নিবন্ধনহীন জামায়াত টিকে আছে কিভাবে?
১৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১২:২১
আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে গত ১৫ বছরে শান্তি, সমৃদ্ধি ও গণতন্ত্রের পথে হেটে বাংলাদেশ অনেক কিছু অর্জন করেছে। অনেক মেগা প্রজেক্ট সফল বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে সব থেকে বড় অর্জনগুলোর একটি হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়া এবং দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব যারা প্রত্যক্ষভাবে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও সাজা কার্যকর হওয়া।
২০০৮ সালে আমি প্রথম জাতীয় নির্বাচনে ভোটার ছিলাম। দিন বদলের সনদের সেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাকে যেমন টেনেছিল, তেমনি একইভাবে টেনেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বঙ্গবন্ধুকন্যার দৃঢ়চেতা মনোভাব। বিশ্বাস ছিল একমাত্র তিনিই পারবেন বাঙালির কপালের এই পাপের চিহ্ন মোচন করতে। তিনি তা করে দেখিয়েছেনও।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ বলে যে রায় হাইকোর্ট দিয়েছিলেন, সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে দলটির আপিল আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ। সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্তের ফলে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ই বহাল থাকল। অর্থাৎ, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করা জামায়াতের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ আর খুলল না। কিন্তু সম্প্রতি নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচি দিচ্ছে দলটি, করেছে বিশাল জমায়েতও।
২৮ অক্টোবরের বিএনপির ঢাকা জুড়ে তাণ্ডবের দিনও জামায়াত মতিঝিলে একধরনের বড় জনসমাবেশেই ঘটিয়েছিল। তাই যারা ভাবছেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের জামায়াতের নিবন্ধন চূড়ান্ত বাতিল হলেই দলটি থেকে যাবে তা কিন্তু না বরং তারা আগের মতোই সাংগঠনিক শক্তি দেখতে চাচ্ছে।
২০০৯ সালে জামায়াতকে নিষিদ্ধের জন্যে দায়ের করা রিটে চারটি বিষয় তুলে ধরে জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়। সেগুলো হলো—প্রথমত, জামায়াত নীতিগতভাবে জনগণকে সব ক্ষমতার উৎস বলে মনে করে না। সেই সঙ্গে আইন প্রণয়নে জনপ্রতিনিধিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না।
দ্বিতীয়ত, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ অনুসারে কোনো সাম্প্রদায়িক দল নিবন্ধন পেতে পারে না। অথচ কাজে কর্মে ও বিশ্বাসে জামায়াত একটি সাম্প্রদায়িক দল।
তৃতীয়ত, নিবন্ধন পাওয়া রাজনৈতিক দল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গের কোনো বৈষম্য করতে পারবে না। কিন্তু জামায়াতের শীর্ষ পদে কখনো কোনো নারী বা অমুসলিম যেতে পারবে না।
চতুর্থত, কোনো দলের বিদেশে কোনো শাখা থাকতে পারবে না। অথচ জামায়াত বিদেশের একটি সংগঠনের শাখা। তারা স্বীকারই করে- তাদের জন্ম ভারতে। বিশ্বজুড়ে তাদের শাখা রয়েছে। চূড়ান্ত নিবন্ধনহীন জামায়াত এই বিশ্বাসের কোনোটা থেকে কোনোদিন সরবে বলে আমি বিশ্বাস করি না।
সুতরাং সরকারের উচিত নির্বাহী আদেশে এমন একটা যুদ্ধাপরাধী দলকে নিষিদ্ধ করা। সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের আলোকেই নিষিদ্ধ হতে পারে জামায়াত-শিবিরসহ জঙ্গিবাদী ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। এজন্য নতুন কোনো আইন প্রণয়ন বা আদালতের কোনো রায়েরও প্রয়োজন নেই।
যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের নামে কয়েক বছর আগে সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের নৈরাজ্যজনক তাণ্ডব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নেওয়াসহ রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের কারণে সরকার সাংবিধানিকভাবেই উগ্রপন্থি দলগুলোকে নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে নিষিদ্ধ করতে পারে। এজন্যে সরকারের আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রাখার দরকার নেই।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্বাস ও চর্চা তা সুষ্ঠু রাজনৈতিক ধারা বজায় রাখার জন্যে সবসময় জারি রাখতে হবে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে যে দলটি বাংলাদেশ চায়নি তাকে আমরা নিষিদ্ধ করতে পারিনি। এর থেকে কষ্টের কথা আর কী হতে পারে। অথচ এই বাংলাদেশে কোনোদিন তাদের স্থান হওয়ার কথা ছিল না।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়া প্রথম জামায়াতকে পুনর্বাসন শুরু করেন। সংবিধান সংশোধন করে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে নিষিদ্ধ জামায়াতকে মূলধারার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেন।
বিদেশে পালিয়ে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকত্বহীন গোলাম আজমকে ফিরিয়ে এনে দেন নাগরিকত্ব। জামায়াত সুযোগ পায় বাংলাদেশের মানচিত্রকে আবার খামচে ধরার।
যে দলটি বাংলাদেশ চায়নি। যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে বাঙালির বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল, তারা এদেশে মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পায়।
জামায়াতকে নিয়ে ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষের লোকজনকে বুঝতে হবে, জামায়াত কখনো সংশোধন হওয়ার নয়। অন্য দলগুলোর মতো অর্থনৈতিক টানাপড়েনে তারা কখনোই পড়বে না।
এই দেশের সিংহভাগ মানুষের ধর্মকে পুঁজি করা জামায়াতের আয়ের অনেক উৎস রয়েছে। সাধারণ মানুষের আবেগ তাদের টাকা আয়ের প্রধান হাতিয়ার। নিষিদ্ধ না হলে, অনিবন্ধিত অবস্থায় তারা কোনোদিন এদেশে বিলীন হবে না।
মনে রাখতে হবে, তাদের আর্থিক মেরুদণ্ড অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে নিষিদ্ধ এবং জামায়াত মুক্ত বাংলাদেশ হোক আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/আইই