Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ভাষার মাসে বইমেলার গুরুত্ব

ড. মিহির কুমার রায়
২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৫৫

বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গনে মাসব্যাপী একুশে বইমেলার উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ভাষা-সাহিত্যসহ সবকিছুকে স্মার্ট করতে হবে। যার জন্য প্রকাশকদের ডিজিটালি বই প্রকাশের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এবার সরকারের লক্ষ্য স্মার্ট বাংলাদেশ। বাংলা সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে প্রকাশকদের এখন থেকে ডিজিটালি বই প্রকাশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের বাংলা ভাষা মধুর। এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। এরপরও বই প্রকাশ হবে। বই পড়ার আনন্দ আছে। তবে এখনকার শিক্ষার্থীরা ট্যাবে ও ল্যাপটপে বই পড়ে। আমরা সেভাবে আনন্দ পাই না। তিনি বলেন, ভাষার সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা উচিত। তাই প্রকাশকদের বলব, এখন থেকে বই ডিজিটালি প্রকাশ করতে হবে। এতে শুধু দেশ নয়, বিদেশেও আমাদের ভাষার বই পৌঁছাতে হবে। অন্য ভাষাভাষীর লোকজনও আমাদের বই পড়ে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রক্তের বিনিময়ে যে ভাষার অধিকার আদায় করেছি, তা এখন আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে। ’৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর যখন প্যারিসে বংলা ভাষার স্বীকৃতি পেলাম তখন সেখানে মাতৃভাষার ইনস্টিটিউট করে দিতে চাইলাম। কাজও শুরু করি । কিন্তু ২০০১ সালে অন্য সরকারে এসে সেই কাজ বন্ধ করে দেয়। তারপর দ্বিতীয়বার আমরা সরকারে এসে এটির প্রতিষ্ঠা এবং উদ্বোধন করি। এখন সেখানে সারাবিশ্বের বিভিন্ন মাতৃভাষার গবেষণা ও চর্চা হচ্ছে।’

বাংলা একাডেমি অনেক আন্দোলনের সূতিকাগার মন্তব্য করে সরকার প্রধান বলেন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীনতা এসেছে। জাতির পিতা ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুসরণ করে জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাবার পথ অনুসরণ করে এ পর্যন্ত যত ভাষণ দিয়েছি তা বাংলা ভাষায় অন্তত ১৯-২০ বার হবে। বইমেলা উদ্বোধনের আগে ১৬ বিশিষ্টজনের হাতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার তুলে দেন শেখ হাসিনা। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১১টি ক্যাটাগরিতে ১৬ বিশিষ্টজনকে এই পুরস্কার দেওয়া হয় যেমন কবিতায় শামীম আজাদ, কথাসাহিত্যে নূরুদ্দিন জাহাঙ্গীর ও সালমা বাণী, প্রবন্ধ-গবেষণায় জুলফিকার মতিন, অনুবাদে সালেহা চৌধুরী, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে (যাত্রা, পালা নাটক, সাহিত্যনির্ভর আর্টফিল্ম বা নান্দনিক চলচ্চিত্র) মৃত্তিকা চাকমা ও মাসুদ পথিক, শিশুসাহিত্যে তপংকর চক্রবর্তী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় আফরোজা পারভীন ও আসাদুজ্জামান আসাদ, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল ও মো. মজিবুর রহমান, বিজ্ঞান-কল্পবিজ্ঞান-পরিবেশবিজ্ঞানে ইনাম আল হক, আত্মজীবনী-স্মৃতিকথা-ভ্রমণকাহিনী-মুক্তগদ্যে ইসহাক খান এবং ফোকলোরে তপন বাগচী ও সুমনকুমার দাশ। এছাড়া বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘কালেক্টেড ওয়ার্কস অব শেখ মুজিবুর রহমান: ভলিউম-২’সহ কয়েকটি নতুন গ্রন্থ উন্মোচণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

একুশের ভাষা আন্দোলন আমাদের শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ যা প্রতি বছর কালের বৈচিত্রে শীত-বসন্তে আমাদের কাছে উপস্থিত হয় বহুমাত্রিকতায় যাকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন প্রাণের মেলা । ১৯৭২ সালে ৮ ই ফেব্রুয়ারী চিত্ত রন্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধমান হাউজ এলাকায় বই মেলার উদ্ভোদন করেছিলেন। তারপর ১৯৭৮ সন থেকে ধারাবাহিকভাবে এই বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে । এবারের বইমেলার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘পড়বো বই, গড়বো দেশ: বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’ বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উদ্বোধন হতে যাওয়া মাসব্যাপী বইমেলায় এবার ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠান ১৭৩টি ইউনিট এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠান ৭৬৪টি ইউনিট বরাদ্দ পেয়েছে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৩৬টি প্যাভিলিয়ন থাকছে। কয়েক বছর ধরে মেলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছিল বিভিন্ন ইভেন্ট ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান। এবার বাংলা একাডেমি নিজেই বইমেলার সার্বিক আয়োজনের দায়িত্বে থাকছে। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলবে বইমেলা। তবে রাত সাড়ে ৮টার পর কেউ বাইরে থেকে মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে পারবে না। ছুটির দিন বইমেলা চলবে সকাল ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। আর শহীদ দিবস ২১ফেব্রুয়ারীতে মেলা শুরু হবে সকাল ৮টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। এ ছাড়া প্রতি শুক্র ও শনিবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত থাকবে ‘শিশুপ্রহর । মেলায সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মাসব্যাপী সেমিনারের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের জন্য ছবি আঁকা, সংগীত ও আবৃত্তি প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকবে। এবারের গ্রন্থমেলায় বাংলা একাডেমি প্রকাশ করছে নতুন ও পুনর্মুদ্রিত ১০০ বই। বইমেলায় অংশগ্রহণকারী সব প্রতিষ্ঠান ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। বাংলা একাডেমির ৩টি প্যাভিলিয়ন এবং শিশুকিশোর উপযোগী প্রকাশনার বিপণনের জন্য ১টি স্টল থাকছে। বইমেলার সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে বাংলাদেশ পুলিশ, র‌্যাব, আনসার ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। নিরাপত্তার জন্য মেলায় তিন শতাধিক ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার ব্যবস্থা রয়েছে।

দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতই অনেক সাহিত্যিকই মনে করেন বই মেলা শুধু কেনা বেচা নয় এর সংগে জড়িত রয়েছে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, গণতন্ত্রের আন্দোলন, জাতীয়তাবাদীর চিন্তা চেতনার প্রকাশ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এই গ্রন্থমেলার সংগে জড়িত আছে সংস্থা হিসাবে বাংলা একাডেমী, বই প্রকাশক সংস্থা, বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী সংস্থার বই স্টলে, লেখক ও অগণীত পাঠক । এই সকল অংশীদারদের নিজস্ব একটা ব্যবসায়িক দিক রয়েছে শিল্প সংস্কৃতি চর্চার অন্তরালে। বাংলা একাডেমী তাদের আয়োজনের অংশ হিসাবে যে স্টল বরাদ্দ দিয়ে থাকে সেখান থেকে একটি মোট অংকের টাকা রাজস্ব আসে। আবার যারা স্টল বরাদ্দ নিয়ে তাদের বই প্রদর্শনের আয়োজন করে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে যার মধ্যে রয়েছে পূর্বে আলোচিত প্রকাশক, লেখক, ব্যবসায়ী যাদেরও দিন শেষে আয়-ব্যয়ের একটি হিসাব রাখতে হয় এই মেলাকে ঘিরে।এই বই মেলা নতুন কর্মসংন্থান সৃষ্ঠি করে যার সাথে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা জরিত তথা বেকারত্বের অবসান ঘটায়। সেই হিসাবে একুশে বই মেলা বই বিক্রেতা, প্রকাশক,ছাপাখানা,বই বাইন্ডিংইত্যাদি খাতের সাথে জরিতেদেরও কর্মসংন্থান সৃষ্ঠিতে সহায়তা করে।এই দিক থেকে ভাষার মাসের গুরুত্ব অপরিসীম যেমন বিগ্যাপন ব্যবসা, দৈনিক পত্রিকা থেকে শুরু কওে অনলাইন নিউজ পোষ্ঠ্ও ও বই মেলা কেন্দ্রিক বুলেটিন ছাপানো হয় কোটি কোটি টাকার বিঙ্গাপন।এ ক্ষেত্রে দেখা যায় পণ্য হিসাবে বই ক্রেতার বহুরুপিতা যেমন কেহ ছাত্র-ছাত্রী ,কেহ গবেষক, কেহ সৌখিন ক্রেতা, কেহ আবার কবি সাহিত্যিক, কেহ আবার শিশু শ্রেণির এবং কেহ আবার প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধি যারা নিজের প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগারকে সমৃদ্ধ করার জন্য ক্রেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়।একটি তথ্যে দেখা যায়যে ২০২৩ সালের বই মেরায় ১০০ কোটি টাকার উপরে বই বিক্রি হয়েছিল এবং বর্তমান বছরে এই অংকটি আরও বাড়তে পারে বলে মনে হয় বিশেষত; আমাদের মত বই পাঠের চর্চবিমুখ মানুষের দেশে। সেই বইগুলো বইপ্রেমিক মানুষের বাসার সৌন্দর্য বর্ধনের উপকরনও বটে যা বই মেলারই অবদান। কারন বইয়ের ছেয়ে সুন্দর কিছু আছে বলে মনে হয় না যা প্রতিটি সৃজনশীল সংস্কৃতিমনা মানুষই বুঝেন। তারা বৎসরের এই ক্ষণটির দিকে তাকিয়ে থাকে কখন ফেব্যুয়ারী মাস আসবে আর প্রকাশনা সংস্থা তথা মুদ্রণ কর্মীরা তাদের বিনিদ্র রজনী কাটাবে মেলা শুরু হওয়ার আগে থেকেই নূতন বই মুদ্রণের প্রয়াসে যা প্রকাশনা শিল্পের জন্য একটি আলোকিত দিক। প্রতিদিনই মেলায় নূতন বই আসছে যা মেলার নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে প্রচার করা হয়ে থাকে এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা তাদের বিধিবদ্ধ দায়িত্বের অংশ হিসাবে বিশেষ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তাদের নির্ধারিত চ্যানেলগুলোতে সংবাদের অংশ হিসাবে প্রচার করছে প্রতিনিয়ত। এই ভাষার মাস ফেব্যুয়ারী এবং এই একি মাসের ২১ তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি বৈদেশিক অঙ্গনে অনেক প্রসারিত হয়েছে।

তবে আয়োজক সংস্থা বাংলা একাডেমী একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান হলেও তাদেরকেও অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই মেলার আয়োজন করতে হয় বিশেষত: দেশের সাবির্ক রাজনৈতিক পরিস্থিতি সহ নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। কারণ অতীতের অনেক জীবন হানির ঘটনা এই মেলাকে কেন্দ্র করেই সংগটিত হয়েছে যা আমাদের একুশের চেতনাকে বিনষ্ঠ করেছে। মুক্তবুদ্ধির চর্চা, সৃজনশীলতা প্রকাশনার চর্চা, সৃজনশীল সাহিত্য ইত্যাদি অনেকক্ষেত্র এই মেলায় আগত কবি সাহিত্যিক দর্শনার্থীদের জীবনের ঝুকি যে বাড়িয়ে দেয় তা আমাদের মনে রাখতে হবে অতীতির ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। তাই আমাদের মতাদর্শগত বিরোধগুলো রাজনৈতিক ভাবেই মোকাবেলা করতে হবে, গ্রন্থমেলা কোনভাবেই তার ক্ষেত্র হতে পারে না বা ক্ষেত্র হতে দেয়া যায় না। তাহলে ঘোষিত প্রাণের মেলা কথাটির কোন গুরুত্বই থাকে না যদিও এর মধ্যে অনেক আবেগ রয়েছে যা দিয়ে সত্যিকার অর্থে জীবন চলে না। এখন যারা সাধারন মানুষ কিংবা ছাত্র-ছাত্রী তাদের কাছে এই সকল কথার অর্থ নিরর্থক বলে মনে হতেই পারে। তার পরেও এবারের সংসদ নির্বাচনে ইশতেহারের স্লোগান দেওয়া হয়ে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ:উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান।,আর এবারও বিগত ইশতেহার গুলোর ধারাবাহিকতায় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ অর্থাৎ ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’ গড়ার কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে নলেজ ভিত্তিক সমাজ স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার একটি নিয়ামক এবং একুশের বই মেলা তার সহযাত্রী।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সাবেক ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি

সারাবাংলা/এজেডএস

ড. মিহির কুমার রায় স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ভাষার মাসে বইমেলার গুরুত্ব


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর