Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিনোদনের নামে যা হচ্ছে আর যা করণীয়

আনোয়ার হাকিম
২০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৮:১৬

এ দেশে রঙ্গ করার লোকের অভাব নাই। রঙ্গ প্রিয় জাতি নানা প্রতিকূলতার মধ্যে দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে বিভিন্ন বিনোদন-আয়োজনে নিজেদেরকে ব্যাপৃত রাখতে পছন্দ করে। কালের পরিক্রমণে বিনোদন অঙ্গণে নানা পরিবর্তন এসেছে। অনেক সংযোজন ও ব্যাপক বিয়োজনের পর এখন বিনোদনের যে চেহারা দাঁড়িয়েছে তা নিয়ে যেন কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। কারো কারো অবশ্য উদ্বিগ্নতা আছে, তবে তা প্রকাশে ভীতি আছে। এ কারণেই বিনোদনের অঙ্গণে এখন চলছে সার্কাসের প্রভাব।

বিজ্ঞাপন

আগেকালে সার্কাস ছিলো নির্মল চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। পুতুল নাচ ছিলো বিনোদন শিল্পের অপার বিস্ময়। যাত্রা ছিলো আপামর মানুষের নিরানন্দময় জীবনে এক পশলা স্বস্তি। কবির লড়াই ছিলো শিল্প নিপুণতার চূড়ান্ত রূপ। শহুরে সমাজে নাটক ছিলো মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত সমাজের সান্ধ্য বিনোদনের অনুপম আনন্দ। সর্বোপরি সিনেমা ছিলো সর্বসাধারণের আটপৌরে জীবনে তিন ঘন্টার আসক্তি। কালের পথ যাত্রায় আজ এসবের কতক হয়েছে বিলুপ্ত প্রায়, কতক বদলেছে তার চরিত্র। আর কতক নিয়েছে উগ্র মেক আপের কদর্য রূপ। আগে বিনোদনের সব কিছুতেই ছিলো দৈশিক ও ঐতিহাসিক ছোঁয়া। আর এখন দেশজ ফ্লেভার নিষ্ক্রিয় হয়ে তার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে বিদেশ-সংস্কৃতি আর চিত্তবৈকল্য। এখন বিনোদন মানেই টিভি চ্যানেল, ইউটিউব, টিকটক, রীল, ফেসবুক। আর বড় পর্দায় সিনেমার নামে চলছে নগ্নতা-প্রধান দুর্বল উপস্থাপনা।

বিজ্ঞাপন

আবহমান কাল থেকেই শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি তার নিজস্ব তালে বিকশিত হয়েছে। কয়েক যুগ বিরতিতে তাতে একেকবার জোয়ার এসেছে। এক ঝাঁক গুণী শিল্পীর সরব উপস্থিতিতে আমরা পেয়েছি কালোত্তীর্ণ সব শিল্পকর্ম। এখন আধুনিকতার জোয়ারে যা হচ্ছে তা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা-তামাশা আছে, নানাবিধ টানাপোড়েনের মাঝে বিনোদনের সুড়সুড়ি আছে, চিত্তসুখ নেই। কিন্তু তৃপ্তি নেই।

আজকাল প্রায় সবার কাছেই সমালোচনা ‘অসহ্যকর’ হয়ে উঠেছে। এর কারণ ‘ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল মারার গোঁসাই’ বোধ। আবার সমালোচনার নামে পক্ষপাতদুষ্ট বা প্রতিহিংসা পরায়ণ প্রপাগান্ডাও চলছে অবাধে। পরমত সহিষ্ণুতার বড় অভাবও রয়েছে। অর্থনীতির চরিত্রের সাথে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিরও চরিত্র পরিবর্তিত হচ্ছে সমানুপাতিক হারে। রাজনৈতিক আবহাওয়া এই চরিত্র পরিবর্তনের অনুকূল প্রভাবক হিসেবে সহায়ক ভূমিকা রাখছে। সব মিলিয়ে বিনোদনের নামে, বিনোদন জগতে এখন যা হচ্ছে তা বিচ্ছিন্ন কিছু কর্ম বললেও অবমূল্যায়ন করা হবে না। এসব বিচ্ছিন্ন ও অর্থতাড়িত প্রচেষ্টা সামষ্টিক যে চেহারা নিয়ে আজ দৃশ্যমান হচ্ছে তা রীতিমত কদাকার ও ভয়ংকর। অর্থনীতির আদি সূত্র হলো ‘ব্যাড মানি ড্রাইভস আউট গুড’। বিনোদন জগতে এখন এরই সূত্রমতে কার্যকলাপ চলছে। সৃজনশীলতার ঘাটতি নেই, বিষয় বৈচিত্রের দুর্ভিক্ষ নেই। তবু কোন পরিতুষ্টি নেই। সামাজিক, পারিবারিক চাহিদা পূরণের সুযোগ নেই। মানের কথা তো অনেক পরের বিষয়। যারা এ জগতে এখনো ক্রিয়াশীল তাদের এ নিয়ে কোন উদ্বিগ্নতা নেই। কারণ টিকে থাকার প্লাটফর্মে তাদের চলমান মেহনতের রিটার্ন নিশ্চিত। তাই সৃজনশীলতা এখন ককটেল পরিবেশনায় পেরেশান।

আবার পাল্টা উদাহরণও প্রক্ষিপ্ত হতে পারে। এক সময়ের যাত্রা শেষতক আর সেই মানে থাকেনি। কথা সত্য। লোকের মুখে এক সময় শোনা যেত, “যাত্রা দেখে ফাতরা লোকে”। যাত্রার আবহাওয়া কলুষিত হয়েছিলো এর অতি বাণিজ্যিক অভীপ্সা থেকে। তাই মূল যাত্রাকে গৌণ করে এক ঝাঁক ডানাকাটা পরীর অশ্লীল উপস্থাপনা এর উদ্দেশ্যকে করেছিলো ভিন্ন খাতে প্রবাহিত। ফলতঃ এক কালের সমৃদ্ধ যাত্রা শিল্প আজ বিলুপ্ত প্রায়। তদ্রুপ সাকার্সও। আর এসবের প্রভাবে পুতুল নাচ, কবির লড়াই হয়েছে মূলোৎপাটিত। আকাশ সংস্কৃতির রতিসুখময় বিনোদনের প্রাবল্যে শহুরে নাগরিক সমাজও তাদের লালিত ও চর্চিত আভিজাত্য বিসর্জন দিয়ে নাট্যমঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। সংস্কৃতির এই বিপর্যস্ত অবস্থায় বড় লগ্নীর সিনেমা হতচকিত হয়ে প্রথমে টিকে থাকার লড়াই করেছে, পরে হাত গুটিয়ে নিয়ে ‘দুম্মা চালে’ মনের চাতুরী মিশিয়ে বিনোদনের নামে যা উপহার দিচ্ছে তা নিয়ে সমালোচনা চলে। আলোচনার মত কিছু আছে কি?

প্রশ্ন হতে পারে কেন এই বিপর্যয়? কেন এই বিপন্নতা? কারণ হিসেবে খুব সহজেই বলা যেতে পারে এর মূলে রয়েছে পুঁজির অপরিহার্য সূত্র। বলা যেতে পারে সামাজিক শক্তির শিথিলতা। বলা যেতে পারে রাষ্ট্রিয় দিক নির্দেশনার উদাসীনতা। সর্বোপরি বলা যেতে পারে, সর্বজন গ্রাহ্য বৈশ্বিক ঢেউ ও আকাশ সংস্কৃতির ভিন্ন পথ পরিক্রমা। যুক্তি হিসেবে সব ক’টিই অত্যন্ত মজবুত। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আমাদের ব্যাপক উদাসীনতা, দুর্বল সংস্কৃতি-চেতনা, উৎকট পুঁজি আহরণ-মানসিকতা এবং নাগরিক সমাজের নির্লিপ্ততা বহুলাংশে দায়ী। যার ফলে ক্রমে ক্রমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে অভিজাত সমাজেও ঝলমলে ইন্দ্রিয়সুখ নির্ভর কাহিনী-চিত্রের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন তা মোহাবিষ্ট করে রেখেছে।

প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক বৈশ্বায়ন বিমুখতা কি যুক্তি সংগত? এক কথায় এর উত্তরে না গিয়েও বলা যায়, বিশ্বায়ন এখন পরম বাস্তবতা। অতি রক্ষণশীল হয়ে এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে করণীয় অবশ্যই আছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও নির্দেশনা কাজ করতে পারে আলোকবর্তিকা স্বরূপ। প্রণোদনা ও উৎসাহ হতে পারে উদ্দীপক। আবহাওয়া বিনির্মানের কাজটি অবশ্যই রাষ্ট্রের তথা সরকারের। এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ নয়, অযাচিত ঘুটা দেওয়াও নয়, সত্যিকার অভিভাবকের দায়িত্বপূর্ণ কাজই হতে পারে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সুষ্ঠু-স্বাভাবিক, বৈচিত্র্যময়, সৃজনশীল ও মানোন্নয়নের সহায়ক শক্তি।

বিনোদনের আলোচনা হবে আর ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, রীল, ওটিটি আলোচনা বহির্ভূত থাকবে তা হতে পারে না। নেট দুনিয়া প্রতিনিয়ত বৈশ্বিক রূপ পরিগ্রহ করছে। বিনোদনের রস আস্বাদন এখন আর অঞ্চল ভিত্তিক নেই। হয়েছে বিশ্বব্যাপী। তাই বলে ইরানী চলচ্চিত্র তার স্বকীয়তা বিসর্জন দেয় নি। লন্ডন থিয়েটার শাট-ডাউন হয়ে যায় নি। অস্কার চলচ্চিত্র পুরষ্কার তার উপযোগী সিনেমা খুঁজে না পাওয়ায় বছর বছর পুরষ্কার প্রদান বন্ধ রাখে নি। এখনো দেশে দেশে অঞ্চল ও সীমানা ভেদে কালোত্তীর্ণ গানের কমতি নেই। আমাদের সমাজ জীবনে, ব্যাক্ত জীবনে নেট দুনিয়ার প্রভাব দ্রুত বর্ধণশীল হচ্ছে। আর আসক্তি বাড়ছে ততোধিক। বিনোদন দুনিয়ায় প্রতিভার আনাগোনা যেমন থাকবে তেমনি আগাছার উৎপাতও থাকবে। দিন শেষে দর্শক-শ্রোতার চাহিদা অনুযায়ী এদের স্থান ও মান নির্ধারিত হবে। তবে তা নিয়ে শংকারও বিষয় আছে। থাকতেই পারে। তাই, আলোচনা-সমালোচনাও হতে হবে। তা না হলে সস্তা ও অপ বিনোদন অর্থনীতির সূত্র মতে সুস্থ ও সৃজনশীল কন্টেন্টকে পেছনে ছাই চাপা দিয়ে ফেলবে। এখানেই সুনাগরিকদের দায়িত্ব রয়েছে। তাদের দায়িত্ব কারো মুখাপেক্ষী হয়ে নিশ্চুপ থাকা নয়।

অতীত অতীতই। তাই বলে পরিত্যাজ্য নয়। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েই সত্য, সুন্দর, সৃজনশীল ও মহৎ কর্মে আগামীর পথা চলতে হবে। এখন যা হচ্ছে তার সবই খারাপ বলা যেমন উন্নাসিকতার নামান্তর তেমনি যা হচ্ছে তার অনেকাংশই যে অখাদ্যকর ও অরুচিকর তা না বললেও সত্যের অপলাপ হবে। প্রবাদে আছে ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’। এখন এই প্রবাদের ক্ষেত্রেও সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। রিফু কর্ম করারও একটা পর্যায় রয়েছে। শতধা ছিন্ন বসনে সময় মত রিফু কর্ম না করলে তা যেমন আর পরিধেয় উপযোগী থাকে না তেমনি সময়ের কাজ সময়ে না করলে পরে তা করা নিরর্থক হয়ে পড়ে। তার প্রকৃষ্ট নজীর হলো এককালের বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও বর্তমান সুশীল-প্রবক্তার বেশ কয়েক মাস আগে করা একটি উক্তি। রুচির দুর্ভিক্ষ কাল চলছে বলে সুনির্দিষ্ট কিছু কথা বলে বিপাকে পড়েছেন তিনি। তাঁর পক্ষে কতিপয় শিল্পী ও কুশীলব আওয়াজ তুললেও প্রতিপক্ষের যুক্তি, অভিমত, কটুক্তি বা বক্তব্যের জোয়ারে রুচির দুর্ভিক্ষের চিত্র ক্রমেই আরো উৎকট ও বেপোরোয়া হয়ে উঠেছে। এখানে এখন পরীদের বেশুমার কদর, ‘হিরো’দের ব্যাপক দাপট, আকাশের তারার চেয়েও মডেলদের প্রজ্জ্বলন প্রকট। এখন বিশিষ্টদের নামে উচ্ছিষ্টদের উৎপাত অসহ্যকর হয়ে উঠেছে। এদের হাতেই শিল্প-সংস্কৃতির চাবিকাঠি। মূল স্রোতের বাইরে এসব তারকাদের ফিতা কাটা আর স্টেজ পারফরম্যান্স মোটের উপর সংস্কৃতিতে কী যোগ করছে তা সহজেই অনুমেয়। বাণিজ্য এখানে তাঁবু গেঁড়ে বসেছে। তাদেরকে পণ্যের, সামগ্রীর, আইটেমের মডেল বানিয়ে, নতুন ককটেল ফর্মুলা সেট করে পাবলিকের ‘নো চয়েস’ এর সুযোগ নিয়ে যা ইচ্ছে তাই দেখানো হচ্ছে ও গেলানো হচ্ছে। শিল্পীদের আয়ের নানামুখী দ্বারোদঘাটন হচ্ছে। আগেকার প্রথিতযশা শিল্পীদের শেষ বয়সের আর্থিক দৈন্যতা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গিয়েছিলো। এখনো প্রকৃত গুণী শিল্পীদের অবস্থার ইতর বিশেষ উন্নতি হয় নি। অথচ অন্যরা রমরমা। এতে করে মূল ধারার গুণী শিল্পীরাও জীবন-জীবিকার তাগিদে বা টিকে থাকার প্রয়াসে সস্তা বিনোদনের ডামাডোলে গা ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকেই বলতে পারেন, টিকে থাকাই মুখ্য, অন্য সব কিছু গৌণ। এটা বাণিজ্যের সাধারণ সূত্র। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি এর অনুগামী হলে দেশের সাংস্কৃতিক আবহাওয়া যা হবার তা-ই হচ্ছে। তাই বলে হতাশার কিছু নেই, আছে করণীয়। শিল্পীদের শিল্প-কর্মে প্রণোদনা প্রদান জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারের দায় আছে সত্য। তাই বলে সামাজিক, সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষক সংস্থা ও গোষ্ঠীরা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। সংস্কৃতির চর্চা হতে হবে মফস্বল ও প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রণোদনা ও পুরষ্কার হতে হবে ইনসাফ ভিত্তিক। গোষ্ঠী প্রীতি ও প্রভাব বলয়ের যোগসাজশে হলে শিল্পী-সত্ত্বা আহত হয়। তাদের সত্ত্বার সম্পূর্ণ স্ফুরণ হয় না। মিডিয়ার ভূমিকা এক্ষেত্রে অপরিসীম। চ্যানেলের ভিউ আর পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে চটকদার কন্টেন্ট ও ব্যাক্তিকে হাইলাইট করার উদ্যোগ জনমানসে বিপরীত প্রভাব ফেলে। রুচির দুর্ভিক্ষ তৈরিতে উর্বরতার কাজ করে। পাবলিকের সাময়িক উত্তেজনা বা রতিসুখ নিবারণে নয় বরং সুদূর প্রসারি ভূমিকা রাখতে শিল্পীদের নিজেদেরকেই ঐক্যবদ্ধভাবে পরিকল্পনা ও কৌশল নির্ধারণ করে এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বিনোদন জগতে স্টেজ পারফরম্যান্স হয়ে উঠবে শিল্পীর মান নির্ধারণের মাপ কাঠি। আর সংস্কৃতি হয়ে উঠবে পুঁজি বিনিয়োগের উর্বর প্লাটফর্ম। এখনো সময় আছে ঘুরে দাঁড়াবার।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

সারাবাংলা/এসবিডিই

আনোয়ার হাকিম বিনোদনের নামে যা হচ্ছে আর যা করণীয় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর