বসন্ত বাতাসে ভালোবাসা উড়ে
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৫:৪৩
প্রতি বছর আমাদের জীবনে আটপৌরে ইমেজ ভেঙ্গে ভিন্ন আমেজ নিয়ে আবির্ভূত হয় বসন্তকাল। এর প্রেক্ষিত কি- তা গবেষণার বিষয়। তবে এর পেছনে মোটা দাগে সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানসিক ও ঋতুগত দিক যে ক্রিয়াশীল থাকে তা বলা যায়। বসন্তকাল আর ফেব্রুয়ারি মাস এখন জোটবদ্ধ হয়ে আরো জৌলুশপূর্ণ হয়েছে। কবে থেকে এই বসন্তবন্দনা চালু হয়েছে তা জানতে হলে ইতিহাস ও সাহিত্য নিয়ে নাড়াঘাঁটা করা প্রয়োজন। এ লেখার উদ্দেশ্য তা না।
বাঙ্গালি সমাজে স্বার্থকভাবে প্রথম বসন্ত আগমনীর তরঙ্গ প্রবাহিত করতে পেরেছিলেন কবি সুভাস মুখোপাধ্যায়। ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত – এই স্পষ্ট উচ্চারণে তিনিই প্রথম গতানুগতিক চিন্তাধারার সাথে চারিদিকের বাস্তবতার মেলবন্ধনে বাঙ্গালি সমাজকে উজ্জীবিত করতে চেয়েছিলেন। আর মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারি বাঙ্গালি সমাজের জন্য নিয়ে এসেছিলো লক্ষ্য অর্জনে রক্ত শপথ দৃঢ়তা। যার ফলে মাতৃভাষার অধিকার সমুন্নত রাখতে বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো আর বহু ত্যাগের বিনিময়ে তার ‘অধিকার-ঈপ্সা’কে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলো। ফলশ্রুতিতে মিলেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি আর বাঙ্গালির অমিত তেজ সম্মন্ধে বিশ্ব হয়েছে অবহিত । বসন্তকালে আমাদের দেহমন সতেজ আর ফুরফুরে থাকে। আমরা ফুলের মেলায় ও তার সৌরভে জীবনের অপার মাধুর্যতাকে উপভোগ করে থাকি। আর ফেব্রুয়ারিতে এসে আমরা নড়েচড়ে বসি। স্মৃতি তর্পণের সাথে সাথে আনন্দের আতিশয্যে কী থেকে কী করে বসি তা ঘূনাক্ষরেও দেখার চেষ্টা করি না। পার্বন ভিত্তিক বাঙ্গালি সমাজ জীবনে আমরা সনাতনী প্রথার সাথে আমদানি করে এনেছি আরো আরো উপকরণ ও জীবনাচার। যার চটকদারিত্বে আমরা আজ অনেকটাই বুঁদ হয়ে আছি। যেন এত ভাবাভাবির সময় নেই, দরকারও নেই।
বসন্ত কালে ফুল ফুটে আর প্রকৃৃতি তার বিভাস ছড়ায়। সুভাস মুখোপাধ্যায় বলুক আর না বলুক বসন্ত তার চিরকালীন স্বত্বা নিয়ে আমাদের জীবনে ফি বছর হাজির হবেই। নির্মল প্রাণের চিরচেনা আকুতির সাথে চারপাশের বাস্তবতার সম্মিলনে সংকীর্ণতা ও পঙ্কিলতাকে বিসর্জন দিয়ে বাঙ্গালি সমাজ নেচে উঠুক অদম্য শক্তি নিয়ে সম্ভবত এটাই ছিলো তার সেই বিখ্যাত চরণের চমক-মন্ত্র। তদ্রুপ একুশে ফেব্রুয়ারির অতুলনীয় ত্যাগ ও অনুপম অর্জন আমাদের স্বতন্ত্র স্বত্বাকে ঘুরে দাঁড়াবার প্রত্যয় যোগাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে; কালে কালে; এটাই ছিলো ফেব্রুয়ারির সুপ্ত দর্শন। কালের পরিক্রমায় আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির খেলায় বাস্তব চিত্র কিন্তু এখন ভিন্ন কথা বলছে।
বসন্ত নিয়ে আমাদের আবেগের, অনুভূতির কমতি নেই। এ সময় শরীর বৃত্তীয় ইন্দ্রানুভূতির তোড়ে দেহ-মন সতেজ হয়ে উঠে। ফুরফুরে আমেজ বোধ হয়। সর্বত্র ভালোলাগা – ভালোবাসার আবহ সৃষ্টি হয়। নতুনকে যেমন ভালো লাগে তেমনি পুরোনোকেও নতুন রূপে সাজাতে মন নেচে উঠে। বসন্তের এই পাগলপারা আবহাওয়ায় সমাজ তার অনুশাসনের সেকেলে চোখ রাঙ্গানি কিছুটা শিথিল করে রাখে। অর্থনীতি বাংলা নতুন বছরে প্রবেশের আশায় উন্মুখ হয়ে থাকে। এরই মধ্যে ভালোবাসা দিবসের আবিষ্কার ও ফি বছর তার আবির্ভাবে বাঙ্গালি সমাজ নেচে উঠে। ১৪ ফেব্রুয়ারী ভালোবাসা দিবসে তাই সর্বত্র ভালোবাসার ছড়াছড়ি। আতিশয্য প্রিয় বাঙ্গালি আটপৌরে জীবনাচারের আড়মোড়া ভেঙ্গে যেন জেগে উঠে। ভালোবাসার চিত্র এতটাই উৎকট হয়ে উঠে যা বসন্তকালীন সতেজতাকে ম্লান করে দিয়ে উৎকট প্রসাধনের কারুকাজকেই এখন প্রকট করে তুলছে। তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এই দিনের জন্য অপেক্ষা যেন জীবনের মোক্ষম প্রাপ্তির মত। ভালোবাসার মানুষের তালাশেও এই দিন কেউ কেউ হয়ে যায় পাগল- মাতাল। যার ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকে সে বুক চিতিয়ে হাটে। তার সুখের পোয়া বারো। আর যার নেই; তার জীবন যেন অমাবস্যার অন্ধকারে ঢাকা। কোথাও কোন আলো নেই। যেন কোন আশা নেই, ভালোবাসাও নেই।
বসন্তকাল আর ১৪ ফেব্রুয়ারি এই দুই মিলেমিশে আজ ভীষণ শক্তিশালী হয়ে আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠিত বাস্তব হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। বয়সের কোন প্রশ্ন নেই, সংকীর্ণতার কোন বাধা নেই। আনন্দের বাইরে যেন কিছু নেই। এই দিনের জন্য নতুন পোষাকের বাধ্যবাধকতা যেন স্বতঃস্ফূর্ত। খরচের হাত যেন প্রসারিত। আচরণের ব্যাকরণ যেন নিপাতনে সিদ্ধ’র মত বেপোরোয়া ও অবারিত। এসব নিয়ে লেখালেখি, আঁকাআঁকি, সামাজিক মাধ্যমের আদিখ্যেতা আর ট্রল কম হয় না। মিডিয়া জুড়ে কভারেজ থাকে ভীষণ রকম। চারিদিকে যেন ভালোবাসার ওপেন ডিসপ্লে। এর আগে পিছে যেন আর ভালোবাসাবাসির দরকার নেই। হলে ভালো, নাহলেও পরোয়া নেই।
দিবসের আতিশয্যে আমরা আজ ক্লান্ত; দিকভ্রান্ত। বিশেষ একটা দিনকে উদ্দেশ্য করে প্রচার- প্রসার যেখানে উদ্দীষ্ট সেখানে মহৎ কিছু অর্জনের মতো থাকে না। তাৎক্ষণিক প্রাপ্তিই মুখ্য হয়ে উঠে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি কোন উন্নয়ন অভীপ্সা নেই। আছে নগদ নারায়ন প্রত্যাশা। তাই আমাদের বড় মাপের অর্জন সীমিত হয়ে পড়েছে। নানাবিধ অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, হতাশা, নিপীড়নে উত্যক্ত বাঙ্গালি ভুলে গেছে সুখ আবার স্থায়ী হয় নাকি! সুখ পাখী বলে কিছু আছে নাকি? আমাদের কাছে তাই অতি প্রিয় কোকিল। যে কিনা বসন্তের কোকিল হিসেবেই সমধিক প্রসিদ্ধ। অথচ পরের গৃহে নিজ উত্তরাধিকার সমর্পণ করে দায়িত্ব থেকে খালাস পাওয়ার মতলববাজ এক চির বসন্তকালীন পাখী এই কোকিল। একেই আমরা আমাদের ভালোবাসার মধুর কলতানের প্রতীক করে নিয়েছি। ফলতঃ এই সব ভালোবাসাবাসি দিবস যতটা না প্রতীকী তার চেয়ে বেশি সাময়িক ইন্দ্রিয়সুখমুখী। এরমধ্যে ১৪ ফেব্রুয়ারি নিয়ে কথা উঠেছে। কথা সব কিছু নিয়েই উঠে। বাঙ্গালি কথা উঠাতে ওস্তাদ। কিন্তু উদ্দেশ্যহীন পথচলা যেমন সৌন্দর্যমণ্ডিত হয় না তেমনি আপামরের কাছে গ্রহণীয়-বরণীয়ও হয়ে উঠে না। ভালোবাসা দিবসের শুরুর দিকে এর যে বহুমাত্রিক সতেজতা, মানবিকতা, উদারতা ও দায়িত্ববোধের উদ্দেশ্য ছিলো এখন তা নির্জলা ভালোবাসাবাসির গিভ এন্ড টেক এর ঝলসানো মাংসের মত মাদকতাময় হয়ে উঠেছে। অথচ এর সপ্তাহ খানেক পরেই আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা দিবস, যা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃত। সেই দিনটি নিয়েও আমাদের নানারূপ আয়োজন আছে। প্রদর্শন আছে, অঙ্গীকার আছে, গলাবাজি আছে। কিন্তু তা ওইদিনের জন্যই। এরপরে সব আগের মতই। এই দিবসকে ঘিরে কথা ছিলো সর্বস্তরে চালু হবে মাতৃভাষা। এতে করে দেশপ্রেম গাঢ় হবে। বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের স্বতন্ত্র স্বত্বা বিশ্বে বীরের মত মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। অথচ আমরা হাঁটছি উল্টো পথে। মধ্যবিত্তের কাছে কথ্যভাষা হিসেবে বাংলা ঠিক আছে কিন্তু ডলার আর ইউরো অর্জনে তা মূল্যহীন। আভিজাত্যেও নিম্নমানেরর। উচ্চবিত্তের কাছে তা ম্লেচ্ছ বাঙ্গালির মত দুর্গন্ধযুক্ত। ঠিক যেন কবি ভবানী প্রসাদ মজুমদারের বিখ্যাত সেই কবিতার মত, “আমার ছেলে খুব ‘পজিটিভ’ অলীক স্বপ্নে ভাসে না/ জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না”। আর তাই আমাদের বাংলা, ইংরেজি কোনটাই এখন ঠিক মত আসে না। নিম্নবিত্তের এ নিয়ে কোন হা-হুতাশ নেই। কেননা, এক্ষেত্রে তাদের বিকল্প কোন সুযোগ নেই।
আজ বাংলা হয়ে গেছে ঐচ্ছিক। ইংরেজির দাপট আরো প্রবল হয়েছে। অথচ আমরা না বাংলাতে না ইংরেজিতে হয়েছি পটু। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করণের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকারি অফিসে তা করা হয় বাধ্যতামূলক। চাকরি হারাবার ভয়ে সরকারি চাকুরেরা তা অনুসরণে বাধ্য হোন। এতে করে অফিসে বাংলার বিস্তার ষোল আনা হয়েছে। কিন্তু সরকারি চাকুরেদের ইংরেজি দক্ষতা নেমে গেছে মারাত্মকভাবে। আমরা আজো বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ পর্যায়ে বাংলায় উন্নতমানের রেফারেন্স বুক অনুবাদ করতে পারিনি। উচ্চ আদালতেও এর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি। আমাদের এই এক দোষ। আমরা যখন যা করি তড়িঘড়ি করে করি, হিসেব-কিতাব না করেই করি। বাস্তবতার চেয়ে আবেগের বুঁদবুঁদ থাকে বেশি। সরকারি অফিসে বাংলা শতকরা একশতভাগ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আমরা ইংরেজিকে বিদায় করতে পেরেছি সত্য কিন্তু বাংলাতে উৎকর্ষতা অর্জন করতে পারি নি। এটাকে অন্যভাবেও করা যেতে পারত। সরকারি অভ্যন্তরীণ নথী ব্যবস্থাপনা ইংরেজিতে চালু রেখে যেটুকু সাধারণ জনগণ ও পাবলিক ডকুমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হবে তা বাংলায় করার বাধ্যবাধকতা থাকলে ভালো হত। এখন যেটি হয়েছে, সরকারি অফিসে ইংরেজিতে লেখা ও কথাবলার মত দক্ষ জনবলের সংখ্যা চরমভাবে হ্রাস পেয়েছে। আমাদের কর্মকর্তাদের আন্ত:দেশীয় যোগাযোগে দারুণ অধ:পাত হয়েছে। দ্বিপাক্ষিক আলাপচারিতায় চরম অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। ভবিষ্যতে এর উত্তরণের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
দেশে বাংলা স্কুলের চেয়ে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল পড়ুয়াদের কদর বেশি। এর ফলে গ্রাম পর্যায়েও প্রি-ক্যাডেট স্কুলের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াতে যাদের আর্থিক ঘাটতি রয়েছে তারা প্রথম বিকল্প হিসেবে বেছে নেন ইংলিশ ভার্সন স্কুল। কথগুলো বুদ্ধিজীবীদের কাছে অত্যন্ত আপত্তিকর ও দেশপ্রেম বিবর্জিত বলে মনে হতে পারে। আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এককালে আমাদের গর্বের ছিলেন। যা ইতিহাসের পাতায় লিখিত আছে, যা এখন যাদুঘরে সুরক্ষিত করে রাখার মত। বর্তমান বাস্তবতায় বাংলা নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের কোন মাথাব্যাথা নেই। সবারই পারিবারিক বলয় বিদেশ আর ইংরেজি নির্ভর হয়ে উঠছে। দেশান্তরি হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদেশের পালে হাওয়া লেগেছে। তাই বাংলাতে ফিরিয়া আর কি লাভ জাতীয় মৌনতাই নিরাপদ। দেশপ্রেম এখন দিবস উদযাপনে আর নির্বাচনের আগে মঞ্চ মাতানোতে সীমাবদ্ধ। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এখন উচ্চমানের কোন অনুশীলন নেই। আছে হাল্কা-চটুল আর বিদেশী বিষয়ের ছায়াকরণ।
বলছিলাম আমাদের জীবনে বসন্তকাল আর ফেব্রুয়ারী মাসের প্রভাব নিয়ে। বসন্ত মানেই ফুরফুরে আমেজ। সৌন্দর্য আর সৌভের মেলবন্ধন। ফেব্রুয়ারী মাস হলো ভালোবাসার আর বাংলা ভাষা প্রেমের প্রতীকী মাস। কর্পোরেট কালচারে বাণিজ্যের প্রভাব থাকবেই। কিন্তু জাতীয়তার; স্বকীয়তার ক্ষেত্রে আমাদের এই দিকভ্রান্তি আমাদেরকে মূল থেকে বহুদূরে নিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে গেছেও, এটাই চরম ও পরম বাস্তব। এরূপ লক্ষ্যহীণ যাত্রা থেকে মূল উদ্দেশ্যে একে পরিচালিত করতে পারে রাজনীতি আর সুশীল নামধারী সুখের পাখীরা। সেই সুখ পাখীদের প্রত্যাশায় জাতি। তাদের শীত নিদ্রা কবে ভাঙ্গে সেটাই দেখার বিষয়। বসন্তকালীন আমেজে অতিমাত্রায় বিভোর না হয়ে ফেব্রুয়ারির অপার শক্তিতে জাগ্রত হতে এখনই সময় সাদাকে সাদা বলার চর্চা শুরু করার। নয়ত ভালোবাসার তোড়ে পরকীয়ার বেশুমার আবাদে সয়লাব হয়ে যাবে সব। পরদেশ প্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। যা কিছু পরের তাতেই সুখবোধ জেঁকে বসবে। এমনিতেই বাংগালি সংকর জাতি। তার উপর ঢোলে বারি পড়লে হাইব্রিডে রুপান্তরিত হতে সময় নেবে না। সবার সুবোধ জাগ্রত হোক।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই