Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একতরফা নির্বাচনের অভিযোগের ভিত্তি আছে কি? 

ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে
৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:৫২

বাংলাদেশের বহুল প্রতীক্ষিত ১২তম সংসদীয় নির্বাচন ২০২৪ সালের ৭ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন ধরণের সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও, এটা ইতিমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, দেশে প্রায় ৪১ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবী আদায়ে ব্যর্থ হয়ে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রয়োজনীয় যে কোনও উপায়ে নির্বাচনকে বাধাগ্রস্থ করার জন্য তাদের দৃঢ় সংকল্প ঘোষণা করে। তবে, সাম্প্রতিক মাসগুলিতে তারা কার্যকরভাবে সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে নি। তবে, নির্বাচন বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে তারা একটি কাহিনী উপস্থাপনের চেষ্টা করেছে যে নির্বাচন কমিশন ও সরকার একতরফা নির্বাচন আয়োজন করেছে।

বিজ্ঞাপন

এখন, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল- বিএনপি যে গল্পটি প্রচার করছে তা সত্য কি না? রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে। নির্বাচনে বিএনপি-র অনুপস্থিতির অর্থ এই নয় যে নির্বাচন  অংশগ্রহণমূলক হয় নি। কারণ অন্যান্য বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। তাছাড়া, বিএনপি-র দাবির বৈধতা মূল্যায়ন করার সময়, নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার জন্য বিএনপি-র নেওয়া সিদ্ধান্তের পিছনের অন্তর্নিহিত যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মনে করে, নির্বাচন বর্জন এবং হরতাল, অবরোধ ও অগ্নিসংযোগের মতো কৌশল অবলম্বন করে নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত করার যে সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছিল তা বিভ্রান্তিকর।

বিজ্ঞাপন

নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এই নির্বাচনে মোট ১৯৬৯ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ১৫৩৩ জন প্রার্থী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে এবং ৪৩৬ জন স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। মোট ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৬৩টি আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। অন্যদিকে, জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা লাঙ্গলের প্রতীকের অধীনে ২৮৩টি নির্বাচনী আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। গড়ে, প্রতিটি নির্বাচনী আসনে ছয়জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, যা বেশ ভাল বলে মনে করা হয়। নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে বিএনপি-র সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও, দলের বেশ কিছু কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা স্বতন্ত্রভাবে বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট গঠন করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। এর থেকে বোঝা যায় যে, দলের নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রাখা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাদের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেনি।

নির্বাচনের দিন প্রায় ৪১ শতাংশ ভোটার উদযাপনের পরিবেশ নিয়ে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে।  নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে যে ক্ষমতাসীন দল ২২২টি আসন পেয়ে একটি দুর্দান্ত বিজয় অর্জন করেছে। অন্যদিকে, নির্বাচনে ৬২ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। জাতীয় পার্টি মাত্র ১১টি আসনে জিতেছে। বর্তমান আইনসভার মোট ৫৫ জন সংসদ সদস্য নির্বাচনে সাফল্য অর্জন করতে পারেন নি। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ভোটদান প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তাই, এই নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।

অতএব, নির্বাচনকে একতরফা বা অংশগ্রহণমূলক নয় মর্মে আখ্যা দেওয়া যায় না। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে অবশ্যই বুঝতে হবে যে নির্বাচনই একমাত্র উপায় যার মাধ্যমে তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতৃত্ব দেওয়ার কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে পারে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করে সরকার গঠনের আর কোনও সুযোগ নেই। অতএব, একটি সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য, রাজনৈতিক দলগুলিকে অবশ্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং ভোটারদের আস্থা অর্জন করতে হবে।

প্রকৃতপক্ষে, গণতন্ত্রের প্রকৃত নীতিগুলি মেনে চলে না বিএনপি। ফলে, তারা নাগরিকদের উপর নির্ভর করার পরিবর্তে বিদেশী খেলোয়াড়দের উপর আস্থা রেখেছিল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিছু বিদেশী খেলোয়াড়ের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করেছিল, যারা অবাধ ও নিরপেক্ষ, পাশাপাশি বিশ্বাসযোগ্য একটি নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সরকারের উপর চাপও প্রয়োগ করেছিল। ফলে, দলটি দীর্ঘ সময়ের ধরে অযৌক্তিক আচরণ প্রদর্শন করে আসছে। ২০১৪ সালে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থেকে একটা বড় ভুল করেছিল। দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাদের ভুল থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করে নি বিধায় ২০২৪ সালের নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের ভুলের পুনরাবৃত্তি করেছে।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে এই দলটি নির্বাচন থেকে বিরত থাকার এবং নির্বাচন প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচন প্রতিহত করার কৌশলের অংশ হিসাবে, তারা নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্কের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে। দলের সমর্থকদের দ্বারা সংঘটিত অগ্নিসংযোগের হামলায় দেশ কয়েকজন ব্যক্তি মারা গেছেন। একই সাথে, কয়েকশ ব্যক্তি এখনও পোড়ার কষ্ট নিয়ে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হয়ে বেঁচে আছে। তাদের এই নেতিবাচক কৌশল দলকে রাজনীতির অতল গহ্বরে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে, বিএনপি আহূত হরতাল ও অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি  সরকারকে প্রভাবিত করতে বা জনসাধারণের চলাচলে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিএনপি-র আহ্বানের প্রতি জনগণ কোন সমর্থন প্রদান করে নি।

অতএব, সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে এক তরফা নির্বাচন বলে বিএনপি যে দাবি করেছে তার বৈধতা নেই। বাংলাদেশের নাগরিকরা ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে, সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক অনুঘটকের সহায়তায় নির্বাচন কমিশন সারা দেশে একটি নিরপেক্ষ, ন্যায়সঙ্গত এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন তা নিয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা হল নির্বাচন কমিশন একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। একই সাথে সরকারও দেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্যও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। ফলে, বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন বিজয়ী দলকে বৈধতা প্রদান করবে এবং দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক নীতি ও পদ্ধতিগুলিকে শক্তিশালী করবে। একই সঙ্গে আগামী দিনে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নিজেদের অস্তিত্ব সুরক্ষিত করতে প্রকৃত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে বিএনপি।

লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

একতরফা নির্বাচনের অভিযোগের ভিত্তি আছে কি? ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর