মৌসুমেও চালের মুল্যস্ফীতি: দ্ররিদ্র্য জনগোষ্ঠি বিপাকে
১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৪৬
আমন মৌসুমেও চালের বাজার অস্থির যা সাধারন মানুষের কষ্টের কারন হিসাবে আবির্ভুত হয়েছে এবং বিষয়টি নতুন সরকারের জন্য একটি স্বর্শকাতর আলোচনার বিষয়। নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট ১১ টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে যেমন মূল্যস্ফীতি, কর্মসংন্থান, ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভরতা, কৃষি ব্যবস্থা যান্ত্রিকীকরণ, সর্বজনীন পেনশন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ইত্যাদি। খাদ্যনিরাপত্তা দ্ররিদ্র্য বিমোচনের একটি বড় অনুসঙ্গ যা নিরসনে সরকার অবগত আছে এবং খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে চাল গরীব মানুষের প্রধান অবলম্বন যার মূল্যবৃদ্ধি তাদের কষ্ঠ দেয় যা কাম্য নয়। চাল শুধু দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যই নয়, বর্তমানে দৈনিক ক্যালরির ৭০.৫ শতাংশই চাল থেকে গ্রহণ করে এ দেশের মানুষ। তাই চালের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা জরুরি। এখন নতুন সরকারের কাছে জনগনের প্রশ্ন মৌসুমে চালের বাজারে এত অস্তিরতা কেন?
আমন মৌসুমে চাল উৎপাদন ও মূল্য পরিস্থিতি:
দেশে মোট চাল উৎপাদনের ৪০ শতাংশ হয় আমন মৌসুমে। চলতি আমন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ৭৮ হাজার টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নিয়েছিল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। মোট ৫৮ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে এ বছর ধানের আবাদ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কাটা হয়েছে ৫৭ লাখ ২৭ হাজার হেক্টর বা সাড়ে ৯৭ শতাংশ জমির ধান। এখান থেকে চাল উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৭০ লাখ ৯৩ হাজার টন। গড় ফলন হয়েছে হেক্টরপ্রতি ২ দশমিক ৯৮ টন। গত বছরের শেষ দিকে পোকামাকড় এবং ঘূর্ণিঝড় মিধিলি ও মিগজাউমের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমির ধান। সে হিসেবে কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার প্রায় ১ কোটি ৭৪ লাখ টন চাল উৎপাদন হওয়ার কথা রয়েছে। এ অনুযায়ী এবার আমনে উৎপাদন দাঁড়াতে যাচ্ছে রেকর্ড সর্বোচ্চে। রেকর্ড উৎপাদনের দাবি করা হলেও বাজারে এখন আকস্মিকভাবেই দাম বাড়ছে চালের। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত কয়েকদিনে বিভিন্ন চালে প্রতি কেজিতে প্রায় ৪-৬ টাকা বেড়েছে। তিন-চারদিন আগেও এখানে প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) ব্রি-২৮ চাল ২ হাজার ২৫০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৫৫০ থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা। প্রতি বস্তাা মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ২৫০ থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকায়। কয়েকদিন আগে যার দাম ছিল ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৫০ টাকা।স্বর্ণা ও পাইজাম চালেও দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৩ টাকা। আর প্রতি কেজি নাজিরশাইল মানভেদে ৬৫-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা কয়েকদিন আগেও ছিল ৬২-৭৫ টাকা। তবে দেশের বেশির ভাগ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। টিসিবির তথ্য বাজারে এখন ১ কেজি মোটা চাল সর্বনিম্ন ৫৫, সর্বোচ্চ ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি।এর আগে ২০১৭ সালের এপ্রিলে সিলেটের হাওড়াঞ্চলে আগাম বন্যায় সরকারি হিসাবে ১০ লাখ টন বোরো চাল নষ্ট হলে মোটা চালের দাম কেজিতে ৫০-৫২ টাকায় উঠেছিল। বর্তমানে সরু চাল বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৮০ টাকা দরে। মাঝারি চাল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়।
খাদ্যের সিংহ ভাগ ব্যয় চালে:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (হায়েস) মতে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের মাসিক মোট আয়ের ৪৭.৭০ শতাংশ খরচ হয় খাদ্যে। গরিব ও অতিগরিব পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে মাসিক মোট আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যয় হয় খাদ্যের পেছনে। আবার তাদের চাল ভোগের পরিমাণও অন্যদের চেয়ে বেশি। যখন দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চালের মাথাপিছু দৈনিক ভোগ ৪৭০ গ্রাম, তখন অন্যদের ক্ষেত্রে তা ৩৬৬ গ্রাম। প্রধান এ খাদ্যপণ্যটির মূল্যস্ফীতিতে তারা ভোগেন সবচেয়ে বেশি। বিআইডিএসের এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, খাদ্য-মূল্যস্ফীতি বাড়লে ৭৩.৮ শতাংশ হতদরিদ্র পরিবারই চালের ভোগ কমিয়ে দেয়। দরিদ্র পরিবারের বেলায় এ হার ৬৬ শতাংশ। তাই চালের দাম উচ্চহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় অতিগরিব ও গরিবদের খাদ্যনিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে।শুধু গরিব ও অতিগরিবরা নয়, চালের দামবৃদ্ধিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তরাও, বিশেষ করে যাদের আয় নির্দিষ্ট। চালের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের আমিষ জাতীয় খাবার কেনা অনেকটা কমিয়ে দিতে হয়। এতে তাদের পরিবারে, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের পুষ্টির অভাব ঘটে। এতে অবনতি হয় তাদের স্বাস্থ্যের। তাছাড়া এসব পরিবারকে কমিয়ে দিতে হয় শিক্ষা খাতে ব্যয়। এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিক্ষার্থীরা। সংকুচিত করতে হয় তাদের পরিবারের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই খাদ্যের, বিশেষ করে চালের মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের কাছে ভীতিকর।
অস্থিরতা চালের মোকামে: নওগাঁ জেলার কেইস
অনেকেই মনে করেন চালের বাজার নিয়ন্ত্রন করে থাকে মিল মালিকেরা যাদের বেশীর ভাগ কুষ্ঠিয়া ও নওগাঁ জেলায় অবস্থিত । এক মাসের ব্যবধানে জেলার মোকামগুলোয় পাইকারি পর্যায়ে সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২-৩ টাকা। আরো দুই মাস আগেই আমন ধান কাটা-মাড়াই শেষ হয়েছে। ভরা মৌসুমে আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধিতে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন স্থানীয়রা । চালের মূল্যবৃদ্ধিতে শঙ্কায় স্থানীয় স্বল্প আয়ের মানুষেরা বলেছেন নির্বাচনের কারণে এমনিতেই রাস্তাাঘাটে মানুষ কম বের হয়েছে। তাই আগের মাসগুলোর তুলনায় দৈনিক আয় কমেছে অন্তত ১০০ টাকা। এর মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের পাশাপাশি চালের দাম বাড়তে শুরু করেছে। এভাবে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকলে গরিব মানুষরা না খেয়ে মরবে। জেলার খুচরা ব্যবসায়ীরা চালের মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী করছেন পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের। তাদের মত হলো খুচরা বাজারে কোনো সিন্ডিকেট হয় না, মিল ও পাইকারি পর্যায়ে অভিযান শুরু হলেই চালের বাজারে স্বস্তি ফিরবে। যদিও জেলার চালকল মালিকরা দাবি করছেন চালের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বাভাবিক। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘পাইকারিতে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে স্বর্ণা-৫ কেজিতে ১ টাকা বেড়েছে। জিরাশাইল ও কাটারিভোগে বেড়েছে কেজিতে ২ টাকা করে। সরকারি গুদামে চাল দিলেই এখন কেজিতে ৪৪ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। সে তুলনায় আমন মৌসুমে চালের বর্তমান বাজার মোটেও অস্বাভাবিক নয়।’ যদিও বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয় বলে মনে করছেন নওগাঁ জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা । তার মতে এ বছর আমনের রেকর্ড পরিমাণ ফলন হওয়ায় বাজারে কোনো সংকট নেই। তাই চালের দাম হুট করে বেড়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক। প্রশাসনের সহযোগিতায় শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। ’ সংশ্লিষ্টদের কারো কারো অভিমত নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে ব্যবসায়ীরা বাজারে চালের দাম বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি একেএম খোরশেদ আলম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়েও হঠাৎ চালের দাম বাড়ানো হয়েছিল। প্রতি কেজিতে তখন ৫ টাকা বেড়েছে। সে সময় মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসলে একজন ব্যবসায়ী নেতা কেজিতে ২ টাকা করে কমানোর ঘোষণা দেন। তার অর্থ হলো এক ঘোষণায় যে ২ টাকা কমাতে পারে সে এক ঘোষণায় বাড়াতেও পারে। তারাই বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও সরকারি তদারকির অভাবে সবসময়ই তারা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে।’এ সময় চালের মূল্য বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন তো চালের ভরা মৌসুম। কিন্তু এখন কেন চালের দাম বাড়বে। এর মাধ্যমে কয়েকদিনে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে একটি চক্র। বাজারে আগে ছোট ছোট মিল মালিকরা ছিল। কিন্তু এখন বেশির ভাগই করপোরেটদের দখলে। বড় বড় কোম্পানি বাজারে ঢুকেছে। বাজারটা মূলত তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে।’চালের বাজার বিভিন্ন সময় অস্থির হয়ে উঠলেও তা নিয়ন্ত্রণে আনতে বরাবরই হিমশিম খেতে হয়েছে সরকারকে। এজন্য বিভিন্ন সময়ে সরকারি সংস্থাগুলোর তথ্য-উপাত্তের ব্যবধানকে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা। চাল উৎপাদনের প্রাথমিক পরিসংখ্যান ডিএই তৈরি করলেও চূড়ান্ত পরিসংখ্যান তৈরি করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের পদক্ষেপ:
বাজার তদারকি, অভিযান, মোবাইল কোর্টে জরিমানা করেও চালের দাম আগের জায়গায় আনা যাচ্ছে না। সরকার থেকে বলা হয়েছে মিনিকেট নামে কোনো চাল বাজারজাত করা যাবে না।প্রতিটি চালের বস্তায় ধানের জাত লেখা থাকবে। লেখা থাকবে উৎপাদনের তারিখ ও মিলগেটের মূল্য। সরকারের এত সব উদ্যোগের কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। মিনিকেট নামের চাল বাজারে এখনও বিক্রি হচ্ছে।বিগত ১ মাসের বিভিন্ন সময় চালের উচ্চমূল্য ঠেকাতে খাদ্যমন্ত্রী ও সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলরা উল্লিখিত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। তবে সাধারণ মানুষ বলছেন, এসব ফাঁকা আওয়াজ। তাদের মতে, খাদ্য বিভাগের আšÍিরক প্রচেষ্টার অভাব এবং প্রভাবশালীদের আশকারায় ভরা মৌসুমেও ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়ানোর সাহস পেয়েছেন। খাদ্য বিভাগ চাইলে এখনো বাজার নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। ১৭ জানুয়ারি খাদ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে চালকল মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দিন থেকেই চালের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে ওই বৈঠকের আয়োজন করে খাদ্য অধিদপ্তর। ওই দিন খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আমন মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। এটা আমার কথা নয় বরং এটা পাইকারি ব্যবসায়ী, মিল মালিক এবং চাল ব্যবসায়ীদের কথা। চালের দাম বাড়ানোর বিষয়ে সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স। আমরা চালের দাম বৃদ্ধি কোনো ভাবেই মানব না। ৪ দিন সময় দিলাম, চালের দাম আগের জায়গায় নিয়ে আসেন।এর পরদিন ১৮ জানুয়ারি থেকে ঢাকায় বাজার তদারকি টিম নামানো হয়। ঢাকার বাইরে শুরু হয় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা। ঢাকায় শুধু ব্যবসায়ীদের সতর্ক করা হলেও জেলায় জেলায় মোবাইল কোর্টের মাধ্যম অবৈধ মজুত চিহ্নিত করে জরিমানা এবং বাজেয়াপ্ত করা হয় ।ওই সময় রাজশাহী, কুষ্টিয়া এবং সিলেটে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন খাদ্যমন্ত্রী, সচিব ও খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা। বৈঠকগুলোতে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, মিনিকেট নামে ধান নেই। সুতরাং এ নামে কোনো চালও বাজারজাত করা যাবে না। বস্তার ওপর ধানের জাত লিখতে হবে। উৎপাদনের তারিখ ও মিলগেটের মূল্য অবশ্যই লেখা থাকতে হবে। কিন্তু গত প্রায় ১ মাস অতিবাহিত হলেও সেই নির্দেশ, আদেশ কিংবা পরামর্শ কেউ আমলে নেননি। ৪ দিনের মধ্যে চালের দাম আগের জায়গায় আনার কথা থাকলেও আনেননি। বলা হচ্ছে আগে বেশি দামে কেনা চাল কম দামে বিক্রি করে ব্যবসায়ীরা লোকসান দেবে নাকি। কিন্তু কত পরিমাণ চাল ব্যবসায়ীরা ক্রয় করলেন যা বিক্রি হচ্ছেই না, সে কথা কিন্তু বলা হচ্ছে না।
এত উৎপাদনের পরও চাল আমদানি কেন?
চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত চাল আমদানি করেনি সরকার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে প্রায় ১০ লাখ ৫৬ হাজার টন চাল আমদানি হয়। গত নভেম্বরে মোটা ও মাঝারি আকারের চালের দাম কিছুটা বাড়লেও তা ডিসেম্বরে কমে আসে। তবে মাস না যেতেই আবার বাড়তে শুরু করেছে দাম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ১৪ লাখ টন চাল মজুদ রয়েছে। কিছু চাল আমদানি করা উচিত। কারণ আমদানি হলে চালের বাজার অস্থিতিশীল করার সুযোগ পায় না। চালের দাম বাড়লে সাধারণ মানুষ সাংঘাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ দেশে মানুষের মোট খরচের প্রায় ৩০ শতাংশ চালে। সবকিছুর দামই বাজারে বেড়েছে। এর মধ্যে চালের দাম বাড়লে সব ধরনের মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলে।’ এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘আমাদের দেশে জমি কম তবুও উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু উৎপাদন ও চাহিদার তথ্যে ব্যাপক গরমিল দেখা যায়। আসলে আমাদের চাহিদা ও উৎপাদন কত তা ঠিক করতে হবে। সে আলোকে উপযোগী সময়েই আমদানি করতে হবে। যেকোনো খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রেই সরবরাহ বেশি থাকলে দাম স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু যখন ব্যবসায়ীরা সরবরাহ সংকট টের পান, তখনই তারা মজুদ করেন বা দাম বাড়িয়ে দেন। আবার বিভিন্ন সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের দাম বাড়িয়ে দিতে দেখা যায়। সরকারি মজুদ আরো শক্তিশালী করলে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াতে পারেন না। চালের ক্ষেত্রে দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশের মানুষের ওপর বেশি পড়ে।’
উপসংহার:
সরকার দেশে উৎপাদিত ধান-চালের খুব সামান্য পরিমাণ সংগ্রহ করায় ধান (বোরো ও আমন) কাটা-মাড়ার মৌসুমে চালকল মালিকরা সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে কম দামে প্রচুর পরিমাণে ধান কিনে তা চালে রূপান্তর করে। সিন্ডিকেশনের মাধ্যমে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মৌসুম শেষে উচ্চ দরে চাল বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণে লাভ করে।এ প্রবণতা রোধে সরকারি গুদামে সব সময়, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর-নভেম্বর এবং মার্চ-এপ্রিলে চালের মজুত সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখতে হবে। একই সঙ্গে চালকল মালিক, চাল ব্যবসায়ী এবং বড় কৃষক যেন চাল মজুত সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশ মেনে চলেন, তা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে চলমান চাল সংকট এড়াতে চাল আমদানির কোনো বিকল্প নেই। তবে চাল আমদানিতে উচ্চহারে রেগুলেটরি ডিউটি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতির কারণে বেসরকারি চাল ব্যবসায়ীরা আমদানিতে তেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না বলে গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়। এ অবস্থায় যা প্রয়োজন তা হলো, প্রধান খাদ্য চালের উৎপাদন বৃদ্ধি করা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দিয়েছেন। খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে না পারলে আমাদের ভোগান্তি বহুগুণ বাড়বে। সরকারকে খাদ্য ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করতে হবে, যাতে চালকল মালিক ও চাল ব্যবসায়ীরা সরকারনির্ধারিত সময়ের চেয়ে বেশি সময় চাল মজুত করে রাখতে না পারেন। তা হলেইবর্তমান চাল সংকট তথা মূল্যস্ফীতি লাঘব সম্ভব হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত মৌসুমেও চালের মুল্যস্ফীতি: দ্ররিদ্র্য জনগোষ্ঠি বিপাকে