অর্থনীতিতে নোবেল: নারী শ্রম গবেষনায় স্বীকৃতি
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:৫৯
অর্থনীতিতে এ বছর নোবেল জয় করলেন মার্কিন অর্থনীতিবিদ ক্লডিযা গোল্ডিন। নারী শ্রম বাজারের ফলাফল সম্পর্কে জ্ঞানবৃদ্ধিতে অবদানের জন্য এই সম্মাননা পেলেন তিনি। ক্লডিযা গোল্ডিন ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইযর্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং বর্তমানে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। নোবেলজয়ী হিসাবে তিনি নোবেল পদকের পাশাপাশি পাবেন একটি সনদপত্র, মোট ১১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার বা ১১ কোটি ১৩ লাখ টাকা।১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু হয়েছে। ২০২৩ সাল পর্যন্তএ শাখায় নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে মোট ৫৫টি। এবারের ৫৫তম পুরস্কারটি অর্জন করলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ক্লডিয়া গোল্ডিন যিনি মহিলাদের মধ্যে তৃতীয়। এর আগে যে দুই নারী অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন এলিনর অস্ট্রম ও এস্থার দুফলো।
অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন গত ২০০ বছরে নারীদের উপার্জন এবং শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের ব্যাপারে বিস্তারিত গবেষণা প্রকাশ করেছেন। বিষয়টি প্রথমবারের মতো বিস্তরিত ভাবে সবার সামনে তুলে ধরা হয়েছে। তাঁর প্রতিবেদন নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক পার্থক্যের মূল বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। শ্রমবাজারে বিশ্বব্যাপী নারীদের ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করা হয়। আয়ের ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীরা কম উপার্জন করেন। ক্লডিয়া গোল্ডিন এ বিষয়ে ব্যাপক অনুসন্ধান করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০০ বছরের বেশি সময়ের তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এর মাধ্যমে দেখিয়েছেন কেন ও কীভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয় ও কর্মসংস্থানে নারী-পুরষের মধ্যকার পার্থক্যের পরিবর্তন ঘটে। আয়ের ক্ষেত্রে লিঙ্গ পার্থর্কের সঙ্গে শিক্ষা ও পেশাগত পছন্দের সম্পর্ক রয়েছে। একই পেশায় আয়ের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হয় নারীর প্রথম সন্তান জন্মের সময়। শ্রমবাজারে নারীর ভূমিকা সমাজের জন্য বোঝা জরুরি। আমরা এখন নারী-পুরুষের আর্থিক অবস্থার পার্থক্যের পেছনের কারণ সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। ভবিষ্যতে কোন কোন বাধা সরানো প্রয়োজন হতে পারে, তা আমরা ক্লডিয়া গোল্ডিনের গবেষণা থেকে জানতে পারব। এই যে নারী-পুরুষের ব্যবধান এবং তার রূপের পরিবর্তন, ক্লডিয়া গোলডিনের গবেষণায় তার কারণ উন্মোচিত হয়েছে। একধরনের মডেল দিয়েছেন তিনি। নোবেল প্রাইজ ডট অর্গে বলা হয়েছে, অনেক উচ্চ আয়ের দেশে গত এক শতকে বেতন-মজুরিভিত্তিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ তিন গুণ হয়েছে। আধুনিক সময়ের ইতিহাসে এটি অন্যতম বৃহৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, কিন্তু তা সত্ত্ওে নারী-পুরুষের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান রয়ে গেছে। গত শতকের আশির দশকে ক্লডিয়া গোলডিন এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শুরুকরেন। ক্লডিয়া গোলডিনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মূল বিষয় হচ্ছে, আগে এবং এখনো নারীর সিদ্ধান্ত মূলত তাঁর বিয়ে ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের নিরিখে নির্ধারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করলেও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি কালসীমানার গন্ডি পেরিয়ে যায়। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ক্লডিয়া গোলডিন ২০০ বছরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণায় দেখেছেন, এই সময়ে শ্রমশক্তিতে নারী অংশগ্রহণ শুধু বেড়েছে বিষয়টি মোটেও তেমন নয়, বরং এ-বিষয়ক রেখাচিত্র ইংরেজি ইউ আকৃতির। অর্থাৎ এই ইতিহাস সরল রৈখিক নয়। দেখা গেছে, কৃষিসমাজ থেকে শিল্পসমাজে উত্তরণের সময় উনিশ শতকে বিবাহিত নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমেছে। এরপর বিশ শতকের শুরু থেকে সেবা খাতের বাড়বাড়ন্ত হতে শুরু করলে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। ক্লডিয়া গোলডিনের ব্যাখ্যা হলো, মূলত কাঠামোগত পরিবর্তন এবং পরিবার ও সমাজে নারীর দায়িত্ব-কর্তব্যবিষয়ক সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়েছে। বিশ শতকে নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। অধিকাংশ উচ্চ আয়ের দেশে নারীর শিক্ষার মান পুরুষের চেয়ে বেশি। আরেকটি কারণে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিপ্লক পরিবর্তন এসেছে। সেটা হলো, জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী। এটা নারীকে ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা করার সুযোগ দিয়েছে, অর্থাৎ স্বাধীনতা দিয়েছে।তবে এত পরিবর্তন সত্ত্বেও কিছু পুরোনো বিষয় এখনো রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ক্লডিয়া গোলডিন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নারী-পুরুষের আয়ের ব্যবধান তেমন একটা কমছে না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করেন, এর আংশিক কারণ হচ্ছে শিক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত সাধারণত কম বয়সে নেওয়া হয়। তরুণীদের আকাঙ্কা যদি আগের প্রজন্মের নারীদের অভিজ্ঞতার আলোকে নেওয়া হয়, অর্থাৎ মেয়েরা যদি মাকে দেখে সিদ্ধান্ত নেয় যে মা হয়তো সন্তান বড় হওয়ার আগে কাজে ফেরত যাননি তাহলে উন্নয়নের গতি কমে যায়। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, নারী-পুরুষের আয়ের বৈষম্যের পেছনে শিক্ষা ও পেশার ভূমিকাই মুখ্য। গোলডিন দেখাচ্ছেন, আগের সেই জামানা আর নেই।
এই গবেষনা নারীর ক্ষমতায়নে যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে এবং মানবাধিকারের বিষয়টি যে এর সঙ্গে সংযুক্ত এ ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহ নেই । দীর্ঘ সময় ধরে গবেষনায় নারী শ্রমের মাধ্যমে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহনের বিষয়টি দেশের আর্ভ্যন্তরীন উৎপাদন (জিডিপি) অনুশীলনে মূল্যসংযোজন হিসাবে স্থান পেয়ে আসেনি। এখন পশ্ন হলো এই হিসাবটি যদি গণণায় স্থান পেত তা হলে উন্নয়নের সূচক হিসাবে জিডিপি আরও বেড়ে যেত। আসলে বিষয়টি আর্থসামাজিক যা নিরুপন করতে গেলে সমাজ বিশ্লেষনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিত । কারন একটি পরিবারে মহিলার অবস্থান অনেকটা গৃহস্থালি ব্যবস্থাপক হিসাবে দেখা হয় এবং অর্থনীতির মূল উৎপত্তি এই গৃহস্থালি ব্যবস্থাপনা থেকেই। কাজেই এই জটিল বিষয়টি নিয়ে কোন গবেষক বা গবেষনা অনুদানকারী সংন্থা তেমন আগ্রহ দেখায় নি যা অনেকটা বিশ্বয়কর । এ নিয়ে দেশের নারীবাদি সংগঠনগুলো আন্দোলন করছে এবং এটি একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসাবে বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থান করে নিয়েছে। এর সঙ্গে আসে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি যা যতটানা অর্থনৈতিক, তার ছেয়ে বেশী রাজনৈতিক। এনিয়ে গবেষনা তেমন হয়নি যদিও গবেষনা বরাবরই অবহেলিত হয়ে আসছে বাংলাদেশে যা একাডেমিক কিংবা দাপ্তরিকই হউক না কেন।
বিশেষজ্ঞগন বলছেন নব্বই এর দশক থেকে নারী প্রধানমন্ত্রীরাই বাংলাদেশকে শাসন করে চলছে। তারপরও নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা নারী নেতৃত্ব দেশের সর্বস্থরে প্রতিষ্টার গতি এত মন্থর কেন যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রী ,সংসদ নেন্ত্রী, সংসদ উপনেতা, বিরোধী দলীয় নেতা, শিক্ষা মন্ত্রী এবং জাতীয সংসদের স্পীকার মহিলা। এককালের ছাত্রনেত্রী প্রশ্ন তুলেন বাংলাদেশ যে গতিতে নারীর উন্নয়ন গবেষনা কিংবা রাষ্ট্রাপরিচালনার রাজনীতিতে অংশ গ্রহন করে চলছে তা খুবি হতাশাব্যাঞ্জক। তার একটি মাত্র কারন নেতৃত্ব তৈরির যে প্রক্রিয়া তা অনেকদিন যাবত স্রোতহীন নদীর মত আবদ্ধ জলে মজে গেছে। বিষয়টি এখানেই শেষ নয় সারা দেরে সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গুলোর চিত্র একই রকম বিধায় নারী নেতৃত্ব/গবেষক তৈরীর প্রশ্নই আসেনা। তিনি আরও বলেন এর থেকে মুক্তির পথ একটি আছে যা হলো নলেজ ভিত্তিক আদর্শিক রাজনীতির দিকে ধাবিত হওয়া, উচ্চ শিক্ষায় নারীদের আরও সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া এবং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের রুপান্তর ঘটিয়ে মাতৃতান্ত্রীক সমাজের সাথে তার ভারসাম্য রক্ষা করা। এই আলোচনা থেকে এটিই প্রতিয়মান হয় যে তুলনা মূলক বিচারে এই জায়গাটিতে আমারা পিছিয়ে সত্যি। একটি দেশের উন্নয়নে অনেকগুলো মানদন্ডের মধ্যে একটি হলো সমাজের সর্বক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহনের আনুপাতিক হার বৃদ্ধি। সেই ক্ষেত্র পূর্বের তুলনায় অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে বিশেষত: শিক্ষার কিংবা উচ্চ শিক্ষার গষেনার হারে তেমন পরিবর্তন হয়নি। এখন রাতারাতি নারী উন্নয়ন সম্ভব নয় তার সাতে সমাজ কাঠামো তথা পরিবার কাঠামো জড়িত। তবে অর্থনীতিবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন এর গবেষনা ও তার স্বীকৃতি সারা পৃথিবীকে নূতন এক পথের সন্ধান দিয়ে গেল যার উদ্ভাবিত মডেল ব্যবহার কওে নারী শ্রম গবেষনা এক বিশেষ মর্যাদায় আসিন হবে এই প্রত্যাশা রইল।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
অর্থনীতিতে নোবেল: নারী শ্রম গবেষনায় স্বীকৃতি ড. মিহির কুমার রায় মুক্তমত