একুশের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:২০
ঢাকার বসুন্ধরার সিনেপ্লেক্সে ভারত বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনার ভারতীয় চলচিত্রকার গৌতম ঘোষ পরিচালিত চলচিত্র ‘শঙ্কচীল’ দেখে মনে হলো ১৯৪৭-এর দেশ বিভক্তি এই উপমহাদেশের মানচিত্রটাকে পরিবর্তন করে দিয়েছে এক বৃটিশ প্রশাসকের কলমের খোচায়। যার ফলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে/ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ঠি হলো পাকিস্তান ও হিন্দুস্থান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রের। আরও মজার ব্যাপার হলো অভিবক্ত বাংলার একটি অংশকে জুড়ে দেয়া হল পাকিস্তানের সঙ্গে যা পূর্বপাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) নামে পরিচিত ছিল যারা ভাষা/সংস্কৃতিতে খাটি বাঙ্গালী ও বাংলা তাদের মায়ের ভাষা। দেশ ভাগের অব্যবহিত সময় থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে নানাভাবে বঞ্চিত করতে থাকে এবং সে বঞ্চনা থেকে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে বাঙালী জাতি। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ক্ষোভের বহির্প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠার দাবি থেকে আর সে লেপনে প্রথম পদচিহ্ন আঁকা হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়ার প্রাণ পুরুষ আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবলমাত্র কৈশোর কাটিয়ে যৌবনে পদার্পন করেছেন এবং মাত্র ১৪ বছর বয়সে ব্রিটিশ বিরোধী সমাবেশে অংশ নেন ও গবীব ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়ার খরচ মেটানোর জন্য মুসলিম সেবা সমিতি গঠন করেন।
১৯৩৮ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্র্দীর সাথে পরিচয় ঘটে বঙ্গবন্ধু এবং প্রথম পরিচয়েই তিনি তাদের দৃষ্ঠি আকর্ষন করতে সমর্থ হন। ১৯৪০ সালে শেখ মুজিব নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদান করেন এবং এক বছরের জন্য বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিল নির্বাচিত হন। তাঁকে গোপালগঞ্জ মুসলিম ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। আস্তে আস্তে এ সময়ে বঙ্গবন্ধু রাজনীতির মধ্যে প্রবেশ করেন ১৯৪৬ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সাধারন সম্পাদক পদে তিনি নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন া তখনই তিনি বুঝতে পেডেছিলেন বৃটিশদের থেকে মুক্তি পেলেও নূতন করে আবার পশ্চিম পাকি¯’ানের শোষনের কবলে পড়েছে দেশ। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে তখন এক স¤েœলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেনন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলনে প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন-আদালনের ভাষা করা হউক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের উপর ছাড়িয়া দেওয়া হউক এবং জনগণের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হউক।’ তা থেকেই বুঝা যায় বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এবং বাংলা ভাষাকে সর্বত্র প্রচলনের জন্য কতটুকু স্বোচ্চার ছিলেন।
১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের গণপরিষদে খাজা নাজিমুদ্দিন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রস্তাব তুলে ধরেন। আবার একি সময়ে ২১ শে মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পিিকস্তানের জাতীর পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোসনা দিলেন উর্ধু ও উর্ধুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ঠ্র ভাষা। তৎসাপেক্ষে সে সময়কার গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছিলেন, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে চার কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। কাজেই বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা ঘোষণা করা উচিত। এদিকে, এই ঘোষণার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পূর্ব পাকিস্তানের স্কুল-কলেজে ধর্মঘটের আহবান জানায়। নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার প্রতিবাদে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রতিবাদের হুঙ্কার পরিলক্ষিত হতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ৪ মার্চ। সেদিন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে লিফলেট বিলি করা হয়। সেই লিফলেটের অন্যতম স্বাক্ষরদাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ধর্মঘটের সমর্থনে জনমত গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিব বিভিন্ন জেলায় ছাত্রসভা করেন। ঢাকায় ফিরে ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে এক সভায় ১১ মার্চের হরতালের কর্মসূচীতে কারা, কোথায় ও কিভাবে দায়িত্ব পালন করবেন তা ঠিক করে দেন।
১৯৪৮ সালে ১১ই মার্চ শেখ মুজিব সচিবালয়ের গেইট থেকে গ্রেফতার হন অর্থ্যাৎ পাকিস্তান কায়েমের ৮ মাসের মধ্যেই তিনি কারা বরন করেন া ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকার কারণে ১৯৪৯ সালে দু’বার গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু এবং ১৯৪৯ সালে ১৭ই এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য়/৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয় কিন্তু এ ব্যাপারটি নিয়ে তিনি কোন প্রকার আপোসে যাননি এবং ভাষার দাবিতে সারাদেশে যখন আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিছল তখন বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের জানুয়রি মাসে আটকাবস্তায় হাসপাতাল থেকে অন্য ছাত্রনেতাদের সাথে গোপনে বৈঠক করে একুশে ফেব্রুয়ারী রাষ্ঠ্র ভাষা দিবস পালন ও সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের রক্তের বিনিময়ে ভাষা আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতি লাভ করে এবং পূর্ব বাংলার সর্ব¯স্তরর মানুষের মনে এই আন্দোলন গভীর ছাপ ফেলে। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের পরে কারামুক্তি লাভ করেন বঙ্গবন্ধু। তার কিছ ুদিন পর বঙ্গবন্ধু পুর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন ৩৩ বছর বয়সে। প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ‘একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি কিছু কথা’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন: ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখ শেখ মুজিব ফরিদপুর জেলে যাবার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন।
১৯৫৩ সালের ১৪ই নভেম্বর আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ কাউন্সিলে যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন এবং ১৯৫৪ সালের ১০ই মার্চ যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। একি বছর ১৫ই মে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সমবায়, ঋন ও গ্রামীন পূণর্গঠন বিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং একি বছর ৩০ই মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার প্রাদেশিক যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে দিলে বঙ্গবন্ধু আবার কারা বরন করেন। ১৯৫৫ সালের ৫ই জুন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগের হয়ে গণপরিষদেও সদস্য নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তান গণপরিষদে ভাষন দান কালে পূর্ব পাকিস্তান নামের পরিবর্তন করে পূর্ববাংলা করার আহ্বান জানানা। এই ভাষনে আন্চলিক/স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানানো হয়। তারপর ১৯৫৬ সালে১৬ই সেপ্টেম্বর জোট সরকারের শিল্প-বানিজ্য-শ্রম মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পান এবং কিছুদিন পর দলের কাজের স্বা¯ের্’ মন্ত্রীর পদথেকে পদত্যাগ করেন। তারপর ১৯৫৮-৬৮ এই সময়টায় আাইযুব খানের আাইযুব বিরোধী আন্দোলন, মৌলিক গনতন্ত্রেও বিরোধিতা (১৯৬৪), লাহোরে ঐতিহাসিক ৬-দফা উত্থাপন (১৯৬৬),আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা ও পরবর্তিতে আসামীদেও মুক্তিদান (১৯৬৯), একি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারী রেসকোর্স ময়দানে লাখো ছাত্র জনতার সংবর্ধনায় শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে সম্মানিত করা, ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদেও ১১-দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন, ১৯৭০ এর নির্বাচনে নিরন্কুস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, ১৯৭১ এর স্বাধিনতা সংগ্রাম, ৯মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন এবং ১৯৭২র সালে ১০ই জানুয়ারী পাকিস্তান কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধ স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি সবই ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে।
বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের সর্বশেষ আন্দোলনের ফসল যদি হয় স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ তাহলে সংগ্রামের গোড়াপত্তন হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে প্রত্যেকটি আন্দোলনে বাঙালী জাতি একাট্টা হয়ে নিজেদের বেগবান করে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে সদলবলে। ।এখন ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রেুয়াররি আর ২০২১ সালের ২১শে ফেব্রেুয়াররি- এই প্রায় সাত দশকের পথ পরিক্রমায় আমরা কি চেয়েছি আর কি পেয়েছি এই প্রশ্নটি পর্যালোচনার/ আত্মউপলব্দির এটাই মূখ্য সময়। একুশ আমাদেও রাষ্ঠ্র দিয়েছে, আন্তর্জ্যাতিক মাতৃ ভাষা দিবস দিয়েছে,,২১ দফা দিয়েছে,,বাংলা একাডেমী দিয়েছে, শহীদ দিবস, মাতৃভ’মি/মাতৃভাষা নিয়ে গৌরব করার অধিকার দিয়েছে, আত্মউপলব্দির সুযোগ করে দিয়েছে সত্যি। কিন্তু প্রায় সত্তর বছরেও আমরা আমাদের রাষ্ঠ্রীয় কিংবা সমাজ জীবনে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন করতে পারিনি যদিও উচ্চ আদালতে ভাসার অবস্থান এখনও নিশ্চিত হয়নি। দেশের বেশীর ভাগ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা বিষয় হিসাবে পাঠদানে স্থান করতে পারেনি। অথচ এই বাংলা ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারী বাঙ্গালেিক রক্ত দিতে হয়েছিল যা বৃথা যায় নি কারন এর ভিতর দিয়ে আমরা আমাদের জাতীয় সত্বাকে খুজে পেয়েছি যা আমরা পরাধীনতার শৃঙ্কলে হাড়িয়ে ফেলেছিলাম দীর্ধ সময় ধরে।
আরও গৌরবের বিষয় যে ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জ্যাতিক মাতৃ ভাষা দিবস হিসাবে স্বিকৃতি দিযেছে এবং বিশ্বের বাংলা ভাষাভাসী নাগরিকরা তাদের আদলে শহীদ মিনার তেরী করের ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। একুশ আমাদের সংস্কৃতির অংশ-কি গাণে, কবিতায়, নাটকে, চলচ্চিত্রে এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী বিরচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুলে ফেব্রুয়ারি, আমরা কি ভ’লিতে পারি গানটি আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে হ্রদয় পটে। প্রখ্যাত শহীদ চলচ্চিত্রকার জহীর রায়হান এর কালজয়ি উপন্যাশ আরেক ফাগুন ও জীবন থেকে নেয়া এখনও কিংবদন্তী হয়ে বেঁচে থাকবে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে আর বাঙ্গালী থাকবে। একুশ আমাদের স্বাধীন বাংরাদেশের জন্ম দিয়েছে আর জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রথম সারীর সৈনিক। সমাজের সবস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রতিষ্ঠিত হউক আমাদের সকলের অঙ্গিকার।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
একুশের চেতনা মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত