Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একুশের বইমেলা কি আদো প্রাণের কথা বলে

ড. মিহির কুমার রায়
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:২০

প্রিয়জনকে বই উপহার দিন, কারণ বই জ্ঞানের প্রতীক, বই আনন্দের প্রতীক এবং বই ভালোবাসার প্রতীক। শিশুকাল থেকে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। সাহিত্যচর্চাই পারে বিভ্রান্ত প্রজন্মকে বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনতে। বইয়ে যে আনন্দ অন্য কিছুতে তা নেই। বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। এই উক্তিগুলো আমার নিজের নয়, স্বয়ং বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রীর অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত দেশের সরকারপ্রধান থেকে আসা একটি বাণী নিশ্চয়ই জাতির কাছে অনেক অর্থবহ বলে বিবেচিত।

বিজ্ঞাপন

একটি সময় ছিল বই উপহারের তালিকায় প্রথম স্থান অধিকারী অর্থাৎ জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় বইই একমাত্র জীবন সাথী যার বিকল্পকিছু ছিল বলে মনে পড়ে না। কারণ মানবদেহের যে মনোজগৎ তার প্রধান খাদ্য হলো বই থেকে আহরিত জ্ঞান যা একজনকে আলোকিত করে, উজ্জীবিত করে এবং বস্তুকেন্দ্রিক জীবন বোধ থেকে বের করে নিয়ে আসে মেলায় যারা এসে অনেকে বই কেনেন। এর প্রভাব পড়ে মেলায় আগত মানুষের ওপর। যে কোনো মেলায় সমবেত হওয়ার মননগত প্রবণতা আছে বাঙালির। মেলায় মিলিত হওয়ার যে আনন্দ তা অন্যত্র পাওয়া যায় না। বইমেলায় বই কেনার গরজেই শুধু মানুষ আসেন না, আসেন সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, উৎসবে মিলিত হওয়ার আনন্দে। তারপর বইও কেনেন। যারা মেলা থেকে বই কেনেন, তারা কেউ কেউ হয়তো কোনোদিনও বই বিপণিতে গিয়ে বই কিনতেন না। এটা বইমেলার গুরুত্ব।

বিজ্ঞাপন

বই পড়ার আনন্দ তীব্র। বই পড়ার মধ্যে আনন্দই পেতে চাই। আনন্দ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। বই পড়ায় নেশাও আছে। দুটো অভ্যাসেরই দরকার; বই পড়ার ও কেনার। বইয়ের জগৎ ভিন্ন এবং মানুষও ভিন্ন। এই ভিন্ন জগতে যারা বসবাস করে অর্থাৎ লেখক ও পাঠক উভয়েই নিজ নিজ অবস্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত: সমাজভিত্তিক জীবনের কাছে। যারা বইয়ের লেখক তাদের জীবন বোধ সমাজের আর দশটি মানুষের মতো নয় এবং তাদের সংখ্যাও সীমিত যদিও একটি বইকে সম্পূর্ণ করতে সময় চলে অফুরন্ত। কারণ বই হলো সমাজের প্রতিবিম্ব যার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন কিংবা সমাজের রূপান্তর দৃশ্যত চোখে পড়ে। যে কাজটি সম্পন্ন করতে হয় একজন লেখককে অর্থাৎ একটি নতুন সৃষ্টি নিঃসন্দেহে একটি কঠিন অনুশীলন যার মাধ্যমে মানসিক প্রাপ্তি অফুরন্ত অর্থ প্রাপ্তির চেয়ে। কিন্তু তারপরও বই রচয়িতাকে বাঁচতে হয় পরিবার-পরিজন নিয়ে এই বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতা মূলক যুগে। বইয়ের লেখক ও পাঠকের সঙ্গে যোগ হন প্রকাশক যিনি বইকে নিয়ে যান অগণিত পাঠকের কাছে। প্রকাশনার মাধ্যমে সংগঠিত হয় বই মেলার আয়োজন বিশেষত একুশে ফেব্্রুয়ারিকে ঘিরে যাকে অনেকে বলে প্রাণের মেলা যার জন্য অধির আগ্রহে বসে থাকে সারা দেশের পাঠক সমাজ।

সময়ের আবর্তে এই বইমেলায় স্টলের আধিক্য বেড়েছে বাংলা একাডেমির গতি পেরিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত। প্রতিদিনই নতুন বইমেলায় আসছে বিভিন্ন শাখায় যেমন উপন্যাস, গল্প, শিশু সাহিত্য, কবিতা, রম্য রচনা, ভ্রমণ কাহিনী ইত্যাদি যা তথ্য কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হচ্ছে নিয়মিতভাবে। আবার বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কর্মীরা লেখক, দর্শক, কবি সবারই সাক্ষাৎকার নিয়ে ব্যস্তি রয়েছেন এবং নিরাপত্তার চাদরে বেষ্টিত মেলা প্রাঙ্গণ অনেকের কাছে বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে যা মুক্তবুদ্ধি বিকাশের পথে অন্তরায়। প্রতিদিনই বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে টক শো চলছে এই বইমেলার বিভিন্ন নান্দনিক ও মানবিক দিক নিয়ে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন বইমেলা প্রাণের মেলা থেকে সরে আসছে কিনা? কারণ কবি সাহিত্যিকদের আড্ডা দেয়ার সে জায়গাটি তা অনেকাংশে সংকুচিত হয়ে আসছে নিরাপত্তাজনিত কারণে। আবার যারা প্রতিষ্ঠিত বয়োজ্যেষ্ঠ কবি ও সাহিত্যিক তাদের আগেকার মতো মুক্ত হাওয়ায় পদচারণার উৎসাহটি আর চোখে পড়ে না। অনেকেই বলছেন, বই প্রকাশের ওপর নজরদারি ও পুলিশি তৎপরতা অনেকাংশে এই সার্বিক পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে প্রতীয়মান। আর যারা আয়োজক বিশেষত সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি অনেক ক্ষেত্রে তার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে রাজনীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের কাছে। যার ফলে প্রাণের মেলা প্রাণহীন হতে বসেছে অথচ সুধীজন বলছেন বইমেলায় উপস্থাপিত এক একটি বই হলো মনের জানালা।

তবে কেন প্রকাশকদের ওপর এত নজরদারি, আবার কেনই বা বই বাজেয়াপ্ত হওয়ার আতঙ্কে প্রকাশকরা ভীতস্ভ্রস্থ? এই প্রশ্নগুলোর জবাব এককথায় সম্ভব নয় কারণ পরিস্থিতি এক দিনে সৃষ্টি হয়নি আর সীমাবদ্ধতা অনেক ক্ষেত্র রয়েছেই। ভালো সাহিত্য কিংবা জনপ্রিয় সাহিত্য অথবা ভালো বই কিংবা জনপ্রিয় বই এক কথা নয়। এখন অনেক লেখক কবিতা কিংবা উপন্যাস কিংবা ছড়া লিখে চলছেন এই আশায় যে তিনি একুশে বইমেলায় একটি বিশাল প্রচার পাবেন অর্থাৎ বইমেলার লেখক কিংবা কবি সৃষ্টিতে একটি অবদান রয়েছে সত্যি কিংবা মান নিয়ে বড় আশঙ্কায় সাহিত্য সমালোচক সমাজ যা ক্রম অবনতিশীল। তাই এই ধরনের বই ও বইয়ের মেলা আমাদের সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে কতটুকু ভূমিকা রাখছে বা রাখবে আগামী দিনগুলোতে? বিজ্ঞজনরা বলছেন- যে দিন যাচ্ছে তা ভালোই যাচ্ছে আর যে দিন আসছে তা আর আগের মতো নয় যা জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

সমসাময়িককালে কবিতা ও উপন্যাসের খুব আকাল যাচ্ছে। কারণ নতুন লেখক তৈরির যে পারিপার্শ্বিকতা তা কোনোভাবেই অনুকূলে নয়, আর ডিজিটাল পদ্ধতি এসে এখন মানুষ কাগজ-কলম থেকে দূরে সরে গেছে যা সৃজনশীল চিন্তার পথে অন্তরায়। আর সমাজের সর্বস্থরের অস্থিরতা বিশেষত: সৃজনশীল কর্মকান্ডের পথে অন্তরায় বিধায়, ‘ত্যাগেই শান্তি ভোগে নয়,’ এই বাণীটি এখন কঠোর বা¯স্ততার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংঘাতটি এখানেই এবং যারা এতে আত্মসমর্পণ করে তাদের পক্ষে সাহিত্য সৃষ্টি কোনোভাবেই সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ এটি ভার ও ভাবনার বিষয় যার সঙ্গে পারিপার্শ্বিকতার বিষয়টি জড়িত অর্থাৎ কবি সাহিত্যিকদের মনে যখন ভাবের বন্যার সৃষ্টি হয় কিংবা ভাব যেখানে ভাষায় রূপান্তরিত হয় সেখানেই সৃষ্টি হয় সাহিত্য অর্থাৎ সাহিত্য হলো ভাবের আরশি। এই ভাবনার জায়গাটিতে যে যত বেশি পারদর্শী সে সাহিত্য সৃষ্টিতে তত বেশি সফল যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রকাশনার মাধ্যমে যার একটি ব্যবসায়িক দিকও রয়েছে। কারণ প্রকাশনায় বিনিয়োগ ও তার থেকে মুনাফা যদি না হয় তবে প্রকাশনা শিল্প গড়ে উঠবে কী করে? আবার কেউ কেউ বলে বইমেলা এখন বই ক্রয়-বিক্রয়ের মেলায় পরিণত হয়েছে আর মিলন মেলা কিংবা প্রাণের মেলা ধীরে ধীরে নির্বাসনের দিকে এগোচ্ছে।

এখন অনেকেই এই একুশের বইমেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন এর গুণগত অবস্থানের পরিবর্তনের কারণে এবং এই পরিস্থিতির জন্য অনেকেই উদ্যোগী সংস্থার নীতিমালাকে দায়ী করছেন। তবে আমরা যদি আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ায় অঙ্গীকারবদ্ধ হই তবে এ ধরনের বিষয় পরিহার করা বাঞ্ছনীয়। তবে বিষয়টি এত সহজ নয়।তবে ভাষা আন্দোলনের মাসের বইমেলার একটি আবেগের দিক রয়েছে সত্যি কিন্তু এক বছরান্তে কতই বা সৃষ্টিশীল কাজ জাতীয় সন্তানদের কাছ থেকে আশা করে। কারণ সাহিত্যের মূল উপাদান প্রকৃতি এবং এই ক্ষেত্রটি সেখানে বিধ্বস্থ হয়ে পড়েছে। তা হলে লেখক, গবেষক ও কবির আশ্রয়স্থল কোনটি যার সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক নিবিড়। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের আবার নতুন করে ভাবতে হবে বই, বইমেলা, প্রাণের মেলা প্রভৃতি বিষয়গুলোকে নিয়ে।

বই মেলার মূল আকর্ষণ বই যা প্রকাশনা সংস্থা কর্তৃক মেলায় উপস্থাপিত এবং এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থা রয়েছে। প্রায়শই দেখা যায় সরকারি প্রকাশনা সংস্থা বিশেষত গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের বই বা প্রকাশনাগুলো অনেক পুরাতন অর্থাৎ বই লেখা ও প্রকাশের গতিধারা অনেকাংশে সীমিত হয়ে গেছে আর যেগুলো ব্যক্তি মালিকানায় প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তাদের সংখ্যা ও মান উভয় ক্ষেত্রেই বিপর্যয় পরিলক্ষিত। অর্থাৎ বই লেখা ও প্রকাশনা উভয় ক্ষেত্রেই একটি সংকট বিদ্যমান। তাই বইমেলার আয়োজনকারীকে অনেক কুশলী হতে হবে যদিও স্টল বরাদ্দ ও বেশি গ্রাহকের আগমনের একটি ব্যবসায়িক দিক রয়েছে। বইমেলা প্রতি বছরই আসবে এবং এর গুণগত ও ব্যবসাগত মান ধরে রাখার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। কারণ এই মেলাটি আর দশটি মেলার মতো নয় যার সঙ্গে ভাষা আন্দোলনের আবেগ জড়িত। সর্বশেষে বলা যায়, বই হোক আমাদের জীবন সঙ্গী ও বইমেলা হোক তার চারণভূমি যার হাত ধরে সমাজ এগোবে ও জাতি পাবে তার স্বকীয়তা।

লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনিভার্সিটি

সারাবাংলা/এসবিডিই

একুশের বইমেলা কি আদো প্রাণের কথা বলে ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর