সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং অদম্য উন্নয়নে বাধা
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:১৩
‘ইসলাম’ শব্দের প্রতি বাঙালি মুসলমানদের অন্যরকম আবেগ জড়িত। ‘গণতন্ত্রের মাধ্যমে কোনো সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ইসলাম অনুযায়ী ‘হারাম’ এবং ‘গণতন্ত্র বিষাক্ত দুধের মাখনের মত’ এমন মন্তব্য করেছিলেন জামায়াত ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদী। জামায়াতের এই প্রতিষ্ঠাতা ইসলাম সম্পর্কেও অনেক ন্যক্কারজনক কথা বলেছেন এবং পবিত্র কোরআন শরিফের অনেক অপব্যাখ্যা করেছেন। তার ব্যক্তিগত দর্শনকে বানিয়েছেন দলের রাজনৈতিক দর্শন। তারই পুত্র সৈয়দ হায়দার ফারুক মওদুদী পাকিস্তানের রয়েল টেলিভিশনে ২০১১ সালের ২৮ মে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, জামায়াত ধর্মব্যবসায়ী এবং অত্যাচারী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের সংবিধানর ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। কিন্তু মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে। ১৯৭৬ সালের ৩রা মে রাষ্ট্রপতি এএসএম সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তখন সায়েম রাষ্ট্রপতি পদে থাকলেও ক্ষমতার মূল চাবি ছিল জিয়াউর রহমানের হাতে।
১৯৭৬ সালের ২৪শে আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং আরও কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দল মিলে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠন করে এবং ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে মায়ের অসুস্থতার কথা বলে গোলাম আযম ঢাকায় আসলেও আর ফিরে যাননি।
নাগরিকত্ব না থাকার পরেও জামায়াতে ইসলামী চলতো গোলাম আযমের নির্দেশনায়। ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের ব্যানারে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন নেতা ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৬টি আসনে জয়লাভ করে। এরপর জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে যে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসনে জয়লাভ করে। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জামায়াত ও বিএনপি জোটবদ্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী আন্দোলন করে। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীমাহীন ভোট কারচুপির মাধ্যমে জয় পায় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। বিএনপি-জামায়াত জোট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য টাকার বিনিময়ে ভোট ক্রয়, ভোটকেন্দ্র দখল, হুমকি-ধমকি দিয়ে প্রকৃত ভোটারকে ভোটদানে বিরত রাখার মতো ন্যক্কারজনক সব কর্মকাণ্ড করে। ২০০১ সালে নির্বাচনের আগে নরসিংদীতে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রচারের সময় কোরআন নিয়ে শপথ করানো হয়েছিল গ্রামের নারীদের। প্রকাশ্য বক্তব্য তথাকথিত মুফতিরা ফতোয়া দিয়ে বলেছে যে, নৌকায় ভোট দিলে ইসলাম চলে যাবে। ধানের শীষ-দাঁড়িপাল্লায় ভোট দিলে জান্নাতের টিকেট কনফার্ম হবে। আওয়ামী লীগে ভোট দিলে দেশের মসজিদ থেকে আর আযানের ধ্বনি শোনা যাবে না বলেও ভয়ানক অপপ্রচার চালায় মৌলবাদীরা।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সিলেট কোনদিকে থাকবে সেজন্য আয়োজিত হলো গণভোট, সেখানে বক্তব্য দিতে যান তরুণ নেতা শেখ মুজিব। সেসময় উগ্রবাদীরা মাইকে কথা বলা হারাম বলে ফতোয়া দেয়। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময়ও হারিকেন প্রতীকের বিপক্ষে ভোট দিলে ইসলাম চলে যাবে বলেও ফতোয়া দেয় তারা। এমনকি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের কাফের বলে ঘোষণা দিয়েছিল তারা। উগ্রবাদীদের এই ফতোয়া এখনো চলমান।
২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট বাড়লেও সংসদে আসন সংখ্যা কমে যায়। ২০০১ সালে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভের পর বিএনপি-জামায়াত জোটের “সন্ত্রাস-রাজনীতি” প্রকাশ পায় এবং তা পরবর্তী ৫ বছর ধরে চলতে থাকে। এই সময়কালে বিএনপি-জামায়াত জোট, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া ও সাবেক সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের ২৬ হাজার নেতা ও কর্মীদের হত্যা করে। এই সময়েই আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৮ বারের বেশি চেষ্টা করা হয়। এজন্য বিএনপি-জামায়াত হুজি ও জেএমবির মতো চরমপন্থি গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে এবং হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংসতার জন্য তাদের রাজনৈতিক নিরাপত্তাও দেয়।
২০০৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের ভবিষ্যৎ নেতা ও মানি লন্ডারিং মামলায় দোষী তারেক রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করা হয়। এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল দলের সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সকল নেতাকে হত্যা করা। এরপর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা-কর্মী এবং এর সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা নিহত হন এবং আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী। নিহতদের মধ্যে ছিলেন মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দ। ২০০১ সালের নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি এবং জামায়াত জোট হিন্দুদের ওপর যে আক্রমণ করে তার বিভিন্ন খবরে ও প্রতিবেদনে অনেকবার উঠে এসেছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন মতে, ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগকে ভোট না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি। নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত জোট একের পর এক হামলা করতে শুরু করে। কারণ তারা দেখেছে, হিন্দু ভোটারেরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দিয়েছে যথারীতি। নির্বাচনের পরের অবস্থা ছিল আরও পরিকল্পিত, ছকবদ্ধ এবং গুরুতর। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনের পর বরিশালের আগৈলঝরা, ময়মনসিংহ, বাগেরহাট, বরিশাল, ভোলা, গোপালগঞ্জসহ দেশের অনেক স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ প্রতিপক্ষের ওপর ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়।
এই নির্যাতন-জুলুমের মহোৎসব চলে ১ অক্টোবর থেকে ১০ অক্টোবর পর্যন্ত। আর এসব অত্যাচার-নির্যাতনের নির্দেশ আসে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক জিয়ার অফিস হাওয়া ভবন থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নির্যাতন চলতে থাকে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সাধারণ জনগণ ও সংখ্যালঘুদের ওপর। বিএনপি-জামায়াতের সেই নির্যাতনের কতটা তীব্র ছিল তা ভাবলে যে কোনো সংবেদনশীল মানুষই শিউরে উঠবেন। বাবা-ভাই আওয়ামী লীগের কর্মী হওয়ায় রাজশাহীর মহিমাকে নিপীড়ন করেছিল বিএনপির সন্ত্রাসীরা। এই লজ্জা-অপমান সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে সে। উল্লাপাড়ার পূর্ণিমার ওপর নিপীড়ন সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ঢাকার ফাহিমা, পঙ্গু শেফালি রানী, শিশু তৃষাসহ কেউ রেহাই পায়নি বিএনপি সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব থেকে।
প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, সেসময় বিএনপি জোটের হামলায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা ছিল বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, যশোর, কুমিল্লা ও নরসিংদী। ওই সময় আক্রমণকারীরা হিন্দুদের বাড়িতে ঢুকে তাদের পরিবারের সদস্যদের মারধর, তাদের সম্পত্তি লুটপাট, দেশত্যাগে বাধ্য করা এবং অনেক হিন্দু নারীদের ধর্ষণও করে। সেসময় সহিংসতা এবং ভয় দেখানোর প্রধান উপায় হিসেবে ‘ধর্ষণ’ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের মতে, সেসময় কমপক্ষে ১৮৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। বিভিন্ন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন অনুসারে, এসব ঘটনায় বিএনপি-জামায়াত জোটের কর্মীরাই দায়ী। সেসময় কয়েকজন হিন্দু নারীকে অপহরণও করে তারা।
সেদিনে অপহৃতরা পরবর্তীতে তাদের পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন কি না তা এখনও অজানা। নিরাপত্তার শঙ্কায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলো মুখ খুলতে সাহস করেনি। আর এসব হামলা এবং জীবনের ওপর হুমকির কারণে ওই সময় হাজার হাজার হিন্দু পরিবার সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পালিয়ে যান। এমনকি দূরবর্তী আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়েও আশ্রয় নেন কেউ কেউ। সাংবাদিকদের কাছে সাক্ষাৎকারে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ভোটে হেরে যাওয়া আওয়ামী লীগের সমর্থক ধরে নিয়ে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন হিন্দুরা। সেসময় হিন্দুদের অনেক মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়।
কানাডার ইমিগ্রেশন এবং শরণার্থী বোর্ডের গবেষণা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতার ঘটনাগুলো বিবিসি (১০ই অক্টোবর ২০০১), গাল্ফ নিউজ (১২ই ফেব্রুয়ারি ২০০২), প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়া (২০শে অক্টোবর ২০০১), এবং প্যাক্স ক্রিস্টি (২৬শে নভেম্বর, ২০০১) ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঘটনাগুলোতে ধর্ষণ, নির্যাতন, হত্যা ও লুটপাটের পাশাপাশি হিন্দুদের ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। সহিংসতার শিকার হয়ে হাজার হাজার হিন্দু পরিবার সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। দ্য ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়য়েন্স জানায়, বেশিরভাগ সহিংসতা বিএনপির কর্মীদের দ্বারা সংঘটিত হয় হিন্দুদের ওপর আক্রমণগুলো সারাদেশে বিভিন্ন জেলায় ঘটেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর বিএনপি-জামায়াতের হামলার খবর যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টর আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদন ২০০৫-এ প্রকাশ পায়। সেখানে বলা হয়, বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা হিন্দুদের ওপর সহিংস আচরণ করা হয়েছে, কারণ ঐতিহ্যগতভাবেই তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, লুট এবং নির্যাতনের কথা উল্লেখ ছিল।
২০০১ সালের নির্বাচনের পর থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা অব্যাহত রয়েছে। আর এ কারণেই বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মন্দির এবং গির্জায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি প্রয়োজন পড়ে। প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, প্রার্থনার স্থানে হামলা, ঘরবাড়ি নষ্ট, জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং উপাসনার সামগ্রী নষ্ট করার বিষয়গুলো। ঘটনাস্থল এবং সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের বক্তব্য প্রতিবেদনে রয়েছে। বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগের তদন্ত অনুযায়ী, দেখা গেছে বিএনপি এবং জামায়াতের ২৬ হাজার ৩৫২ জন নেতা এবং সমর্থকের ওই দাঙ্গায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের ২৬ জন মন্ত্রী এবং আইনপ্রণেতা রয়েছেন।
অভিযুক্ত ৬ মন্ত্রী হলেন: রহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আবদুস সালাম পিন্টু, মতিউর রহমান নিজামী, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, তারিকুল ইসলাম ও হাফিজউদ্দিন। তাদের মধ্যে, আলতাফ হোসেন চৌধুরী তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ২০০১ সালে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার পরে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে সংবিধানে একটি বড় সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। প্রস্তাব আনে, সদ্য অবসরপাপ্ত প্রধান বিচারপতি কেএম হসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার। অভিযোগ রয়েছে, নিজেদের পছন্দের প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে পাওয়ার জন্য এই কাজ করেছিল বিএনপি সরকার।
এর উদ্দেশ্য ছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিজেদের কব্জায় রেখে নির্বাচনের সময় সুবিধা আদায় করা। এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। সংঘাতময় এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি (এক এগার) রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। ড. ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে একটি নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হলেও কার্যত সেটি পরিচালনা করেছে সেনাবাহিনী। একই সাথে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় তথাকথিত দুর্নীতি-বিরোধী অভিযান শুরু করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মূল লক্ষ্য ছিল রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ীরা। অভিযোগ উঠেছিল আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতির বাইরে রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু সেটি সফল হয়নি।
ওই সময় দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় দেশের মানুষের বড় একটি অংশ চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এমন প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালের জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকজন শিক্ষার্থীকে সেনাসদস্যদের প্রহার করার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গণ্ডি পেরিয়ে সহিংস এই আন্দোলন ছড়িয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। সেই আন্দোলনের পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুধাবন করে যে অনির্দিষ্টকালের জন্য নির্বাচন আটকে রাখা যাবে না। তখন একজন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তার লেখা ‘নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর’ বইতে মি. হোসেন উল্লেখ করেন, এ ঘটনা নিয়ে শুধু সেনাবাহিনীই নয়, অত্যন্ত নাজুক পরিস্থিতিতে পড়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরের নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি বাক বদল হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ একটানা ১৫ বছর ক্ষমতায় রয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির সাথে তাদের চরমপন্থি মিত্র জামায়াতে ইসলামী এবং এর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাথে একটি ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করেছে। যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, প্রতিবাদের নামে রাজপথে সাধারণ নাগরিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সহিংস ও প্রাণঘাতী হামলা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর উদ্দেশ্য প্রণোদিত হামলা ও তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা ইত্যাদি।
আর এসব কাজে তারা প্রায়ই জামিয়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ- জেএমবি এবং হরকাতুল জিহাদের মতো সহিংস চরমপন্থি সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে। ২০১৩ সাল থেকে বিভিন্ন গণপরিবহনে, যথা বাস, ট্রাক, অটোরিকশা, ইজিবাইকের যাত্রীদের লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা এবং মলোটভ ককটেল আক্রমণ তাদের সহিংসতায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে জামায়াত-শিবির সমর্থকরা ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দেশের অভ্যন্তরে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ কারণেই ২০১৩ সালে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক সহিংসতার ৪১৯টি প্রধান ঘটনায় ৪৯২ জন নিহত হন এবং ২ হাজার ২০০ জন আহত হন। ৫ই ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজাকার কাদের মোল্লার আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশের ঘোষণায় ২ দিনের হরতাল ডাকে জামায়াত।
সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের হরতাল বিক্ষোভে কমপক্ষে ৩ জন নিহত হন। এরপর ২৪শে ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলায় হরতালে পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবির কর্মীদের সংঘর্ষে ৪ জন নিহত এবং কমপক্ষে ৫০ জন আহত হন। ১২ই ডিসেম্বর মৃত্যুপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা ও যুদ্ধাপরাধের আসামি রাজাকার আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর জামায়াত-শিবিরের সহিংসতায় সারাদেশে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৭ জন নিহত ও ১৫০ জন আহত হন।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেইল্যা রাজাকারকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার পর ২৮শে ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের নামে জামায়াত-শিবিরের সহিংসতায় ১২ জন পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ৪০ জন নিহত হন এবং ২ হাজারেরও বেশি আহত হন। গাইবান্ধা জেলায় ৪ পুলিশ সদস্যসহ ৬ জন নিহত হন, সাতক্ষীরায় ১ জন বেসামরিক নাগরিক, ঠাকুরগাঁওয়ে ৪ জন, চট্টগ্রামে ৪, কক্সবাজার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ও নোয়াখালী জেলার ২ জন করে এবং ঢাকা, মৌলভীবাজার, নাটোর ও বগুড়া জেলায় একজন করে বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। আর ১লা মার্চ সারা দেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে জামায়াতের সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষে কমপক্ষে ৭ জন নিহত হন আর এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৭ জনে দাঁড়ায়। ওই সময়ও বাংলাদেশের হিন্দুরা বিশেষ লক্ষ্যবস্তু ছিল, যা তাদের শারীরিক সহিংসতা লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগের সম্মুখীন হয়।
গাইবান্ধার বঙ্গশারহাট শহরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে এক রিকশাচালক ও চায়ের দোকানের এক মালিক নিহত হন। সিলেট নগরীতে শিবির কর্মীরা ছাত্রলীগ নেতা জগতজ্যোতি তালুকদারকে হত্যা করে। ৩রা মার্চ ২৪ ঘণ্টার হরতাল ডাকে জামায়াত-শিবির। হরতালের প্রথম দিনে পুলিশের সাথে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে ২৩ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন আর আহত হন ১ হাজারের বেশি মানুষ। বগুড়ায় জামায়াত-শিবিরের সাথে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে ৩ নারীসহ ১০ জন নিহত হন। আর রাজশাহীতে সংঘর্ষের শিকার হন নিরীহ গ্রামবাসী। সেসময়ই নিহত হন ৪ জন। ঝিনাইদহে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জামায়াত-শিবির কর্মীরা হামলা চালালে ওমর ফারুক নামে এক পুলিশ কনস্টেবল নিহত হন।
৪ঠা মার্চে হরতালের শেষদিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে সারাদেশে ৫ জন নিহত হন আহত হন আরও ১৭ জন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে বিএনপি নেতা কুখ্যাত রাজাকার সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়ার পর থেকে কয়েকদিনের মধ্যে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে সারাদেশে যানবাহন ভাঙচুরসহ বিভিন্ন সহিংসতায় বহু মানুষ নিহত ও আহত হন। এছাড়া, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ফজলে কবির, প্রধান নির্বাচন কমিশনার রকীবউদ্দিন আহমেদ, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এবং প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার গ্রামের বাড়িতে পেট্রোল বোমা এবং ককটেল ছোড়ে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। আর রাজাকার সাঈদীর মামলার প্রধান সাক্ষীকেও সেসময় হত্যা করে জামায়াত-শিবির।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের বিরোধিতা করে বিএনপি-জামায়াত জোটের সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু হয়। তারা সেসময় হাজার হাজার যানবাহন ভাঙচুর করে সেগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই ঘটনায় তাদের পেট্রোল বোমা, হাতে বানানো বোমা এবং অন্যান্য সহিংসতায় ২০ জন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ ২০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হন। সহিংসতার সময় রাস্তার পাশে থাকা হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। এছাড়া, ছোট দোকান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও আগুন দেয় তারা। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জা ভাঙচুর এবং কোরানের শত শত কপি জ্বালিয়ে দেয়।
নির্বাচনের দিন একজন প্রিসাইডিং অফিসারসহ মোট ২৬ জনকে হত্যা করে। সারাদেশে ৫৮২টি স্কুলে ভোটকেন্দ্রে আগুন লাগায় বিএনপি-জামায়াতপন্থীরা। এসব বাধা বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও ওইদিন জনগণ গণতন্ত্রকে বজায় রেখে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। ২০১৫ সালের ৪ঠা জানুয়ারি নির্বাচনের ১ বছর পূর্তির দিন আবারও জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে সন্ত্রাসের রাজত্ব শুরু করতে চায় বিএনপি-জামায়াত জোট। ওই সময় ২৩১ জনকে হত্যা করে তারা। যাদের বেশিরভাগই পেট্রোল বোমা এবং আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায়। ওই ঘটনায় আহত হন আরও ১ হাজার ১শ’ ৮০ জন। সেসময় ২ হাজার ৯০৩টি গাড়ি, ১৮টি রেলগাড়ি এবং ৮টি যাত্রীবাহী নৌযানে আগুন লাগিয়ে হামলা চালায় তারা।
ওই সময় হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয় সরকারি অফিসগুলো। আর বিএনপি-জামায়াতের ভাঙচুর এবং আগুনে পুড়ে ৬টি ভূমি অফিসসহ ৭০টি সরকারি কার্যালয়ের যাবতীয় দলিলপত্র নষ্ট হয়ে যায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও দশম জাতীয় নির্বাচন করতে ২০১৩ সালে মাত্র ৬ মাসেই ৫০ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ ৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থায়ন হয়। আর এ সময়ই সহিংসতা শুরুকরে বিএনপি-জামায়াত সমর্থকরা।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির মতে, হরতাল-অবরোধের প্রতিদিন দেশের ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা (অথবা ১৯২.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) বা জিডিপি’র ০.২ শতাংশ ক্ষতি হয়। এর অর্থ ২০১৩, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধে দেশের ১.৫৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ ক্ষয় হয়। তবে বিএনপি-জামায়াতের সহিংসতায় যে সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তা এরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত নয়। তার পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে পুলিশের জমা দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ই জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত হিন্দুদের ওপর দেশের ২১টি জেলায় হামলা চালায়। আর ওই সময় মোট ১৬০টি হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা পাওয়া গেছে। ওই সময় ৭০টি হামলায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। আর বেশিরভাগ হামলার জন্যই বিএনপি-জামায়াত দায়ী বলেই মনে করা হয়। অত্যাচারের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়কে আহত করা, তাদের ঘরবাড়ি, মন্দির ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দেওয়া এবং লুটপাটও চালায় বিএনপি-জামায়াত।
২০১৪ সালের ১৫ই জানুয়ারিতে হাইকোর্ট বিভাগ একটি সুয়োমোটো রুল জারি করে, যার মধ্যে বিভিন্ন পুলিশ রেঞ্জের কর্মকর্তারা অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মাধ্যমে প্রতিবেদন জমা দেন। সেখানে দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, বাগেরহাট, যশোর, নড়াইল, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, জয়পুরহাট, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, রংপুর, গাইবান্ধা নীলফামারী ও ঠাকুরগাঁও জেলায় হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা উঠে আসে।
বিএনপি-জামায়াতের সহিংস কর্মকাণ্ড যে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বিদেশি আদালত তথা কানাডার ফেডারেল আদালতেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জুয়েল হোসেন গাজী ও মোস্তফা কামাল নামের বিএনপির দুই নেতার দুটি পৃথক মামলার রায়ে দুই দফায় কানাডার আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে রায় দেয়। অটোয়ায় কানাডার ফেডারেল আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, বিএনপি প্রকৃতপক্ষে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। আদালত মনে করে, বিএনপি হচ্ছে একটি দল যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে সশস্ত্র সংঘাত ও সহিংসতার আশ্রয় নেয়। রায়ে আরও বলা হয়েছে, হাতবোমা, পিস্তল ও অস্ত্র ব্যবহার করে নেতৃস্থানীয় এবং জনগণের ওপর হামলা চালায় বিএনপি। এমনকি অগ্নিসংযোগের মতোও ঘটনা ঘটায় দলটি। যা সাধারণ মানুষের জান-মালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে।
আদালত আরও বলেন, বিএনপি কর্তৃক হরতালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খুব খারাপ প্রভাব ফেলেছে যে কারণে সেবাভিত্তিক বাধা সৃষ্টি, সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি এবং জনগণের মৃত্যু এবং গুরুতর শারীরিক ক্ষতি হয়েছে এবং সরকারকে অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ফেলার লক্ষ্যেই হরতাল কার্যকর করতে সহিংসতার ঘটনা ঘটায় বিএনপি যা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। রায়ে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে এটি বলতে হচ্ছে, বিএনপি সমসময়ই একটি সন্ত্রাসী দল। এ বিষয়ে বিবিসি, এএফপি, কমনওয়েলথ স্টাডিজ ইনস্টিটিউট, ফরেন পরিসি ম্যাগাজিন, ইকোনমিস্ট সাউথ এশিয়ান টেরোরিজম পোর্টাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচে প্রকাশিত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিএনপির হরতাল, অগ্নিসংযোগে মানুষের মৃত্যু ঘটানো, গ্রামাঞ্চলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, ভোটকেন্দ্রে হামলা, পথশিশুদের দিয়ে বিস্ফোরক তৈরি ও পেট্রোল বোমা ছোঁড়ায় দলটি।
বিচারপতি মি. ব্রাউন বলেন, বিএনপির হরতালগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলেছে এবং এতে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও বহু মানুষের মৃত্যু এবং এর মতো গুরুতর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন অনেকে। এসব কর্মকাণ্ড শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের ঊর্ধ্বে। বিএনপির কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে সহিংস এবং তারা একটি সন্ত্রাসী দল। কয়েক মাস পর কানাডার আরেকটি ফেডারেল আদালত বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলে অভিহিত করে। আর বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী হরতাল কার্যকর এবং সহিংসতা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দলের ভূমিকার জন্য ১২ই মে বিএনপি নেতার কানাডায় আশ্রয় প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে তার বিচারিক পর্যালোচনা করার কথা বলেন ফেডারেল কোর্টের বিচারক মি. ফোথারগিল।
আদালত পূর্ববর্তী অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে বিচারপতি বলেন, যে পিটিশনকারী যে রাজনৈতিক দলের সদস্য তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল, জড়িত আছে বা ভবিষ্যতেও জড়িত থাকবে। বিএনপির হরতাল এবং কুফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অভিবাসন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে কোনো ভুল ছিলোনা এবং ওই কমিটির সিদ্ধান্তও যথার্থ। বিচারক আরও বলেন, বিএনপির ধারাবাহিক হরতাল এবং ওই সময় সহিংসতার ফলে কানাডার অভিবাসন বিষয়ক কর্মকর্তাকে এই উপসংহারে পৌঁছতে সাহায্য করেছে। বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন। বিচারপতি মি. ফোথারগিল শুধু জুডিশিয়াল রিভিউ আবেদন খারিজই করেননি বরং রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিলের জন্য এসএ পিটিশনের আবেদনও খারিজ করে দেন।
ইসরাইলের বর্বর হামলায় ফিলিস্তিনে ১৮ হাজারের বেশি নারী-পুরুষ-শিশুর মৃত্যুতে নীরব বিএনপি-জামাত জোট। গাজার হাসপাতালে বোমা মেরে শত শত শিশুকে হত্যার পরও ইসরাইলের বিরুদ্ধে টু শব্দটি উচ্চারণ করেনি এই মৌলবাদীরা। দেশের ভেতরে জঙ্গিবাদ বিস্তারে এরা সক্রিয় থাকলেও, আমেরিকার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় ফিলিস্তিনের মুসলিমদের জন্য এরা কোনো প্রতিবাদ করে না। ফিলিস্তিনে ইতিহাসের ভয়াবহ এই বর্বরতায় ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশের সংসদেও প্রতিবাদী কণ্ঠ তুলেছেন সচেতন নাগরিকরা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জাতিসংঘে ইসরাইলের প্রতি আহবান জানিয়েছেন- ফিলিস্তিনের দখল করা জমি ফিরিয়ে দিতে।
প্রতিনিয়তই ফিলিস্তিনে হামলার প্রতিবাদ জানায় আওয়ামী লীগ সরকার। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতেও এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার দাবি করেছে বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত এই বিষয়ে একেবারে চুপ। কারণ, আসন্ন সংসদ নির্বাচনে আমেরিকার সহায়তা পাওয়ার আশা। দেশে জনপ্রিয়তা নেই জন্য পশ্চিমাদের ওপর নির্ভর করাই তাদের একমাত্র ভরসা। উল্টো দেশে অবরোধের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস, মানুষ হত্যা, ইসরাইল স্টাইলেই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। মুখে ধর্মের কথা বললেও, আজ নিপীড়িত মুসলিমদের প্রতি সামান্যতম মানবতা দেখানোর মতো ভদ্রতাও নেই বিএনপি-জামায়াতের।
জামায়াতের রাজনীতি ধর্ম কেন্দ্র করে, সহজ সরল মানুষদের জঙ্গিবাদে ঠেলে দিয়ে তাদের পরিবারকে বিপদে ফেলে, অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে কোরআন পোড়ায়, তাদের এই ধর্মব্যবসার মুখোশ এবার দেশবাসীর সামনে নগ্নভাবে উন্মোচিত। বর্তমান সরকারের উন্নয়নে দেশের মানুষ যখন স্বস্তিতে, তখন বিএনপি-জামায়াত জ্বালাও-পোড়াও করে মানুষের জীবনযাত্রা ব্যহত করছে। দেশে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে ও উন্নয়নশীল বাংলাদেশের গর্বিত অংশীদার হতে প্রত্যেকটি নাগরিককে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বর্তমান সরকারকে ভোট দেয়ার আহবান জানাই।
লেখক: ট্রেজারার, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/আইই