যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দুরভিসন্ধি ও দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন
৯ জানুয়ারি ২০২৪ ১৮:৪৫
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সর্বদা অন্যের ব্যাপারে নাক গলাতে সিদ্ধহস্ত। খুব সুন্দর সুন্দর শব্দ চয়নেও বেশ পারঙ্গম তারা। গণতন্ত্র, মানবতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, জনকল্যাণ ইত্যাদি গালভরা বুলি আওড়িয়ে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যারপরনাই থাকে সদা ব্যস্ত। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। এদের দ্বিমুখী নীতির কারণে সারা বিশ্বজুড়ে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কোটি কোটি জনগণ নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
সাম্প্রতিক উদাহরণ গাজায় নির্বিচারে ইসরাইলি হামলার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা। এককালের পরাশক্তি যুক্তরাজ্যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার্থে সর্বদাই যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণে ব্যতিব্যস্ত। যাহোক, আসল কথায় আসা যাক, বাংলাদেশের দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র নানামুখী কথা বলে আসছে।
নিজেদেরকে বিশ্ব মোড়ল ভাবা যুক্তরাষ্ট্র অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলালে যে তা সেই দেশের সরকার ও জনগণের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ সেই বোধ তখন আর যুক্তরাষ্ট্রের থাকে না। যুক্তরাষ্ট্রে বারবার বাংলাদেশের সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছে। যা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ সরকারও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের জন্য ছিল বদ্ধ পরিকর এবং সেইভাবেই কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র বলছে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এই বলার পেছনে যে যুক্তরাষ্ট্রের দুরভিসন্ধি রয়েছে তা বুঝতে খুব বেশি ঘাটাঘাটি করতে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সেন্টমার্টিন দ্বীপটি রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ যা তারা করায়ত্ত করতে চায় কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের কারণে তা তারা করতে পারছে না।
তাই তারা চায় জামায়াত-বিএনপির মতো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানো দলগুলো ক্ষমতায় আসুক এবং পুতুল সরকারের হাত ধরে তারা সেন্টমার্টিন দখল করে ভূ-রাজনীতিতে চীন, রাশিয়া ও ভারতকে কোণঠাসা করে রাখবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যেভাবে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাচ্ছে তাতে নির্বাচনে জনসমর্থন যে আওয়ামী লীগের দিকেই যাবে সেটা তারা জানে। তারপরও সুষ্ঠু নির্বাচনকে বিতর্কিত করার অভিপ্রায়ে তারা এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এবং তাদের দেখাদেখি যুক্তরাজ্যেও।
এবার দেখা যাক, আসলে এই নির্বাচন কতটা অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে বিষয়টি তা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। কোনো দল যদি নির্বাচনে না আসে সেটা ঐ দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। গুটি কয়েক দল নির্বাচনে না আসলে যে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না তা কিন্তু বলা যাবে না।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপিসহ মোট আটাশটি দল অংশগ্রহণ করেছে। তাছাড়া দলের বাহিরে ৪৩৬ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র নির্বাচন করেছে। তাই এই নির্বাচনকে কোনোভাবেই বলা যাবে না যে অংশগ্রহণমূলক ছিল না। বিশ্বের অনেক দেশেই একসময়ে ক্ষমতার মসনদে অসীন দল নিজেদের জঙ্গি নীতির কারণে নিষিদ্ধ হয়েছে।
বিএনপি-জামায়াত যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে, জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে যাচ্ছে তা জঙ্গি কার্যক্রমের সাথেই তুল্য। ঐরকম সন্ত্রাসী ভাবাপন্ন দলগুলো বরং গণতন্ত্রের জন্য হুমকিসরূপ। তাই এই দলগুলোর আসা বা না আসা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে না। এবার ভোটের দিনের কথা যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠু হয়েছে।
বাংলাদেশে শত শত পত্রিকা, টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়া এবং রেডিও পুরোদিনের ভোটের হালচিত্র তুলে ধরেছে। এগারো কোটিরও অধিক ভোটারের দেশে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতেই পারে। গবেষণাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মার্জিন অফ ইরর হিসেব করাটাই বিজ্ঞানসম্মত। এখন অল্প কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকেই যদি পুরো বাংলাদেশের ভোটের হালচিত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাহলে বুঝতে হবে এর মধ্যে আছে অন্য কোনো অভিসন্ধি।
যে সকল কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে সবগুলোই কিন্তু নির্বাচন কমিশন স্থগিত করে দিয়েছে। পুরো দিনের ভোটের চিত্র বিবেচনায় নিলে দেখা যায় ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট কেন্দ্রে এসেছে। খুশি মনে ভোট দিয়েছে। এসব তো আমরা টিভি ক্যামেরাতেই দিনভর দেখেছি।
উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর ভোটের দিনের সহিংসতা ও অনিয়মের বিষয়টি আমলে নিলে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় এই নির্বাচন বাংলাদেশের পূর্বের যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে অনেক শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
এবার যদি ভোটের হিসেবের দিকে তাকানো যায় তাহলে দেখা যায়, এই নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের মতো সন্ত্রাসী দলের লাগাতর হরতাল, অবরোধসহ নানান ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড ও নির্বাচন বিরোধী অপপ্রচার এবং ভোটের দিনের হরতাল পালনসহ বিভিন্ন হুমকির বিরুদ্ধে গিয়ে ৪০% জনগণ যে স্বতঃ:স্ফূর্তভাবে ভোট কেন্দ্রে এসেছে সেটাই তো গণতন্ত্রের জয়।
সুইজারল্যান্ডের শেষ নির্বাচনে ৩৬.১%, বুলগেরিয়ায় ৩৮% মানুষ ভোট দিয়েছে। ২০১৮ সালের আমেরিকার নির্বাচনে ৪৯% ভোটার ভোট প্রয়োগ করেছে যা ছিল পুরো আমেরিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ আর ২০২২ সালের নির্বাচনে ছিল মাত্র ৪৬%। ২০২২ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের মিডটার্ম নির্বাচনে ভোটের দিন সশরীরে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন মাত্র ২১% ভোটার।
সাধারণত আমেরিকার ভোট হয় প্রায় এক মাসজুড়ে যেখানে বাংলাদেশে ভোটের সময় মাত্র আট ঘণ্টা। এই বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বাংলাদেশের ভোটার উপস্থিতিকে কোনোভাবেই কম বলা যাবে না। অন্যদিকে সর্বশেষ ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৩৭.২%, আর যুক্তরাজ্যের ২০২১-এর স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল ৩৫.৯%।
বাংলাদেশের ভোটের আগে ও পরের সহিংসতা বিবেচনা নিলে ভোটার উপস্থিতিকে অবশ্যই সন্তোষজনক বলতে হবে। ভোটের সার্বিক কার্যক্রম নিয়ে আমেরিকার একজন নির্বাচক পর্যবেক্ষক, যিনি তাদের কংগ্রেসের সাবেক সদস্য. সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচক পর্যবেক্ষক মাসেলম্যান, আমেরিকার সাবেক কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাটস, কানাডার পার্লামেন্ট সদস্য ভিক্টর ওএইচ, রাশিয়ান কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি এন্ড্রু শুতোভ, ফিলিস্তিনের হিসাম কুহেইল, স্কটিস এমপি মার্টিন ডে, ওআইসির নির্বাচন ইউনিট প্রধান সাকির মাহমুদ বান্দারসহ অন্যান্য পর্যবেক্ষকগণ বাংলাদেশের দ্বাদশ নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।
আমেরিকান গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজির প্রধান নির্বাহী আলেকজান্ডার বি গ্রে নির্বাচন শেষে বলেছেন,‘ আমি নিজের চোখে দেখেছি নির্বাচন ছিল অবাধ ও সুষ্ঠু। এবং উচ্চ পেশাগত মানদণ্ডে ছিল অনন্য।’ অপরদিকে ইন্দো-কানাডিয়ান লিবারেল রাজনৈতিক নেতা চন্দ্রকান্ত আরিয়ার সরাসরি বলেন, ‘এত সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কখনোই প্রত্যক্ষ করিনি। তাই এই নির্বাচনকে আমরা গ্রহণ করছি।’
সারা বিশ্ববাসীও টেলিভিশনের পর্দায় তা অবলোকন করেছে। তারপরও যখন নিজেদের বিশ্ব মোড়ল ভাবা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্য এই সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনকে নিয়ে প্রশ্ন তোলে তখন সহজেই বোঝা যায় তাদের দুরভিসন্ধি। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় মানেই বাইডেন প্রশাসনের পরাজয় যা তারা মেনে নিতে পারছে না বলেই নির্বাচন নিয়ে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের চাপ প্রয়োগ নীতি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতিরিক্ত নাক গলানো বাঙালি ভালোভাবে নেয়নি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এখনো বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধতা ও দৃঢ়তা উপলব্ধি করতে পারেনি।
বাঙালি কখনোই মাথা নোয়াবার নয়। যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র বিরোধিতার পরও দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বাঙালি স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। তাই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে সেই সব ষড়যন্ত্রের জাল বাঙালি ছিন্ন করবে এবং পৌঁছাবে উন্নয়নের শীর্ষে।
লেখক: অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মুহম্মদ মাহবুবুর রহমান লিটু মুক্তমত যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য