীরাই গার্মেন্টস শ্রমিকদের উসকে দিচ্ছেন। রাজনৈতিক ময়দানে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি গার্মেন্টস খাত দিয়ে মার্কিন ষড়যন্ত্র উসকে দেয়ার চেষ্টা করছে। এরইমধ্যে ‘ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে আন্দোলন নিয়ে যারাই সহিংসতা করেছে এদের বেশিরভাগই বিএনপির অ্যাক্টিভিস্ট। দেখা গেছে কুষ্টিয়ার একজন নেতা কোনাবাড়ীতে এসে শ্রমিকদের খেপাচ্ছে।

তবে এনিয়ে সব শেষ আলোচিত মন্তব্যটি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৪ দলের সভায় তিনি বলেছেন বাইডেনের মেমোরেন্ডামের পরিপ্রেক্ষিতে পোশাক খাতে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে এই ষড়যন্ত্র টিকবে না। তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। কী করতে হবে, তিনি জানেন। প্রায় সবাই যখন সাধ্বসের মানুষকে নানা জুজুবুড়ির ভয় দেখাচ্ছে তখন সরকার প্রধানের এমনে ঘোষণা শুধু আশ্বস্তই করে না ইতিহাসমুখীও করে। বোঝা যায় শ্রমখাত নিয়ে তিনি টেকসই কাজ করেছেন বলেই এমন আত্মবিশ্বাসী মন্তব্য করতে পারেন।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর