বইমেলাটাও কি নষ্টদের দখলে চলে গেল
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:৫৬
সবকিছু বুঝি নষ্টদের দখলে চলে গেল! আমরা যারা লেখালেখি কিংবা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত রয়েছি তাদের কাছে বইমেলা মানে প্রাণের মেলা, এক বিশেষ আবেগ ও গুরুত্বের জায়গা। জাতীয়ভাবে এ বইমেলার বিশেষ গুরুত্ব থাকলেও জাতি হিসেবে আমরা এ বইমেলার গুরুত্ব কতটুকু উপলব্ধি করতে পারি বা একুশকে কতটুকু ধারণ করতে পারি—সে প্রশ্ন না উঠে পারে না।
বইমেলা এখন আর বইমেলার জায়গায় নেই। বইমেলাটাও চলে গেল নষ্টদের দখলে! জাতি হিসেবে আমাদের আর বাকি রইলো কী? সম্প্রতি তিশা-মুশতাক, ডা. সাবরিনা ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সয়লাব। এর প্রভাব কিন্তু জাতীয়ভাবে পড়ছে—তাই না লিখে পারা গেল না।
তিশা-মুশতাকের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাদাছোড়াছুড়ি তথা তারা কে কাকে কত বছর বয়সে বিয়ে করেছে, সেটা আমার প্রশ্ন কিংবা লেখার বিষয়বস্তু নয়। আমার প্রশ্ন হলো, তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ের বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে সমাজকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছেন। যেটাকে নার্সিসিজম (Narcissism) বলা যায়।
তারা এখানেই ক্ষান্ত হননি। সম্প্রতি বইমেলায় তারা তাদের এইসব ব্যক্তিগত নেতিবাচক বিষয়ের অবতারণা করে বই ছাপিয়েছেন। এখানেই তিশা-মুশতাক দম্পতি সর্বোচ্চ লেভেলের বাড়াবাড়িটা করে ফেলেছেন। তাদের উক্ত বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো দেখে চোখ কপালে ওঠলো! সে বইয়ের ১০০তম পৃষ্ঠায় জনাব মুশতাকের একটি ছবি দিয়ে ছবির নিচে লেখা আছে: ‘আমি যে বেল্ট পরেছি তাতে T লেখা তিশার T আর সেজন্যই এই বেল্টটি কিনেছিলাম’। এরকম আরও অনেক…
এটা কি কোনো বইয়ের পর্যায়ে পড়ে? এখান থেকে জাতি কী শিখবে? এখন যারা বাংলা অ্যাকাডেমির মতো বইমেলায় এই বই ছাপিয়েছেন তারা কি দায় এড়াতে পারেন? যদিও এদেশে এখন কোথাও কোনো কিছুতে কারও কোনো দায় নেই! এমন বই ছাপিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে বাংলা অ্যাকাডেমিকে, কলুষিত করা হয়েছে অমর একুশে বইমেলাকে। প্রতিবছর বইমেলা উপলক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ কাগজ অপচয় হয় শুধু বইয়ের নামে এমন সব অখাদ্য-কুখাদ্য ছাপিয়ে।
এছাড়া কয়েকটা প্রকাশনী ছাড়া বেশিরভাগ প্রকাশনী লেখকদের সঙ্গে প্রতারণা করে থাকেন। বই ছাপানোর আগে তারা যে চুক্তিতে আবদ্ধ হন, বই ছাপানোর পর তারা আর সে কমিটমেন্টে থাকেন না। বই বিক্রি হলেও লেখককে রয়েল্টি দেন না। বেশিরভাগ লেখক এ যন্ত্রণায় নিদারুণভাবে ভোগেন, কিন্তু কোনো প্রতিকার পান না। অথচ এসবের নিয়ন্ত্রণের বা দেখভালের দায়িত্ব যেসব প্রতিষ্ঠানের, এক্ষেত্রে সেসবের ভূমিকা ‘ঠুঁটো জগন্নাথের’ মতো।
মুশতাকের মতো কিংবা ডা. সাবরিনার মতো জাতীয় প্রতারকরা যখন বইয়ের নামে অখাদ্য-কুখাদ্য ছাপায় এবং সেটা জাতির মাঝে ছড়িয়ে দেয় চমৎকারভাবে, তখন আর বোঝার বাকি থাকে না জাতি হিসেবে আমাদের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!
অন্যদিকে মুশতাক সাবরিনার যতো অখাদ্য-কুখাদ্যের ভিড়ে ভালো বইগুলো, ভালো লেখাগুলো আলোচনার বাইরে চলে যায়। দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর সারাবছর কোনো হুশ থাকে না দেশের বই নিয়ে, লেখক নিয়ে। কিন্তু এই ফেব্রুয়ারি এলেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে কাভারেজে। কিন্তু সেখানেও ভিউ আর টিআরপির দৌড়ে তাদের কর্মকাণ্ড মূল ফোকাস থেকে সরে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটু জনপ্রিয়তা পেলেই বই ছাপানো যেন ফরজ হয়ে গেছে আমাদের দেশের মানুষের! এখন পাঠক হওয়ার আগেই লেখক! কিন্তু মলাট ওল্টাতে ভেতরে আর পড়া যায় না। কিন্তু এরাই দিনশেষে বেস্ট সেলার লেখক হন। আর ভালো লেখকদের বই বিক্রি হয় না। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে বর্তমানে একটা রোগ মারাত্মকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। তা হলো: “ফেসবুক রোগ”। এখন মানুষ ঠুনকো জনপ্রিয়তার দিকে দৌড়াচ্ছে কিন্তু মানের দিকে কোনো মনোযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ রচনার উদ্ধৃতির কথা মনে পড়ে গেল। বঙ্কিমচন্দ্র সেখানে উল্লেখ করেছেন: “খ্যাতির জন্য লিখিবেন না, এতে খ্যাতিও হইবে না, লেখাও হইবে না।” কবি শামসুর রাহমানের ঠিক “উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ”-এর মতোই আমাদের এখনকার অবস্থা।
আমাদের একেক করে সবকিছু নষ্টদের দখলে চলে যাচ্ছে। শেষমেশ বইমেলাটাও চলে গেল! চারিদিকে যে প্রগাঢ় অন্ধকার তা থেকে আমরা কবে আলোতে ফিরবো?
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই