Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

একুশে বইমেলা: মিলনের সুর বাজে বহু অন্তরে

নাহার কবির
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:০১

আজ মন হারিয়ে যায়
ফাগুন হাওয়ায়,
প্রাণ হারিয়ে যায় সুরে;
আমার মনের মাঝে
মাদল বাজে,
হারায় সুদূর পানে,
আহা, আমার মন যে কেমন করে!

বাঙালির জীবনে ফেব্রুয়ারি শুধু একটি মাস নয় বরং ফেব্রুয়ারি হলো ইতিহাস, উৎসব, রঙ, ঋতু বৈচিত্র্যের এক মহাসম্মিলন। ফেব্রুয়ারি মাসেই দেখা মেলে ফাগুনের; লাল কৃষ্ণচূড়া দেখে মন জুড়ায়। এ মাসেই ডানা মেলে একুশে বইমেলা! এ যেন আমাদের আত্মার মেলা। এটি বাঙালির জীবনে শুধু উৎসব নয়, মনে হয় একটি সামাজিক মিলন মেলা।

অমর একুশে বইমেলার সামাজিক রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা বলে শেষ করার নয়। ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন, প্যারিস বইমেলার চেয়ে বাঙালির বইমেলার আবহ কিছুটা ভিন্ন। আমাদের একুশে বইমেলার সাথে জড়িয়ে আছে শহীদের রক্তে ভেজা অলংকৃত অনন্য এক ইতিহাস।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রফিক, সালাম, বরকত ও জব্বারের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। তাদের আত্মবিসর্জনকে সম্মান জানানোর জন্য তাইতো বইমেলার নাম হয়েছে একুশে বইমেলা। আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলা আয়োজনের মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গনে একুশে বইমেলার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১৯৮৪ সালে এই বইমেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অমর একুশে বইমেলা নামকরণ করা হয়। ঢাকার বাইরে বাড়ি হওয়ায় শৈশবে বাবা, চাচা কিংবা মামা-কারো হাত ধরে একুশে বইমেলাতে কখনো আসা হয়নি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত সেই ঘাটতি পূরণ করার জন্য বইমেলাতে যাওয়ার সুযোগ কখনো হাতছাড়া করিনি।

২০০০ সালে একুশে বইমেলায় আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। আমি এবং আমার বন্ধুরা বলতে গেলে প্রতিদিন বইমেলাতে যেতাম। তখনো মেলার স্টল গুলোর রঙ, নির্মাণ, নকশা বৈচিত্র্যে মন কাড়তো। এখনকার মত তখনো বইমেলায় বিশেষ বিশেষ স্টলগুলোতে লম্বা লাইন লেগেই থাকতো। এক্ষেত্রে চোখে পড়ার মতো ছিল অন্য প্রকাশনী। এটির আকার ও ডিজাইন অন্য স্টলগুলোর চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ছিলো। সেখানে হুমায়ূন আহমেদের বই কেনা এবং তার অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য লাইন লেগেই থাকতো। ব্যক্তিগতভাবে আমি হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের প্রেমে পড়ায় অন্য প্রকাশনীর দিকে যাওয়ার সাহস পেতাম না। উল্লেখ করা দরকার সেবা প্রকাশনীর স্টলের সামনেও বিশাল লাইন থাকতো। সেজন্য বইমেলার প্রথমদিকেই আমি তাদের বুক লিস্টটা সংগ্রহ করে নিতাম। এরপর আমার যে বইগুলো দরকার সেগুলো মার্ক করে রাখতাম। যেদিন স্টলগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম ভিড় থাকতো সেদিন লিস্ট করা বইগুলো আনতে যেতাম। বই সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে আমার পছন্দের প্রথমেই থাকতো কবিতার বই। এছাড়া হুমায়ূন আহমেদ, আনিসুল হক, হুমায়ূন আজাদ-এর লেখা নতুন পুরাতন গল্প উপন্যাসও লুফে নিতাম। বইমেলাতে কবিতার কার্ড বইগুলো আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হতো। বিভিন্ন স্টল ঘুরে ঘুরে কবিতার কার্ড সংগ্রহ করতে আমার অনেক ভালো লাগতো। বলতে দ্বিধা নেই বিভিন্ন বিদেশি লেখকের অনুবাদ গ্রন্থগুলোও সংগ্রহ করতাম। নতুন লেখকদের মধ্যে বড় কবি সাহিত্যিকদের আড্ডায় তখনও অটোগ্রাফ প্রত্যাশীদের এখনকার মতো ভীড় থাকতো। মনে হতো এই বই মেলা যেন লেখক,পাঠক ও দর্শনার্থীদের সংযোগ মেলা। অঞ্জন দত্ত তার গানে যেমন বলেছিলেন – ‘ভালোবাসা মানে আর্চিস গ্যালারি’। আমার কাছেও তেমনি ফেব্রুয়ারি মানেই একুশে বইমেলা। একুশের বইমেলা আমার কাছে তারুণ্যের বিশাল উন্মাদনা, শাড়ি চুড়ির রিনিঝিনি, ফুচকা, চটপটি, চায়ের আড্ডা হাওয়াই মিঠাই-এর নানা রং আর টিএসসির সামনে হট্টগোল।

সময়ের সাথে সাথে বইমেলার কলেবর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেখানে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন; সেখানে রয়েছে স্বাধীনতা স্তম্ভ এবং শিখা চিরন্তন। ২০১৪ সালে বাংলা একাডেমি একুশে বইমেলার বড় একটি অংশকে সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। এর ফলে একুশে বইমেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শিকড় আরো গভীরতর হয়েছে।

১৯৭২ সালে যে বইমেলা গুটি কয়েক গ্রন্থ নিয়ে পথ চলা শুরু করেছিল আজ তা এক মহীরুহের রূপ ধারণ করেছে। প্রতিবছর বইমেলায় গড়ে চার-পাঁচ হাজার বই প্রকাশিত হয়। বলা হচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম পুস্তক বিমুখ হয়ে পড়েছে। আমি মনে করি একুশে বইমেলা তরুণ প্রজন্মের কাছে বই পড়ার উপলক্ষ্য তৈরি করেছে।বইমেলায় ঘুরে ঘুরে এত কাছ থেকে হাজার হাজার বই দেখার সুযোগ আমাদেরকে এই বইমেলাই সুযোগ করে দিয়েছে। আগের মত বইমেলাতে গিয়ে আমরা হয়তো হুমায়ূন আহমেদের জন্য লম্বা লাইনের উপস্থিতি দেখতে পাইনা, কিন্তু এখনও অনেক নতুন কবি সাহিত্যিক আছেন যারা নিজেদের লেখা দিয়ে তরুণদের মন জয় করে নিয়েছেন।

এই সময়ের সাদাত হোসাইন এর বই কেনার জন্য কিংবা অটোগ্রাফের জন্য বিশাল লাইন চোখে পড়ে। আসলে কোন শূন্যস্থানই ফাঁকা থাকে না; নতুনেরা তা পূর্ণ করে দেয়। আগের সোনালি দিন গুলোর মত এখনও শিশু, তরুণ, বৃদ্ধ নির্বিশেষে বই মেলার উৎসবের আমেজে মেতে উঠেন। এমনকি দেশের বাইরে থেকেও অনেক লেখক সাহিত্যিক বইমেলাতে আসেন। পূর্বেও সকল বয়সী, বিভিন্ন পেশাজীবীদের বইমেলাতে অতি আগ্রহের সাথে বিচরণ করতে দেখেছি; আমি অবাক হয়ে এখনও তাদের প্রাণের স্পন্দন দেখি।

‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’- প্রকৃত অর্থে একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন বাঙালির মননে রক্তে মিশে আছে তেমনি একুশে বইমেলাও বাঙালির সংস্কৃতিতে জুড়ে আছে। নিঃসংকোচে বলা যায় অমর একুশে বইমেলা আমাদের একটি সাংস্কৃতিক উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়ে গেছে।

লেখক: শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

একুশে বইমেলা: মিলনের সুর বাজে বহু অন্তরে নাহার কবির মুক্তমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর