প্রমানের আগেই ফয়সালার সংস্কৃতি
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:১৪
মিডিয়া আমাদের জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করে রেখেছে। এককালে আমাদের দেশে মিডিয়া ছিলো কম। সবেধন নীলমনি হিসেবে যে দু’ একটা ছিলো সেটাই আমাদের কাছে বিশেষ দ্রষ্টব্য ছিলো। কালে কালে মিডিয়ার অঙ্গণে নতুন নতুন প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক হাউসের আবির্ভাব হয়েছে। এতে করে দৈনন্দিন নানাবিধ খবরের তাৎক্ষণিক আপডেট যেমন জানা যাচ্ছে তেমনি এর স্বক্রিয় ভূমিকার কারণে নানা মহল সচেতন থাকছে। আবার ব্যাতিক্রমের নিয়মে এদের অনেকই বিভিন্নভাবে দলীয় ও গোষ্ঠীর প্রচার-প্রসারের কাজে ব্যস্ত থাকছে।
মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা কথা চালু আছে। মিডিয়ার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অপবাদ হলো তাদের দলীয় ও গোষ্ঠীগত আনুগত্যতা। নামেই স্বণাক্ত করা যায় কোন মিডিয়া হাউস কার নিয়ন্ত্রণে বা কার পক্ষে কাজ করছে। দেশে বর্তমানে ডিজিটাল সিকিউরিটি এক্ট চালু আছে। এ নিয়েও অনেক কথা আছে। এই এক্ট মিডিয়া বান্ধব কিনা তা এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরাই ভালো বলতে পারবেন। যখনই কেউ এতে আক্রান্ত হোন তখনই এই এক্ট নিয়ে সাংবাদিকরা সোচ্চার হন। কখনো কারো পক্ষে অতি সরবহ ন। আবার কখনো কারো ব্যাপারে লক্ষ্যণীয়ভাবে নিরব থাকেন।
এ নিয়ে পাবলিকের মাথা ব্যাথা থাকলেও উপশমের কোন উপায় নেই বিধায় তারা স্পিক টি নট হয়ে আছেন। তবে যে বিষয়টি পাবলিকের তীব্র অসন্তোষের মধ্যে রয়েছে তা হলো কোন ঘটনা ঘটলেই মিডিয়া তাকে কোন রূপ তদন্ত না করেই বা কর্তৃপক্ষীয় তদন্ত ছাড়াই বা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগেই একপাক্ষিক ভাবে তুলে ধরে। এতে বিচার কাজ প্রভাবিত হয়। আর ভুক্তভোগী সমাজে ও প্রশাসনের চোখে বিচার শুরুর আগেই অপরাধী হিসেবে গণ্য হয়। আর তখন থেকেই তার ভোগান্তির শুরু হয়ে যায়। তার নাগরিক অধিকার দারুণভাবে বিঘিœত হতে থাকে। এটা সর্বৈব অন্যায়। এটাকেই মিডিয়া ট্রায়াল বলে। আমাদের প্রশাসনিক ব্যাবস্থাপনায় অনুমান নির্ভর বা পক্ষপাতিত্বমূলক ব্যাবস্থা গ্রহণ নতুন কিছু না। ক্ষমতাবানদের বিপক্ষে গেলে বা রোষানলে পড়লে ভুক্তভোগীর যাতনার যে শেষ নেই তা পাবলিক খুব ভালো জানে। কিন্তু তাই বলে মিডিয়াও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে? মিডিয়ার কাজ ঘটনার সংবাদ পরিবেশন, অনুসন্ধান , উদঘাটন ও ফলোআপ করা। এখানে তার নিজস্ব অভিমত যুক্ত করা বা প্রভাবিত করার করার কোন সুযোগ নেই। একাডেমিক আলোচনার খাতিয়ে মোটা দাগে আলোকপাত করা যেতে পারে, বিশ্লেষণের সুবিধার্থে প্রমাাণক হিসেবে কিছু অতীত দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। কিন্তু চলমান- ঘটমান বিষয়ে নিজেদের রায় প্রদানের প্রচেষ্টা এখতিয়ার বহির্ভূত। কোন অভিযোগে কাউকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করার পর তার বুকে যেমন কুখ্যাত অপরাধী বা আসামীর স্টিকার সাঁটা সঙ্গত নয় তেমনি একপেশে বক্তব্য প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্ব প্রদানও যথাযথ নয়। সাংবাদিকরা ঘটনা তুলে ধরবেন, সত্য উন্মোচনে সাহায্য করবেন, সমাজের গতিপথ নিয়ে বিশ্লেষণ ধর্মী নিবন্ধ লিখবেন, অনুসন্ধান কার্যে মগ্ন থাকবেন এগুলোই পাবলিকের প্রত্যাশা। বাস্তবে হচ্ছে উল্টো। ঘটনা ঘটার পরপরই ঘটনার সুবিধামত খন্ডিত চিত্র প্রকাশ, প্রভুর নির্দেশনা অনুযায়ী তা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা বা নিজেদের পক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। টক শো গুলোতে সঞ্চালকের নামে যারা আবির্ভূত হন তাদের ঝগড়াটে ও মারমুখী শব্দ চয়ন, বাক্য প্রক্ষেপণ থেকেই বুঝা যায় এই টক শো গুলোর উদ্দেশ্য কি? কাদের স্বার্থকে সংহত করতে এরূপ অতিনাটকীয়তার আশ্রয়? এটা কি সত্যানুসন্ধানের তাগিদে করা নাকি বিপক্ষ বহুমত উপস্থাপনের সুযোগ ব্যাহত করা নাকি এজেন্ডা বাস্তবায়নের নিমিত্ত সাজানো পরিবেশনা?
