Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে ভোজ্যতেল উৎপাদন জরুরি

ড. মিহির কুমার রায়
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:১০

খাদ্য নিরাপত্তায় ভোজ্যতেল এখন নতুন রূপে আবির্ভুত হয়েছে বিশেষত:পুষ্টির কথা বিবেচনায় নিয়ে। মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন ও জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণে দেেশ ভোজ্যতেলের চাহিদা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মাথাপিছু দৈনিক ৪০ গ্রাম ধরে ২০৩০ সালে ভোজ্যতলের দেশীয় চাহিদা দাঁড়াবে প্রায় ২৮ লাখ টন। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ভোজ্যতেল আমদানি করতে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতি বছর ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হয় (২০২৩)। র্বতমানে ২৪ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে দেশে ভোজ্যতেল (সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী) থেকে স্থানীয ভাবে উৎপাদন মাত্র ৩ লাখ টন যা চাহিদার মাত্র সাড়ে ১২ শতাংশ। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ ভাগ স্থানীয়ভাবে মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করছে সরকার।

বিজ্ঞাপন

ভোজ্যতেল হিসাবে সরিষার গুরুত্ব:

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ভোজ্যতেলের মধ্যে সরিষার তেলই প্রধান যা মোট উৎপাদনের প্রায় ৩৬ শতাংশ। সয়াবিন দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল বীজ ফসল, যা বছরে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার টন উৎপাদতি হয়। তবে এর পুরো পরিমান নিষ্কাশন ছাড়াই পোলট্রি ফিড হিসােেব ব্যবহার করা হয়। উল্লেখ্য, ভোজ্যতেল হিসাবে সরিষার তেলে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডরে পরমিাণ ৩০ শতাংরে নিচে ও অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিডের পরমিাণ ৫০ শতাংশের ওপরে এবং ওমগো-৩ ও ওমগো-৬ এর অনুপাত ১:২ বদ্যিমান, যা পুরোপুরি স্বাস্থ্যসম্মত। ভোজ্যতেল হিসাবে সরিষার তেলেরে চাহদিা বৃিদ্ধ, অনুকূল আবহাওয়া, সরিষা আবাদে কৃষকের সচেতনতা বৃদ্ধি ও উচ্চফলনশীল জাতের সরিষা কৃষক র্পযায়ে সম্প্রসারিত হওয়ায় চলতি র্অথবছরে সরিষার উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি বৃিদ্ধর কারণ। ‘কয়েক বছর আগেও মানুষ সরিষা তেল খাওয়া ভুলে গিয়েছিল। এখন সবাই সরিষা তেল খাচ্ছে। কারণ সয়াবিনের চেয়ে সরিষার তেলের উপকারিতা অনেক বেশি। এখানে উল্লেখ্য যে তেলবীজ আবাদি জমির প্রায় ৬০ শতাংশ সিিষায় এবং কমবেশি সব জেলাতেই সরষিার চাষ হয়। ডিএই সূত্রে জানা যায়, দেেেশ গত ২০২১-২২ র্অথবছরে প্রায় ৬ লাখ হক্টের জমিতে সরিষা আবাদে উৎপাদিত সরিষার পরমিাণ ছলি ৭ দশমকি ৩৫ লাখ টন এবং গত ২০২২-২৩ র্অথবছররে সরষিার আওতায় জমির পরিমাণ বাড়ে প্রায় ২ লাখ হেক্টর। সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক ‘তেল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প’-এর আওতায় জুন ২০২৫ সালরে মধ্যে প্রত্যাশার অনুকূলে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ েেশীয় উৎপাদন দিয়ে মেটানো সম্ভব হেব। ভোজ্যতেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশে তেল জাতীয় ফসল সরিষা চাষের আওতায় জমির পরমিাণ বৃিদ্ধসহ উচ্চফলনশীল জাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ও উৎপাদন কলাকৌশলে আধুনিক পদ্ধতির অনুসরণই একমাত্র উপায়।

বিজ্ঞাপন

সরিষার চাষে শস্য বিন্যাশ:

বাংলাদেশে সাধারণত: আমন ধান চাষের পর জমি পতিত থাকবে। এর পর সেই জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়। তেলে উৎপাদন বাড়াতে প্রয়োজন আমন ধানের পর জমি পতিত না রেখে স্বল্পমেয়াদি সরিষার আবাদ করা। এ জন্য দেশের বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে স্বল্প জীবনকালের (১০০ থেকে ১২০ দিন) অথচ উচ্চফলনশীল আমন ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন, যেগুলো মূল জমিতে চারা রোপণের মাত্র ৮০ থেকে ৯৫ দিনরে মধ্যেই ঘরে তোলা যায়। এর পর জমি পতিত না রেখে উন্নত জাতের সিিষা চাষ করা সম্ভব হচ্ছে, যেগুলো ৮০-৮৫ দিনের মধ্যে পরিপক্ষ¡ হওয়ায় পর একই জমিতে আবার বোরো ধান চাষ করে প্রচলিত দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলিতে রূপান্তর করা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেেশ প্রায় ২২ লাখ হক্টের জমি আমন-পততি-বোরো শস্য বিন্যাসরে অর্ন্তভুক্ত (সূত্র: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর)। বাংলাদেেশ সরিষা বপন-পরর্বতী অগ্রহায়ণ (মধ্য নভেম্বর থেেক মধ্য ডিসেম্বের) মাসে নম্নিচাপ জনিত বৃিষ্টপাতের কারণে জমিতে সাময়িক জলাবদ্ধতায় দেশি জাতের সরষিা টরি-৭সহ অন্যান্য উচ্চফলনশীল জাত নষ্ট হলেও বারি সরিষা-১৮ ও বারি সরিষা-১৯ জাত পাঁচ দিন র্পযন্ত সাময়িক জলাবদ্ধতা/জলমগ্নতা-সহিষ্ণু হওয়ায় কৃষকরা ফসলহানি থেকে রক্ষা পাচ্ছে। কাজেই উচ্চফলনশীল ও স্বল্পমেয়াদি বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭সহ বারি সরিষা-১৮ জােের আবাদ নশ্চিতকরণ; শস্যবিন্যাসে উল্লেখিতি সরিষার জাতগুলোর অর্ন্তভুিক্তকরণসহ পতিত জমি ও চরাঞ্চলে সরিষার জাতগুলোর আবাদ সম্প্রসারণের মাধ্যমে ভোজ্যতেলের আমদানিনির্ভরতা কমানো সম্ভব।

সরিষার আবাদ বাড়াতে প্রযুক্তি:

সরিষার আবাদ বাড়াতে এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বল্প মেয়াদী আমন আবাদের পর স্বল্প মেয়াদী সরিষার জাত আবাদে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন জাত মাঠে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলছে। এর ফলে আমন আবাদ শেষে সরিষা আবাদ করেও বোরো ধান চাষ করা সম্ভব। এতে কৃষক সরিষা আবাদে আরও বেশি আগ্রহী হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতিবছরই বেড়েছে সরিষার আবাদ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরিষা আবাদ হয়েছিল ৪ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর জমিতে। পরের ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ২১ হাজার হেক্টর। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫ লাখ ৬৮ হাজার হেক্টর, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৫ লাখ ৮৯ হাজার হেক্টর, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ১০ হাজার হেক্টর এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছিল।

এদিকে ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯, ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২- এই পাঁচ অর্থবছরে সরিষার উৎপাদন যথাক্রমে ৬ লাখ, ৬ লাখ ৮৩ হাজার, ৭ লাখ ৫০ হাজার, ৭ লাখ ৮৭ হাজার ও ৮ লাখ ৫৪ হাজার মেট্রিক টন। এছাড়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে সরিষার আবাদ হয় ৮ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয় ১১ লাখ ৬০ হাজার টন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ লাখ ৯৮ হাজার হেক্টর, সমপরিমাণ জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৬ লাখ ২৯ হাজার টন। তথ্যমতে, এবার ১০ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। সেই হিসেবে চলতি মৌসুমে ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২ লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর বেশি জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে।কৃষি গবষেণা ইনস্টটিউিটরে বজ্ঞিানীগণ পরর্বিতনশীল আবহাওয়া উপযোগী ও উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনরে লক্ষ্যে গবষেণা র্কাযক্রম চালেিয় যাচ্ছনে, যা তলেবীজ উৎপাদনরে সরকার নর্ধিারতি লক্ষ্যমাত্রা (চাহদিার ৪০ শতাংশ) র্অজনে গুরুত্বর্পূণ ভূমকিা রাখবে। বারি উদ্ভাবতি সরষিার জাতগুলোর বীজরে সহজলভ্যতার জন্য প্রয়োজন সরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতষ্ঠিান বএিডিিস ও বসেরকারি বীজ উৎপাদনকারী প্রতষ্ঠিানরে মাধ্যমে উন্নতজাতরে মানসম্পন্ন বীজ র্পযাপ্ত পরমিাণে উৎপাদন। একই সঙ্গে প্রয়োজন কৃষি সম্প্রসারণ ও বাংলাদশে কৃষি গবষেণা ইনস্টটিউিটরে (বার)ি মাধ্যমে সরষিা চাষে কৃষকদরে প্রশক্ষিণ দেিয় উদ্বুদ্ধকরণ, সরষিার সঠকি চাষাবাদ পদ্ধতি বষিয়ে কৃষকদরে অবহতিকরণ, মাঠ র্পযায়ে মনটির জোরদারকরণ এবং যথাসময়ে বীজ সরবরাহরে নশ্চিয়তা প্রদান।

সরিষার আবাদে প্রকল্প গ্রহন:

দেশে তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বাড়াতে ‘তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি’ শীর্ষক একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। শেষ হবে ২০২৫ সালের জুনে। প্রকল্পের ব্যয় ২২২ কোটি ১৬ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত বছর ১৩ হাজার ৯৭৯টি প্রদর্শনী করা হয়। এসব প্রদর্শনীতে ৩ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছিল। তবে এবার প্রদর্শনীর সংখ্যা কমেছে। চলতি বছর ১৩ হাজার ৫৭৪ টি প্রদর্শনী করা হয়েছে। এসব প্রদর্শনীতে বীজ ও সার সবই বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমাদের যে টার্গেট, সেই সঠিক ধারাতেই রয়েছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল ৩ বছরে ৪০ শতাংশ আমদানি কমিয়ে আনার। প্রথম বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। দ্বিতীয় বছরে যে লক্ষ্যমাত্রা আশা করি তাও পূরণ হবে। এ বছর তেলজাতীয় ফসলের আমদানি ২৫ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর আগামী বছরের মধ্যেই আমরা আমদানি ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারব।তিনি আরও বলেন এখন শুধু তেলের চাহিদাই বিবেচনা করা হচ্ছে না, পুষ্টির কথাও বিবেচেনা করা হচ্ছে। যাতে সঠিক পুষ্টিটা কৃষকরা পায়। গ্রামে মাঠে গেলে এখন চারদিকে শুধু সরিষা। প্রকল্পের কারণে আমদানি ইতোমধ্যেই কমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে গত বছর ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ আমদানি কমেছে। আশা করছি এ বছর ২৫ ভাগ আমদানি কমে আসবে। তথ্যমতে, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রায ২৪ লাখ টন। এর মধ্যে সরিষা, তিল ও সূর্যমুখী থেকে স্থানীয ভাবে উৎপাদন হয মাত্র ৩ লাখ টন, যা চাহিদার ১২ শতাংশ। বাকি ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১২ লাখ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, আর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি। এর মধ্যে আবাদ হয়েছে প্রায় ১১ লাখ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলেও গতবারের চেয়ে এবার প্রায় ৩ লাখ হেক্টর জমিতে আবাদ বেড়েছে। সরিষার আবাদ বাড়াতে হেক্টর প্রতি সরিষার উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্যে গতানুগতি জাতের পরিবর্তে বারি-১৪, বারি-১৭, বারি-১৮, বিনা-৪ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা আবাদে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। দুটি ধান ফসলের মাঝখানে সরিষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রোপা আমনে স্বল্প জীবনকালের ধান ব্রি ধান-৭১, ব্রি ধান-৭৫, ব্রি ধান-৮৭, বিনা ধান-৭ ও বিনা ধান-১৭ এগুলো রোপনের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের। এরপর স্বল্পকালীন সরিষা বারি-১৪, বারি-১৭, বিনা-৪ ও বিনা-৯ জাতের সরিষা রোপন করা হয়।আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ ভাগ স্থানীয়ভাবে মেটাতে সরিষার আবাদ বাড়াতে কাজ করছে সরকার। গত বছর ১০ লাখ বিঘা জমিতে সরিষা আবাদে প্রণোদনা দেওয়া হয়। এ বছর তা বাড়িয়ে ১২ লাখ বিঘাতে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। এতে উপকারভোগী হয়েছে ১২ লাখ পরিবার। প্রণোদনার আওতায় কৃষকদের সরিষা বীজ ও রাসায়নিক সার বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছে। এবারও বীজ ও সার পাচ্ছেন কৃষকরা।

সরিষার আবাদে রাজশাহী জেলা – একটি কেইস:

ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আবাদে কম খরচের বিপরীতে বেশি লাভের কারণে রাজশাহীতে বেড়েছে সরিষার আবাদ ও উৎপাদন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাব বলছে, গত মৌসুমের তুলনায় চলতি মৌসুমে সরিষার আবাদ বেড়েছে ৩৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। আর গত ১০ বছরে এর আবাদ বেড়ে হয়েছে প্রায় চার গুণ। কৃষকরা বলছেন, কম খরচে সরিষা আবাদে বেশি লাভ। এর সঙ্গে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সরিষার দিকে নজর কৃষকদের। তিন ফসলি জমিতে এর চাষ আরও বেড়েছে। আবার কেউ কেউ সরিষা ক্ষেতে মধুও উৎপাদন করছেন। সেক্ষেত্রে সরিষার আবাদ বাড়তি অর্থ উপার্জনের সুযোগ করে দিয়েছে। কৃষি বিভাগ থেকেও সরিষা আবাদ ও উৎপাদনে কৃষকদের প্রণোদনাসহ সব ধরনের সহযোগিতা করা হচ্ছে। ফলে এর আবাদও দিন দিন বাড়ছে।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলার ৯টি উপজেলা ও মহানগরীর দুটি থানায় সরিষার আবাদ হয়েছে ৭৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার ২৬২ মেট্রিক টন। গত বছর চাষ হয়েছিল ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ৩৪ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বেড়েছে।এ বছর সবচেয়ে বেশি সরিষা চাষ হয়েছে গোদাগাড়ী উপজেলায়। এ উপজেলায় ২২ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ হাজার ৪০০ মেট্রিক টন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সরিষা আবাদ হয়েছে বাগমারা উপজেলায়- ১৮ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার ২১২ মেট্রিক টন। তানোর উপজেলার ১০ হাজার ৭২০ হেক্টর জমিতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১১ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন। দুর্গাপুর উপজেলায় সরিষা চাষ হয়েছে সাত হাজার ৩৯৫ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন ধরা হয়েছে সাত হাজার ২৭০ মেট্রিক টন।এ ছাড়া মোহনপুর উপজেলায় সাত হাজার ১৭৫ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাত হাজার ১৭০ মেট্রিক টন। পুঠিয়া উপজেলায় পাঁচ হাজার ১৫৫ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ১৫০ মেট্রিক টন। পবা উপজেলায় চার হাজার ৫৩৫ হেক্টর জমিতে চার হাজার ৫৩০ মেট্রিক টন, চারঘাট উপজেলায় এক হাজার ১২২ হেক্টর জমিতে ৯৮০ মেট্রিক টন ও বাঘা উপজেলায় ৮৩৫ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৮০ মেট্রিক টন এবং নগরীর মতিহার থানায় ২৩ হেক্টর জমিতে ১০ মেট্রিক টন ও বোয়ালিয়া থানায় ১৫ হেক্টর জমিতে ১০ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। গোদাগাড়ী ও পবা উপজেলার বেশকিছু এলাকায় দেখা গেছে, গাছে গাছে সরিষার দানা দোল খাচ্ছে। এসব এলাকার কৃষক বলছেন, কম খরচে লাভ বেশি হওয়ায় তারা সরিষা আবাদ করেন। এ ছাড়া আমদানি করা সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরিষা তেলের চাহিদাও বেড়েছে। এ কারণে এ অঞ্চলের কৃষকরা সরিষা আবাদে ঝুঁকে পড়েছেন। গোদাগাড়ীর উদপুর গ্রামের কৃষক আবদুল মোত্তালেব বলেন, ‘গত বছর ছয় বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছিলাম। ভালো দাম পাওয়ায় এবার আবাদ করেছি ৯ বিঘা জমিতে।’কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এবার ছয় বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করেছি। ছয় হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে সরিষা চাষে ঝামেলা কম। সেচ দিতে হয় না। প্রথমে জমিতে হালচাষ করে সরিষার বীজ বপন করার পর একবার সার দিলেই ভালো ফলন পাওয়া যায়।’ এবার বিঘাপ্রতি ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার সরিষা উৎপাদন হবে বলে প্রত্যাশা করছেন তিনি। কৃষকদের দাবি, সারের দাম বাড়ায় গত বছরের চেয়ে এবার বিঘাপ্রতি দুই হাজার টাকা খরচ বেশি হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি বিঘায় প্রায় সাত হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে তাদের। এক বিঘা জমিতে সরিষার সর্বোচ্চ আট মণ ফলন পাওয়া যায় বলে জানান তারা। তানোর উপজেলার গুবিরপাড়া এলাকার কৃষক আবদুস সোবহান জানান, কয়েক বছর আগে আলুর আবাদ করতাম। আলু চাষ করে লোকসান হয়েছিল। তাই এবার সরিষার চাষ করেছি। অল্প সময়ে সরিষার ফলন পাওয়া যায়। খরচও কম।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর গত ১০ বছরের সরিষার আবাদ ও উৎপাদনের তথ্যও দিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ২০১২-১৩ বছরে সরিষার আবাদ হয়েছিল ২০ হাজার ৭০৩ হেক্টর জমিতে, উৎপাদন হয়েছিল ২৩ হাজার ৪৭২ মেট্রিক টন। ২০১৩-১৪ সালে ১৯ হাজার ৮১১ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ৭৭৩ মেট্রিক টন। ২০১৪-১৫ সালে ১৯ হাজার ৬৯১ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয়েছিল ২৪ হাজার ৮৫৫ টন। তবে এই সময় সরিষা থেকে মধু উৎপাদনের কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। এরপর ২০১৫-১৬ সালে ১৯ হাজার ৮৫৮ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ৮৩৫ মেট্রিক টন, সরিষা থেকে মধু উৎপাদন করা হয় ১২ হাজার ৬৩০ কেজি। ২০১৬-১৭ সালে ১৯ হাজার ৪৬১ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ৮৫৪ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয় ১০ হাজার ৫২৯ কেজি। ২০১৭-১৮ সালে ১৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে সরিষার উৎপাদন ছিল ২৩ হাজার ৭৩৫ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয়েছিল ১০ হাজার ৩৪০ কেজ। ২০১৮-১৯ সালে ২১ হাজার ২৫২ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয়েছিল ২৯ হাজার ১৬৫ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৪৫ কেজি। মৌসুমের শেষের দিকে মাঠ থেকে সরিষা সংগ্রহে ব্যস্ত কৃষকরা। এরপর ২০১৯-২০ সালে ২৩ হাজার ১৯৯ হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ৩৪ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয় ১৫ হাজার ৫৩০ কেজি। ২০২০-২১ সালে সরিষা আবাদ হয়েছিল ২৩ হাজার ৫৪৩ হেক্টর জমিতে,। উৎপাদন হয়েছিল ৩৩ হাজার ৭১০ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয়েছিল ১৪ হাজার ৯৩৫ কেজি। ২০২১-২২ সালে ২৬ হাজার ১৫৬ হাজার হেক্টর জমিতে সরিষা উৎপাদন হয় ৪০ হাজার ৮২৭ মেট্রিক টন, মধু উৎপাদন হয় ১২ হাজার ২৭৭ কেজি।২০২২-২৩ সালে সরিষা আবাদে বলা যায় বিপ্লব ঘটে। এ বছরে সরিষা চাষে ব্যাপকভাবে আগ্রহী হন কৃষকরা। আগের বছরের ২৬ হাজার হেক্টর থেকে এ বছরে সরিষার আবাদ ছড়িয়ে পড়ে ৪২ হাজার ৫৫০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদনও বেড়ে হয় ৬৯ হাজার ৭৫৮ মেট্রিক টন। এ বছর মধু উৎপাদন হয় এক লাখ ৬২ হাজার ৪৬০ কেজি। চলতি মৌসুম তথা ২০২৩-২৪ সালেও ব্যাপকভাবে বেড়েছে সরিষার আবাদ। ৪২ হাজার হেক্টর থেকে ছড়িয়ে পড়েছে ৭৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে।

উপসংহার:

ভোজ্যতেলের আমদানি-নির্ভরতা কমাতে সরিষার আবাদ বাড়াতে কৃষকদের সার-বীজ দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছ। পাশাপাশি কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। বেশকিছু এলাকায় সরিষা কাটাও শুরু হয়েছে। অন্য ফসলের চেয়ে সরিষা সহজ ও অল্প খরচে চাষ করা যায়।খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এটি একটি সুসংবাদ নি:সন্দেহে বলা যায় ।

লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ

সারাবাংলা/এসবিডিই

খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে ভোজ্যতেল উৎপাদন জরুরি ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর