বিএনপির আত্মঘাতী হরতাল অবরোধে বাংলাদেশ
১০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:৩৩
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে কেন্দ্র করেই বিগত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে আবর্তিত হয়ে চলেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। একদিকে রয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ অপর প্রান্তে রয়েছে স্বাধীনতা বিরোধীসহ বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে নিয়ে সেনা ছাউনিতে বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক দল বিএনপি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির ধারাবাহিক কর্মসূচি রাজনীতিতে এক ধরনের উত্তাপ সৃষ্টি করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মাঝামাঝি বিএনপি ঘোষিত সরকার পতনের দাবিতে এক দফা কর্মসূচি ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগের শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পর্যায়ক্রমিকভাবে উর্ধ্বমুখী হতে থাকে উত্তেজনার পারদ। তবে গত ২৮ অক্টোবর সৃষ্ট সংঘাতের ফলে পণ্ড হয়ে যায় বিএনপির মহাসমাবেশ। আপাতদৃষ্টিতে একইসাথে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গড়ে তোলা বিএনপির আন্দোলন যেন মুখ থুবড়ে পড়ে। দুই দলের নানামুখী কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সরগরম হয়ে ওঠা রাজনীতির মাঠে নেমে আসে নিস্তব্ধতা, একদিন আগেও শত শত নেতা-কর্মীর পদচারণায় মুখর বিএনপি কার্যালয় হয়ে যায় কর্মীশূন্য। কারা অন্তরীণ হয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ একটি বড় অংশ। গ্রেফতার এড়াতে বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মী ও সমর্থক চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। মিছিল মিটিং স্লোগানে ব্যস্ত সময় পার করা নেতা-কর্মীরা রাজপথ ছেড়ে হয়েছেন ফেরারি, বিএনপির দখলে থাকা রাজনীতির মাঠের অংশটুকু এখন যেন ভেঙে যাওয়া হাট।
গ্রেফতার এড়াতে বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মী আত্মগোপনে চলে গেলেও ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির এক দফা আন্দোলনের অংশ হিসেবে ফিরে এসেছে হরতাল অবরোধ। ২৯ অক্টোবর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২১দিন হরতাল অবরোধ পালন করেছে দলটি ও তাদের আন্দোলন সঙ্গী অন্যান্য রাজনৈতিক দল। করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই, বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক সংকটে জনজীবন যখন প্রায় বিপর্যস্ত, এ পরিস্থিতির মধ্যে হরতাল অবরোধ মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে মানুষের সামনে আবির্ভূত হয়েছে। হরতাল অবরোধের মধ্যে প্রতিদিনই বিভিন্ন পরিবহন ও স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের খবর গণমাধ্যমে আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক প্রায় প্রতিদিনই আটক ও গ্রেফতার হচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
২৯ নভেম্বর বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের সংগঠন আইনজীবী ফোরাম গত সুপ্রিম কোর্টের দক্ষিণ হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশের পর থেকে এক মাসে ৮৩৭টি হয়রানিমূলক মামলায় ২০ হাজার ৩২৬ জন বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৩০ অক্টোবর অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টে ডিএমপি মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ এর বরাতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বিএনপির মহাসমাবেশের দিন সহিংসতার ঘটনায় দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৩৬টি মামলা রুজু হয়েছে। এসব মামলার এজাহারনামীয় আসামি ১ হাজার ৫৪৪ জন। আরও অনেককে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এসব মামলায় সারাদেশে মোট ১ হাজার ২৯২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এ তো হচ্ছে বিএনপি আর বিরোধী দলের পরিস্থিতি। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতেও চাপা অস্থিরতা ও সংকট ঘনীভূত হবার আশংকা জনমনে। গত ৩০ নভেম্বর অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ২৪ডটকম ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রতিবেদনে ২৯ অক্টোবর থেকে বিএনপির ডাকা ১৯ দিনের হরতাল অবরোধে ২৩৬টি বিভিন্ন ধরণের যানবাহন ও স্থাপনায় অগ্নিসংযোগের খবর ফায়ার সার্ভিস পেয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তবে পয়লা ডিসেম্বর অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানিয়েছে, ২৮ অক্টোবর থেকে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত সারাদেশে ৫১৯টি যানবাহন ও স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ এবং ভাংচুর করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৯৯টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ, ১৯১টি যানবাহন ভাংচুর করা হয়েছে। এছাড়া ১১টি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ এবং ১৮টি স্থাপনায় ভাংচুর চালানো হয়েছে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম ৩ দিনে আরও ১১টি যানবাহনে অগ্নিসংযোগের খবর প্রকাশ করেছে একাত্তর টেলিভিশনের অনলাইন ডেস্ক।
বিএনপির ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের মধ্যে দিয়ে শুরু হওয়া সহিংসতা, ধারাবাহিক হরতাল অবরোধের মধ্যেও চলমান রয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। এসময় প্রধান বিচারপতির বাসভবন থেকে শুরু করে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতাল, যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী কাভার্ড ভ্যান, ট্রেন, বিদ্যালয়, পুলিশ বক্স, আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। হরতাল অবরোধ চলাকালে যানবাহনে দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে রাজধানী ঢাকা ও খাগড়াছড়িতে দুজন পরিবহন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে শেখ হাসিনা বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন আরও অন্তত ১২ জন। হরতালের প্রথম দিন, অর্থাৎ ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক স্থানীয় নেতাকে হরতাল সমর্থকেরা কুপিয়ে হত্যা করে বলে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়। এর আগে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের দিন আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে আগত নেতা-কর্মীদের বহনকারী যানবাহনে হামলার মধ্যে দিয়ে সহিংসতার সূত্রপাত ঘটে। এদিন বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের এক কনস্টেবলকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সেদিন তাদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি পেশাগত দায়িত্ব পালনকারী গণমাধ্যমের কর্মীরাও। গত ২ ডিসেম্বর এডিটরস গিল্ডস আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত জানান, সেদিনের হামলায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের ৩২ জন কর্মী আহত হন। তাদের মধ্যে ২৮ জনকে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। এসময় কয়েকটি টেলিভিশনের ভিডিও ক্যামেরা ও ১০টি মোটরসাইকেল ভাংচুর করা হয়, ছিনিয়ে নেয়া হয় মোবাইল ফোন।
হরতাল অবরোধ কর্মসূচীর মধ্যে যানবাহনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরের ফলে একদিকে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে চলে এসেছে স্থবিরতা। প্রতিদিন হাজার হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ। দিন এনে দিন খাওয়া দরিদ্র মানুষদের অনেকেই হয়ে পড়েছেন কর্মহীন। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে চরম আতঙ্ক নিয়ে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। গত ২৯ নভেম্বর দৈনিক যুগান্তর এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, এসব কর্মসূচির কারণে প্রতিদিন গড়ে অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ২১ দিনের হরতাল অবরোধে সার্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন ও প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট। ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের দিন এবং এর আগে ও পরে নজিরবিহীন নাশকতা চলেছিল সারাদেশে। নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালে ২৬ দিনের হরতাল অবরোধে নিহত হয়েছিল ১২৩ জন। নির্বাচনের দিন নিহত হয়েছিল আরও ১৮ জন। অগ্নিসংযোগ করার ফলে ১৪০ ভোটকেন্দ্রে ভোটগ্রহন স্থগিত করা হয়েছিল। নির্বাচনের পরেও সারা বছরব্যাপী চলে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল অবরোধ। যাত্রীবোঝাই বাস লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মারা ছালা নৈমিত্তিক ঘটনা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রবেশ করলেই বাতাসে ভেসে আসতো মানুষের শরীরের পোড়া গন্ধ। সেসময় যানবাহনে ওঠাই ছিল যেন জীবন মৃত্যুর চ্যালেঞ্জ। দেশব্যাপী চলেছিল বোমাবাজদের উদ্দাম নৃত্য। বিভীষিকাময় সেই সময়ের অবস্থা স্মরণ হলে এখনও শিউরে উঠতে হয়।
সংঘটিত হরতাল অবরোধের মত জনবিরোধী কর্মসূচি বিএনপিকে সাধারণ জনগণ থেকে আরও দূরে নিয়ে যাচ্ছে বলেই নাগরিকদের ধারণা। পাশাপাশি আমরা এও বিশ্বাস করি বিএনপির অধিকাংশ নেতা-কর্মী শান্তিপ্রিয় কর্মসূচির পক্ষে। তা না হলে ২৮ অক্টোবর পূর্ববর্তী বিএনপির কর্মসূচিতে শত শত নেতা-কর্মী ও সমর্থক উপস্থিত হতো না। বিএনপির মূল ধারাটি শান্তিপ্রিয় গণতন্ত্রকামী, সহিংসতাকারীরা মুষ্টিমেয় হাতেগোনা। হরতাল অবরোধ কর্মসূচীতে দলটির গুটিকতক নেতা-কর্মী অংশ নিচ্ছে, অধিকাংশই এ ধরণের হঠকারী গণবিরোধী কর্মসূচির সাথে একাত্ম হতে পারছেন না। তারা চুপ হয়ে গেছেন।
একইসাথে বিএনপি নেতৃত্বেরও স্মরণ রাখা প্রয়োজন রাজনীতির মূল লক্ষ্যই হলো সাধারণ জনগণের জন্য কাজ করা, জনগণের কষ্ট লাঘব করা, জনগণের জীবন মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা কোন প্রকার ভোগান্তি সৃষ্টি করা নয়। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করছি, হরতাল অবরোধের মধ্যে আহত নিহতদের পরিবারের পাশে বিএনপির একজন নেতাও এখন পর্যন্ত দাঁড়ালেন না। কেউ একটিবারের জন্য বার্ন ইউনিটে গিয়ে আগুনে পোড়া মানুষটাকে গিয়ে বললেন না- ‘ভাই আমাদের কর্মসূচির মধ্যেই আপনার এই ক্ষতি হয়েছে তার জন্য আমরা দুঃখিত, লজ্জিত! আমরা আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী!‘ এতে বিএনপির কোন ক্ষতি হতো না, বরং পুড়ে যাওয়া মানুষটি একটা সান্ত্বনা পেতেন। বিএনপির কোন নেতা ক্ষতিগ্রস্ত এই মানুষদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহমর্মিতা অনুভব করছেন না- যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।
কর্মসূচি যেহেতু তারা আহ্বান করেছেন সেহেতু এর ফলে জনগণের যেকোনো প্রকার ক্ষয়-ক্ষতির দায় তাদেরই নেওয়া উচিত, এবং ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের পাশে গিয়ে তাদের দাঁড়ানো দরকার। অদূরদর্শী এবং অপরিণামদর্শী বিএনপির এই নেতৃত্বের কর্মকাণ্ডের ফলে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়ছে। জনগণের সাথে বৈরিতা সৃষ্টি করে রাজনীতি হয় না, হতে পারে না। জনতার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়েই বিএনপি তথা যেকোনো রাজনৈতিক দলের জনভিত্তি গড়ে উঠতে বাধ্য। সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিয়ে, তাদের সম্পদ নষ্ট করে কিংবা জনতার গায়ে আগুন দিয়ে কোনভাবেই রাজনীতিতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আজ হোক কিংবা কাল বিএনপি নেতৃত্বকে এ ধরণের বিতর্কিত কর্মসূচি পরিত্যাগ করতেই হবে।
মানবাধিকার কর্মী