সাংবাদিকতার পেশা বরাবরই থ্যাংকলেস জব ছিলো। সত্যিকারের সাংবাদিকদের কোন স্থায়ী বন্ধু থাকে না। কাজের প্রকৃৃতির কারণেই তা হয়ে উঠে না। সাংবাদিকদের শক্তি হলো তার পাঠক ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। অপরদিকে তাদের বিপক্ষ শক্তি হলো স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী। বলাবাহুল্য সাংবাদিকতা তথাকথিত কোন চাকরি না। এর জন্য সৃজনশীল মানসিকতা আর সত্যানুসন্ধানের অভিলাষ জরুরি। এটাও ঠিক যে, সবার উপরে এটি একটি পেশাও। চাকরির নিরাপত্তা সবাই খুঁজে থাকে। সে অর্থে সাংবাদিকরাও চাকুরে। এখানেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। বর্তমান বাস্তবতায় দেশের প্রায় সিংহভাগ পত্রিকাই আজ কোন না কোন দলের বা গোষ্ঠীর প্রাইভেট লিমিটেড এজেন্সীতে পরিণত হয়েছে। তার উপর রয়েছে অনেক ভাসুরের অনুশাসন আর চাওয়া-পাওয়া। সরকারের নির্দেশনা প্রতিপালনের অনুশাসন , বিশেষ বিশেষ কর্তৃপক্ষের অসাধারণ খায়েস পূরণের নিম্নচাপ ,স্পন্সরকৃত কর্পোরেটের ধরিয়ে দেওয়া প্রেসক্রিপশন, বিজ্ঞাপন দাতা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা আর সর্বোপরি প্রভু-তুষ্টির অলংঘণীয় চুক্তিনামার অলিখিত বাধ্যবাধকতাকে ধারণ করেই সাংবাদিকতা যে আজ তরঙ্গ বিক্ষুব্ধ দরিয়া পার হচ্ছে এটাও বাস্তব সত্য। পাবলিক সব বুঝে। কিন্তু তাদের প্রত্যাশা কোটারি স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ না করে ভেতর থেকে লড়াইয়ের মানসিকতা ও সে অনুযায়ী কর্মপ্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অনুশীলন। তা না হলে দেশ ও জাতির চতুর্থ স্তম্ভের প্রয়োজন কি? যার যার মুখপাত্র হিসেবে প্রচারপত্র বা লিফলেটই যথেষ্ট। দেশে জাতীয় পর্যায়ের দৈনিকের সংখ্যা কত তার হিসেব তাৎক্ষনিকভাবে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে তা যে অনেক তা হলফ করেই বলা যায়। এরমধ্যে শতকরা কত শতাংশ জাতীয় মানের তাও বলা দুরূহ। তদ্রুপ ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রেও। খন্ডিত বা উদ্দেশ্যমূলক খবর পরিবেশনা করে স্থায়ী পাঠক তালিকা দীর্ঘ করা যায় না। বিশ্বস্ততা অর্জন করা যায় না। তাই তো পাঠক এখন ঘটনার নির্যাস পেতে একাধিক পত্রিকা বা চ্যানেল নেড়েঘেঁটে দেখে। তারপর ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে বিদেশী মিডিয়ার দ্বারস্থ হয়।
মিডিয়া ট্রায়াল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও মানবতা বিরোধী গর্হিত অপরাধ। কলমের এক খোঁচায় কারো চরিত্রনাশ করে তার ব্যাক্তিক, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন দুর্বিষহ করার মত এক তরফা অপরাধ আর দ্বিতীয়টি নেই। ভুক্তভোগীর প্রতিবাদ করার অধিকার অবশ্যই আছে কিন্তু তার আগেই তার সম্মন্ধে যা হবার তা হয়ে যায়। পাবলিকের এত সময় কোথায়? পত্রিকায় পড়েছে, চ্যানেলে দেখেছে তাই ‘কুচ তো কুচ গরবর হ্যায়’ জাতীয় ধারণা মগজে গেঁথে যায়। সবচেয়ে অসহ্যকর ও হতাশা বোধ হয় তথন, যখন দেখা যায় প্রমানিত অপরাধীকে মিডিয়ায় এনে দ্বিধাহীনভাবে গ্লোরিফাই করার সাজানো নাটক করা হয়। তখন পাবলিকের যাওয়ার আর কোন জায়গা থাকে না। এমনিতেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে প্রিন্ট মিডিয়া তাদের অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। তার উপর যদি এরূপ কায়কারবার অটুট থাকে তাহলে তা ‘সরকারি সুবিধাভোগী’ আর ‘সাংঘাতিক স্ত¤’¢ হিসেবে পরিগণিত হবে। মিডিয়া ট্রায়ালের মত একপেশে, উদ্দেশ্যমূলক, বাণিজ্য নির্ভর খবর যত বেশি প্রকাশিত হবে ততই তা পাবলিকের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। সাংবাদিকতার এখনকার অপর চিত্রটি হলো বিশেষ বিশেষ ব্যাক্তি, গোষ্ঠী, দল বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রত্যক্ষ চাটুকারিতা। পাঠককে তা দারূণভাবে লজ্জিত ও আহত করে। পুলিশের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ থাকলেও দিন শেষে ভুক্তভোগী সকলেই যেমন পুলিশের স্মরণাপন্ন হয় সেরূপ সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার কাছেও পাবলিকের প্রত্যাশা নি:শ্বাস ফেলার মত অন্তÍত: একটা জায়গা উন্মুক্ত থাকুক। ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে তা আপন মহিমায় আবারো অধিষ্ঠিত হোক এই প্রত্যাশা সবার। এটা কি খুব বেয়াড়া কোন প্রত্যাশা?
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই